আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ধ্বনি এখন চারদিকে। ‘জয় বাংলা, জিতবে আবার নৌকা’ কিংবা ‘বারবার দরকার, শেখ হাসিনার সরকার’—রাজপথের নির্বাচনী মিছিলে এসব শুনি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অসহনীয় যানজটে আটকে থাকি, ভাবি কার সঙ্গে জিতবে এবার নৌকা, কে দাঁড়িয়েছে তার বিরুদ্ধে?
পরিসংখ্যান অনুসারে এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দাঁড়িয়েছে ডজন দুয়েক দল। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সদ্য ভূমিষ্ঠ কয়েকটি কিংস পার্টি এবং আওয়ামী লীগের জোটে থাকা ক্ষুদ্র কিছু অনুগত দল।
একমাত্র উল্লেখযোগ্য যে জাতীয় পার্টি, কিছু আসন ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাসের ভিত্তিতে তারাও নির্বাচনে যেতে রাজি হয়েছে। এ ছাড়া বাড়তি প্রতিদ্বন্দ্বিতার আমেজ সৃষ্টির জন্য আওয়ামী লীগ কিছু ডামি প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তাই প্রকৃত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। ৩০০ আসনে ভোটের লড়াই হবে আওয়ামী লীগ বনাম অনুগত বা ডামি প্রার্থীদের। নির্বাচনে আসল প্রতিপক্ষ যে দল ছিল, তার নেতা-কর্মীদের জেলে ভরে বা গ্রেপ্তারের জন্য সারা দেশে পুলিশি অভিযান চালিয়ে দৃশ্যপট থেকে বিতাড়িত করা গেছে। দৈব কোনো দুর্বিপাক না হলে ৭ জানুয়ারি নির্বাচন হচ্ছে এবং এতে আওয়ামী লীগ এবার ৩০০ আসনেই (নিজেদের এবং অনুগতদের মিলিয়ে) জয়ী হচ্ছে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
বলা যায়, শুরুর আগেই শেষ হয়ে গেছে ২০২৪ সালের নির্বাচন!
২.
এ নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের একটি কাজ এখনো বাকি রয়ে গেছে। এটি হলো ‘অংশগ্রহণমূলক’ হয়েছে, তা দেখানোর জন্য নির্বাচনের দিন ভোটারদের কেন্দ্রে আনার কাজটি। সে জন্যও এখন নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে।
ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধ্য করার জন্য দুস্থ ও বৃদ্ধ মানুষদের ত্রাণসহায়তার কার্ড জমা দিতে বলা হচ্ছে। ভোট দিতে না এলে নাগরিক সেবা (ভাতা, সনদ, সত্যায়ন) বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে আরও বহু রকম চাপ থাকবে ভোটারদের কেন্দ্রে আনার জন্য।
আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছরে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজিয়েছে, এসব অবৈধ কাজের জন্য রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার চেষ্টা করবে না। ফলে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করে দলটি কিছু বাড়তি ভোটার আনতে পারবে ভোটকেন্দ্রে। ইচ্ছেমতো ব্যালটে সিল দিয়ে, অনুমোদিত পর্যবেক্ষক ও নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের ভাষ্যে এটিকে যথেষ্টসংখ্যক ‘অংশগ্রহণমূলক’ দেখানোও হয়তো সম্ভব হবে।
২০২৪ সালের নির্বাচনে তাই প্রার্থী থাকবে, কিছু ভোটারও থাকবে এবং এতে সুনিশ্চিতভাবে একটি দল বিজয়ী হবে। তবে এটি কতটা দমননীতির আর অপকৌশলের বিজয় আর কতটা ভোটের জয়, সে প্রশ্ন থাকবে।
৩.
প্রশ্ন আসবে, বিএনপি ও তার সঙ্গীরা নির্বাচনে না এলে আওয়ামী সরকারের কী দোষ? তবে এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ও সংস্কৃতির কথা মনে রাখলে তার আগে প্রশ্ন আসা উচিত, ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে আনার চেষ্টা কি সরকার করেছে?
কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আব্দুর রাজ্জাকের বক্তব্যে এটি স্পষ্ট যে সেই চেষ্টা করা হয়েছে, তবে তা বাঁকা পথে। তিনি বলেছেন, এক রাতে বিএনপির সব নেতাকে মুক্তি দিয়ে নির্বাচনে আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তাঁর এ বক্তব্যের সত্যতা কোনো কোনো মন্ত্রী অস্বীকার করেছেন, চাপে পড়ে তিনিও পরে কিছুটা অন্য রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
তবে কৃষিমন্ত্রীর বর্ণনা মোতাবেক চেষ্টা যে সত্যিই হয়েছিল, তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের ঘটনা। বিএনপির নেতারা এখন যেসব মামলায় জেলে রয়েছেন, একই মামলায় তিনিও অন্তরীণ ছিলেন, রিমান্ডেও দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। এরপর তিনি আকস্মিকভাবে জামিন পান, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জেল থেকে বের হয়ে আসেন এবং পরদিনই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন। একই ধরনের ঘটনা ঘটে বিএনপির আরেক নেতা একরামুজ্জামানের ক্ষেত্রে। কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্য অসত্য বা ব্যক্তিগত হলে এসব ঘটনার ব্যাখ্যা কী?
এসব ঘটনা প্রমাণ করে, আলাপ-আলোচনা করে কোনো সমঝোতা নয়, বরং জেলে ভরে চাপ সৃষ্টি করে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার চেষ্টা করেছিল সরকার। এসব ঘটনা এ ইঙ্গিতও দেয় যে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে নাশকতার মামলাগুলো বস্তুনিষ্ঠ নয় এবং তাঁদের জামিন নির্ভর করছে সরকারের ইচ্ছার ওপর।
এ আলামত শুধু জামিনের ক্ষেত্রেই দেখা যায়নি, শাস্তিদানের ক্ষেত্রেও। না হলে বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার মতো গুরুতর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার যেখানে ৩ দশমিক ৬, সেখানে গায়েবি রাজনৈতিক মামলায় বিরোধী দলের নেতাদের কীভাবে শাস্তি হচ্ছে প্রায় ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে? কেন শুধু এসব মামলায় ঘনঘন শুনানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে, রাতের বেলায় আদালত বসানো হচ্ছে, পুলিশকে বাধ্যতামূলকভাবে এজাহার অনুযায়ী সাক্ষী দিতে বাধ্য করা হচ্ছে?
এটি ভাবার তাই কারণ রয়েছে যে শুধু প্রশাসন ও পুলিশকে নয়, রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে এবার ব্যবহার করা হচ্ছে জনগণের ভোটাধিকারকে সীমিত বা খর্ব করার কাজে এবং ভুয়া নির্বাচন প্রতিরোধের আন্দোলন দমনের কাজে। আর এভাবেই নিশ্চিত করা হচ্ছে একতরফা নির্বাচন এবং এতে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া বিজয়।
এ বিজয়কে আগামী পাঁচ বছর বজায় রাখার জন্য ভবিষ্যতে আমরা আরও কঠোর দমননীতি দেখতে পারি দেশে। এর মধ্যে বিএনপির মতো প্রধান একটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠছে।
পাশাপাশি দেশে ঘটছে বিভিন্ন রহস্যজনক নাশকতার ঘটনা, প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। আলী রীয়াজ তাঁর একটি নিবন্ধে লিখেছেন, চীন ও কম্বোডিয়া মডেলের মতো শুধু অনুগত ও অনুল্লেখ্য দলকে সক্রিয় রেখে কার্যত একটি একদলীয় সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলছে দেশে। নাশকতার ঘটনার দায় বিএনপির ওপর চাপিয়ে দলটিকে নিষিদ্ধ করা গেলে সত্যি তা করা যাবে বাংলাদেশে।
একের পর এক সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে হয়তো সেদিকেই যাচ্ছি আমরা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কী গৌরব আছে এ বিজয়ে, কার লাভ হবে এতে!
৪.
সাজানো নির্বাচন হলে দেশের গণতন্ত্র ও দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হওয়া নিয়ে বহু কিছু লিখেছেন বিশেষজ্ঞরা। আমার আশঙ্কা, এ নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক বন্ধনও বিপর্যস্ত হতে পারে। যে কঠোর দমননীতি এবার দেখা যাচ্ছে, তা দেশের রাজনৈতিক সমাজকে দুভাগে বিভক্ত করে ফেলছে।
একটি অত্যাচারী, আরেকটি অত্যাচারিত পক্ষ। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব সমাজে থাকবে। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বিভেদ ও বিদ্বেষ বাড়বে। রাষ্ট্রের শক্তি ও ঐক্য এভাবে খর্বিত হলে শাসকগোষ্ঠীর পক্ষের বিদেশি রাষ্ট্রগুলো আরও সুযোগ নেবে। অন্যরা বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে নিজেরাও সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে একসময়।
দমননীতি, বিভাজন সৃষ্টি ও সাজানো নির্বাচনে এভাবেই বিজয়ী হয় দল বা গোষ্ঠী, পরাজিত হয় দেশ। আমার মনে হয় না, এমন একটি নির্বাচন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল এ দেশে।
আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক