বঙ্গভবনে অন্তর্বর্তী সরকারের শপথের সময় ছিল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটায়। সন্ধ্যা সাতটায় মগবাজারের বাসা থেকে রওনা হওয়ার পর দুশ্চিন্তা ছিল—সময়মতো পৌঁছানো যাবে কি না। সড়কের মোড়ে মোড়ে শিক্ষার্থীরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছিলেন।
যানজট তেমন ছিল না। কিন্তু রাজউক ভবনে এসেই বিপাকে পড়লাম। সামনে বহু গাড়ি-বাস-অটোরিকশা থমকে আছে। শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই সামাল দিতে পারছিলেন না। রাস্তার দুই দিক থেকেই যানবাহন যাচ্ছিল বঙ্গভবন অভিমুখে। অবস্থা বেগতিক দেখে আরও অনেকের মতো আমিও হাঁটা শুরু করি।
বঙ্গভবনের সীমানার ব্যারিকেড পার হতেই কয়েকজনকে দেখলাম অতিথিদের পরিচয়পত্র পরখ করছেন। এর মধ্যে এক ভদ্রলোক হাতে বিএনপির প্যাডে লেখা তালিকা ধরে অভ্যাগতদের নাম মেলাচ্ছেন। বেশ খটকা লাগল। যে কাজ বঙ্গভবনের নিরাপত্তাকর্মীদের করার কথা, সেটি বিএনপির নেতা করেন কী করে? একজন নিরাপত্তাকর্মীকে মুঠোফোনের খুদে বার্তা দেখিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। সঙ্গে আরও দুজন সাংবাদিক বন্ধু ছিলেন।
আমরা যখন বঙ্গভবনে পৌঁছাই, রাত আটটা। দরবার হল কানায় কানায় পূর্ণ। সাংবাদিকদের নির্ধারিত স্থানে গিয়ে কোনোরকমে একটি চেয়ারে বসলাম। দেখলাম, গত ১৫ বছর যাঁরা বঙ্গভবনে আসতেন, দু–একজন ছাড়া তাঁদের কেউ আমন্ত্রণ পাননি বা পেলেও আসেননি।
আবার এ সময়ে যাঁরা বঙ্গভবন-গণভবনের ত্রিসীমায় আসেননি, তাঁদের সরব উপস্থিতি লক্ষ করলাম। চোখে বিজয়ের ঝিলিক। আমরা জাতীয় ঐক্যের কথা বলে এক দলকে দেয়ালের বাইরে রাখি, আরেক দলকে ভেতরে ডাকি। এই ধারা ৫৩ বছর ধরেই চলছে।
তখনো অতিথিরা আসছিলেন। বঙ্গভবনের কর্মীরা বাড়তি আসনের ব্যবস্থা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানো টিভি সাংবাদিকেরা থেমে লাইভ করছিলেন।
এরই মধ্যে এক সাংবাদিক বন্ধু জানান, বিকল্প ধারা বাংলাদেশের নেতা মাহী বি চৌধুরীর গাড়ি বঙ্গভবনের গেটে আটকে দিয়েছেন এক দল তরুণ। আরেকজন বললেন, এসব আসলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী নন, ছাত্রদলের কর্মী–সমর্থক। ভেতর থেকে যাচাই করার সুযোগ ছিল না। মাহী বি চৌধুরী সম্প্রতি ভেঙে দেওয়া সংসদের সদস্য ছিলেন না। ২০১৮ সালের সংসদের সদস্য ছিলেন।
৯টা ১২ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন দরবার হলে এলেন। এরপর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু হলো। দীর্ঘদিন ধরে রেওয়াজ ছিল জাতীয় সংগীতের পর সব ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা। এবার তার ব্যতিক্রম দেখলাম। কেবল সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করার পরই আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। প্রথমে ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিলেন, এরপর উপদেষ্টা পরিষদের অন্য সদস্যরা শপথ নিলেন। কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, সংস্কারটা এখান থেকেই শুরু হলো কি না।
শপথ অনুষ্ঠানে অভ্যাগতদের মধ্যে বিএনপির অনেক কেন্দ্রীয় ও মধ্যম স্তরের নেতা ছিলেন। জাতীয় পার্টির নেতারা ছিলেন। জামায়াতে ইসলামীর নেতারা ছিলেন। ছিলেন গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারাও। এমনকি বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতাদেরও দেখলাম। কিন্তু আওয়ামী লীগের কোনো নেতা কিংবা তাদের সমর্থক লেখক–বুদ্ধিজীবী ছিলেন না।
দৃশ্যটি ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই অনুষ্ঠানে বিএনপি বা চারদলীয় জোটের কোনো নেতা ছিলেন না। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের নেতারা ছিলেন।
অথচ নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিতাড়িত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি দুই পর্বেই ‘সমাদৃত’। অফিসে থাকতেই খবর পেয়েছিলাম, অ্যাটর্নি জেনারেল পদে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানকে নিয়োগ দিয়েছেন, যিনি এক দিন আগেও বিএনপির মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। এর আগে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন পদত্যাগ করেন, তিনি আওয়ামী লীগের লোক ছিলেন।
এসব সংস্কার তো তিন মাস বা ছয় মাসে শেষ হওয়ার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর বিকল্প নেই। প্রশ্ন হলো বিএনপি কি সেই সংস্কার পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিতে হবে। দলের তৃণমূলের নেতা–কর্মীরাও চান দ্রুত নির্বাচন হোক।
শপথ অনুষ্ঠানে অনেকের সঙ্গেই আলোচনা হয়েছে। তাঁরা জানতে চেয়েছেন, কী করে শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনকে গণ–আন্দোলন তথা গণবিদ্রোহে রূপ দিলেন? তাঁদের হাতে কী ম্যাজিক ছিল? এখানে ম্যাজিকের বিষয় নয়।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি ন্যায্য ছিল আর সরকারের প্রতি গণমানুষের রোষ ছিল। শেখ হাসিনার সরকার যে জনগণ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সেটাই প্রমাণিত হলো। গত ৭ জানুয়ারি এ রকম একটি জবরদস্তি ও আমি–ডামির নির্বাচন না করলে হয়তো তাঁদের এতটা অবমাননাকরভাবে বিদায় নিতে হতো না। ক্ষমতার হাতবদলের স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ করে দিলে এ রকম পরিণতিই হয়।
অনেকেরই প্রশ্ন ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার কি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে? তারা কত দিন থাকবে? আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্র ও রাজনীতির সংস্কারের কথা বলেছেন। ফ্যাসিবাদী কায়দায় দেশ শাসনের অবসান চেয়েছেন।
এসব সংস্কার তো তিন মাস বা ছয় মাসে শেষ হওয়ার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর বিকল্প নেই। প্রশ্ন হলো বিএনপি কি সেই সংস্কার পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিতে হবে। দলের তৃণমূলের নেতা–কর্মীরাও চান দ্রুত নির্বাচন হোক। অন্যদিকে উপদেষ্টাদের কেউ কেউ সময় নেওয়ার কথা বলেছেন। তাঁরা মনে করেন, স্বল্প সময়ে কিছুই করা যাবে না। শপথ নেওয়ার আগে একজন উপদেষ্টা বলেছেন, অন্তত দুই বছর সময় লাগবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক করতে।
সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্বের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। ১২৩(৩)(খ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে পরের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে।
শপথ অনুষ্ঠানেই ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়কের সঙ্গে কথা হয়। তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কত দিন হওয়া উচিত। তিনি সুনির্দিষ্টভাবে কিছু না বললেও তিনটি লক্ষ্যের কথা জানালেন। প্রথমত, আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে গণহত্যা হয়েছে, তার বিচার করতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার করতে হবে। তাঁরা এমনভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার চান, যাতে কোনো ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হতে না পারেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যও চান তাঁরা।
আলোচনার একপর্যায়ে ওই তরুণ নেতাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনাদের ৯ দফা দাবিতেও প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের পদত্যাগের কথা ছিল না। সরকার যদি সেটা মেনে নিত, আপনারা কী করতেন? জবাবে তিনি বললেন, ‘ওই ৯ দফার প্রথমেই ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। অন্য আটটি দফা তাঁর পক্ষে মানা সম্ভব হলেও এটি যে মানবেন না, সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত ছিলাম।’
এ কারণেই ছাত্রদের ৯ দফা দাবি এক দফায় এসে ঠেকে। আওয়ামী লীগের ‘বাঘা বাঘা’ নেতা সেটা বুঝতে পারেননি।
ফেরার পথে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যকে জিজ্ঞেস করি। তিনি বললেন, সবকিছু আইন দিয়ে দেখলে হবে না। রাজনৈতিক বাস্তবতাও আমাদের বুঝতে হবে। তাঁর কথায় মনে হলো বিএনপি ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত সরকারকে বাড়তি সময় দিতে চায়। কেননা, তাঁর প্রতি বিএনপির নেতৃত্বের পূর্ণ আস্থা আছে।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি