দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের জন্ম ৩০০ বছর আগে। মহান জার্মান চিন্তাবিদদের মধ্যে তিনি আজও সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। জার্মানিতে এ বছর উদ্যাপিত হচ্ছে বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের ৩০০তম জন্মজয়ন্তী। এই দার্শনিককে নিয়ে নানা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বের হয়েছে স্মারক ডাকটিকিট।
জার্মানির জগদ্বিখ্যাত যেসব দিকপাল দার্শনিকের কথা এখনো স্মরণ করা হয়, তাঁদের মধ্যে প্রথমেই আসে ইমানুয়েল কান্ট, ফ্রেডরিখ হেগেল, আর্থার শোপেনহাওয়ার, ফ্রেডরিখ নিৎশে, কার্ল মার্ক্স, ফ্রেডরিখ এঙ্গেল, কার্ল জেসপার প্রমুখরা।
ইমানুয়েল কান্ট থাকতেন জার্মান সাম্রাজ্যের পূর্ব প্রুশিয়ার রাজধানী শহর কোনিগসবার্গে। সেখানেই তাঁর জন্ম, ১৭২৪ সালের ২২ এপ্রিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের পরাজয় ঘটলে এই পুরো অঞ্চল রাশিয়ার অন্তর্গত হয়। ১৯৪৬ সালে রুশরা শহরটির নামকরণ করেন কালিনিনগ্রাদ। কান্ট তাঁর প্রায় পুরো জীবন, আমৃত্যু এই শহরেই কাটিয়েছেন।
কান্টকে এই শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন বলে মনে করা হয়। কান্ট জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যাসহ প্রায় সব বিষয়েই আগ্রহী ছিলেন। তবে দার্শনিক পরিচয়েই তিনি বিশ্বখ্যাত। তাঁর আলোকিত দার্শনিক চেতনা, তাঁর ধারণাগুলো পৃথিবীর গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ভিত্তি।
আজকের যুদ্ধময় পৃথিবীতে দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের কথা আবার ঘুরেফিরে আসছে। বার্লিনে ইমানুয়েল কান্টের ৩০০তম জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ একহাত নিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে। তিনি ইমানুয়েল কান্টকে নিয়ে পুতিনের ভুল ব্যাখ্যার সমালোচনা করেছেন।
এ বছরের জানুয়ারিতে, ভ্লাদিমির পুতিন, কান্টের জন্মশহর কালিনিনগ্রাদের ছাত্রদের সঙ্গে একটি প্রাক্-নির্বাচনী সভায় ‘মানুষের বাঁচার অর্থ কী’, তা নিয়ে কান্টের প্রতিফলন সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। কান্টের ধারণা সম্পর্কে পুতিনের ধারণা কীভাবে সমান্তরাল হয়েছে, তা বলা কঠিন।
তবে ২০০৫ সালে সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোডারের সঙ্গে কালিনিনগ্রাদে ইমানুয়েল কান্টের নামে যখন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের স্মারক ফলক উদ্বোধন করেছিলেন, তখন পুতিন উল্লেখ করেছিলেন যে রাশিয়ার শান্তিপ্রিয় নীতিগুলো এই দার্শনিকের শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।
ইতিমধ্যে ২০২১ সালের বসন্তে, পুতিন একটি ডিক্রির মাধ্যমে ইমানুয়েল কান্টের জন্মের ৩০০তম বার্ষিকী উদ্যাপন নির্দেশে সই করে বলেছিলেন, রুশ রাজনীতিবিদেরা যেন তাঁদের কথায়, বক্তব্যে এই দার্শনিকের উদ্ধৃতি ব্যবহার করতে দ্বিধা না করেন।
এদিকে জার্মানির রাজধানী বার্লিনে ২২ এপ্রিল ইমানুয়েল কান্টের ৩০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বার্লিন-ব্র্যান্ডেনবার্গ একাডেমি অব সায়েন্সেসের অনুষ্ঠানে একটি বক্তৃতায় জার্মান চ্যান্সেলর শলৎজ বলেছেন, ‘পুতিনের আগ্রাসনবাদী যুদ্ধ দার্শনিক কান্টের সব মৌলিক বক্তব্যের বিরোধিতা করে।’ তিনি বলেন, ‘কান্টের দর্শনকে ভুলভাবে ব্যাখ্যার সামান্যতম অধিকার পুতিনের নেই।’
ওলাফ শলৎজ পুতিনকে ইমানুয়েল কান্টের তত্ত্বকে ভুলভাবে তুলে ধরার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। তিনি আরও বলেন, পুতিন সেই দার্শনিককে চিত্রিত করতে পছন্দ করেন, যাঁর জন্মস্থান এখন রাশিয়ার ছিটমহল কালিনিনগ্রাদে। শলৎজের মতে, ‘মানবাধিকার ও মানবিক মর্যাদা সম্পর্কে কান্টের ধারণা, সেই সঙ্গে যুদ্ধ ও শান্তি সম্পর্কে তাঁর চিন্তাভাবনার বিপরীতটাই করছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন।
তিনি তাঁর দেশে যে গণতন্ত্রের অনুশীলন করছেন বা ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞের আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করছেন, তা একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক মানুষ ইউরোপে তা সম্ভব বলে মনে করেছিল।’
এই আলোকিত দার্শনিকের ৩০০তম জন্মজয়ন্তীতে একজন রুশ কান্ট-ভক্ত এবং একজন জার্মান কান্ট-ভক্ত, কান্টের দর্শনচর্চায় কারা সঠিক আর কারা বেঠিক, তা নিয়ে বিতর্ক করছেন।
ইমানুয়েল কান্ট হলেন সেই দার্শনিক, যিনি তাত্ত্বিকভাবে সর্বজনীন মানবাধিকার হিসেবে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা, নাগরিক অধিকার বিশ্বের সর্বত্র প্রয়োজন বলে মনে করতেন। তিনি সব স্বৈরাচারীকে অবিশ্বাস করতেন। তিনি বলতেন, বিশ্বের সর্বত্র গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি বিরাজ করলেই কেবল স্থায়ী শান্তি হতে পারে।
কান্ট ১৭৯৫ সালের প্রথম দিকেই জাতিসংঘ গঠনের জন্য একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি তাঁর রচনা ‘চিরন্তন শান্তির জন্য’তে যে শর্তগুলো তৈরি করেছিলেন, তা এখনো পূরণ হয়নি।
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে পুতিনকে একহাত নিয়েছেন বটে, তবে ইউক্রেন ও গাজা উপত্যকার পরোক্ষভাবে যুদ্ধে শামিল হওয়ার জন্য কান্টের রাজনৈতিক ও শান্তির পরামর্শকে যুক্তিযুক্ত করতে সক্ষম হননি।
বার্লিনে সেই সন্ধ্যায় ওলাফ শলৎজ শান্তির জন্য যতটা ভ্লাদিমির পুতিনের খপ্পর থেকে দার্শনিক ও চিন্তাবিদ কান্টকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন, তিনি নিজেও রাজনীতিতে কান্টকে ভুলভাবে ব্যবহার করছেন।
৩০০ বছর আগে জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট মনে করতেন যে একজন দার্শনিককে অবশ্যই তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে: আমি কি জানতে পারি? আমাকে অবশ্যই কি করতে হবে? আর আমি কিসের আশা করতে পারি? তিনি বলতেন, মানুষ অনেক কিছু শেখে, আশা করে এবং নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ করে। আর তা করে শুধু এই কারণেই যে তার আছে একটি মন, চৈতন্য ও ইচ্ছাশক্তি।
জার্মানির টাজ পত্রিকাটি লিখেছে, ‘এখনো কান্টের দর্শন প্রাসঙ্গিক কি না বা আজও কান্টের দর্শন পড়তে হবে কি না?’ তারা লিখেছে, ইমানুয়েল কান্ট তাঁর লেখার সঙ্গে বিষয়গুলোকে কঠিন করে তোলেন। কান্টের জটিল প্রবর্তিত শব্দগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো ‘অতীন্দ্রিয় দর্শন’, যেটি তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
কান্টের দর্শনের সমালোচনাও রয়েছে, তা থাকতেই পারে। আর তিন শতাব্দী আগের সমাজব্যবস্থা আর বিশ্ব পরিস্থিতি এক নয়। দার্শনিক হিসেবে তাঁর সর্বজনীনতা এখন শেষ হয়েছে কি না, তা একটি উন্মুক্ত প্রশ্ন। কান্ট গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নীতিদর্শনের কথা বলেছিলেন, যা আজও প্রযোজ্য।
কোনিগসবার্গ শহরে ধনীদের সন্তানদের প্রাইভেট টিউটর হিসেবে যাঁর জীবন শুরু হয়েছিল, সেই আত্মবিশ্বাসী তরুণ একাডেমিক বা সামাজিকভাবে, আর্থিকভাবে সফল না হলেও অনেক চেষ্টার পর যিনি কোনিগসবার্গে যুক্তিবিদ্যা ও অধিবিদ্যার অধ্যাপক পদ পেয়েছিলেন। সেই ইমানুয়েল কান্ট আজ ৩০০ বছর পরও মানুষের মনন ও চিন্তার জগতে প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন। তিনি রয়েছেন স্বমহিমায়।
সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি। [email protected]