এ পর্যন্ত নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ৯৫৪ ব্যক্তি এবং ২৭টি সংগঠন। এ তালিকায় এশিয়ার প্রতিনিধি ৭০ জনের মতো। বিশ্ব মানবসম্পদে এশিয়ার হিস্যার (৬০ শতাংশ) তুলনায় এটা অল্পই বলতে হবে। তার মাঝে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার নিয়ে যে অঞ্চল, তার পুরস্কার-হিস্যা তুলনামূলকভাবে আরও কম। এশিয়ার নোবেলের বড় অংশ গেছে জাপানের ঘরে।
অতীতে নোবেল পাওয়া দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় বিশেষ উল্লাসের ব্যাপার ছিল। সামনে বোধ হয় তেমন না-ও হতে পারে। বিশেষ করে অং সান সু চি, আবদুস সালাম, মাদার তেরেসা, মুহাম্মদ ইউনূসের পর অমর্ত্য সেনকে যে নিদারুণ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের কেউ এ রকম বিশ্বসম্মান না–ও পেতে চাইবেন; পেলেও দ্রুত নিজ নিজ জনপদ ছেড়ে লুকাতে চাইবেন দূরে কোথাও।
কবরফলকও সংশোধনের শিকার
দক্ষিণ এশিয়ায় নোবেল বিজয়ীদের দুর্গতি যে মৃত্যুর পরও তাড়া করতে পারে, তার নজির আবদুস সালাম। তিনি আহমদিয়া বা কাদিয়ানি সম্প্রদায়ের মানুষ। যদিও পুরস্কার পেয়েছিলেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় গবেষণা ও পরিশ্রমের জোরে, কিন্তু তাঁর দেশের নাগরিকদের বড় অংশের কাছে তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাসই ছিল মুখ্য, জ্ঞানজগতে তাঁর অবদান নয়। ফলে, একপর্যায়ে এ–ও দেখা গেছে, তাঁর কবরের ফলকে পরিচয়বিবরণী থেকে ‘মুসলমান’ পরিচয় ঘষে তুলে দেওয়া হয়। পাকিস্তানে আহমদিদের ‘অমুসলমান’ ঘোষণার সঙ্গে এ উদ্যোগ সম্পর্কিত ছিল।
আবদুস সালাম প্রায় ৪৫ বছর নিজ দেশে বিজ্ঞান গবেষণায় বিপুল অবদান রাখলেও প্রধান জনগোষ্ঠী তাঁকে কীভাবে দেখে, উপরিউক্ত ঘটনায় তার কিছুটা ইঙ্গিত রয়েছে। আবদুস সালামের নোবেল প্রাপ্তির ৩৫ বছর দেশটির দ্বিতীয় নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়। ১৭ বছর বয়সী কারও নোবেল পাওয়া ঘটনা হিসেবে বৈশ্বিকভাবে বিশেষ সম্মানের হলেও পাকিস্তানে বিরাটসংখ্যক মানুষের কাছে তিনি ‘পশ্চিমের সংস্কৃতি’ প্রচারকারী হিসেবে নিন্দার শিকার। ধর্মীয় মূল্যবোধে মালালার কমতি আছে বলে শক্তিশালী অভিমত আছে।
পাকিস্তানে আবদুস সালাম ভিন্নধাঁচের বিড়ম্বনার আভাস পেয়ে ৬৮ বছর বয়সে দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। পরে তাঁর মৃতদেহ কেবল দেশে ফেরে। মিয়ানমারে সু চির পক্ষে পালানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু এখন তাঁর বার্ধক্যও প্রতিপক্ষের কাছ থেকে ছাড় পাচ্ছে না। লিউ শিয়াবো বাঁচতেই পারেননি। মালালাকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে আধা গোপন, আধা প্রকাশ্য এক জীবনে। সেন পরিবারের বসতভিটাও হয়তো ‘উদ্ধার’ করে নেবে সে দেশের কেন্দ্রীয় সরকার।
পাঁচ দফা কারাজীবন কাটাতে হয় লিউ শিয়াবোকে
মালালা ছাড়াও এ অঞ্চলে আরও তিনজন ‘শান্তি’তে নোবেল পান। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নোবেল পুরস্কারের বড় এক অংশই গেছে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান’–এর জন্য। তবে বিস্ময়কর ও কৌতুককর হলো, এ রকম পুরস্করগ্রহীতারা প্রায় সবাই গুরুতর অশান্তির মধ্যে পড়েছেন বলে তাঁদের নিকটজনদের দাবি।
মালালার পুরস্কার পাওয়ার ২২ বছর আগে নোবেল পান মিয়ানমারের অং সান সু চি। তাঁর এই পুরস্কার পাওয়ার পটভূমি তৈরি করেছিল গণতন্ত্রের জন্য তাঁর অতীত সংগ্রাম এবং দীর্ঘ গৃহবন্দিত্ব। দুর্ভাগ্যের দিক, এ লেখা তৈরির সময়ও ৭৭ বছর বয়সী এই নারী গৃহবন্দী। মাঝখানে কিছুদিন নির্বাচনে জিতে সরকার চালালেও তাঁর আপাতত মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। ইতিমধ্যে কয়েক দফায় প্রায় ১৭ বছরে জেল জীবন কাটিয়ে ফেলেছেন তিনি। সু চির জীবন মিয়ানমারের পাশের দেশ চীনের লিউ শিয়াবোর পরিণতি স্মরণ করিয়ে দেয় এখন। ২০১০ সালে শান্তিতে নোবেল পাওয়া এই লেখক জেল খাটতে খাটতেই মারা গেলেন ২০১৭ সালের জুলাইয়ে। মৃত্যু নিশ্চিত জানার পরই এক মাস আগে তাঁকে ছাড়া হয়। তার আগে বিভিন্ন সময় অন্তত পাঁচ দফা বন্দী ছিলেন তিনি।
‘ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদী’ বলা হতো তেরেসাকে
মুহাম্মদ ইউনূস, মালালা ইউসুফজাই, অং সান সু চির আগে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তিতে নোবেল পুরস্কার আসা শুরু মাদার তেরেসার মাধ্যমে।
জন্মগতভাবে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ না হলেও এ অঞ্চলে কাজের জন্যই নোবেল পান মাদার তেরেসা। মৃত্যুর আগে-পরে তিনিও তীব্রভাবে সমালোচিত ছিলেন। কেউ কেউ তাঁকে ‘ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদী’ বলেছে। অনেকে বলেছে, তিনি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নন—এমন ধনীদের থেকে দানের অর্থ নিতেন। এ রকম সমালোচনাকারীদের তালিকায় খ্যাতনামা মার্ক্সবাদী তারিক আলীও আছেন।
বাংলাদেশেও বামপন্থী গুরুজনেরা গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার নিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসের সমালোচনা করতেন। তার মধ্যেই গ্রামীণ ব্যাংকসহ মুহাম্মদ ইউনূস যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান ২০০৬ সালে। এরপর ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। ওই বছর থেকে তিনি আর বিখ্যাত ওই ব্যাংকে নেই। গত এক যুগে তিনি আরও কিছু আইনগত এবং তদন্তমূলক পদক্ষেপের মুখে আছেন।
এ অঞ্চলের নোবেল বিজয়ীদের অশান্তির সর্বশেষ অধ্যায় দেখছি আমরা পশ্চিমবঙ্গে অমর্ত্য সেনের বেলায়। তাঁদের পরিবারকে সম্প্রতি পৈতৃক বাড়ি ‘প্রতীচী’ থেকে জমি ফেরত দেওয়ার নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
অমর্ত্য সেনদের বাড়ি ‘প্রতীচী’ বেশ পরিচিত। রবীন্দ্রভারতীয় সবেক উপাচার্য পবিত্র সরকারের বিবরণমতে, শান্তিনিকেতনে অমর্ত্য সেনদের বাড়ির জমি তাঁর নানা ক্ষিতিমোহন সেনের আমলে লিজ নেওয়া। ক্ষিতিমোহন বিশ্বভারতীতে উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন একসময়। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর ক্ষিতিমোহনকে সবাই ওখানকার আশ্রমগুরু মানত। ১৯৩২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার অধ্যাপক আশুতোষ সেন বিয়ে করেন ক্ষিতিমোহনের কনিষ্ঠ কন্যা শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে থাকা অমিতা সেনকে। এই দম্পতিরই পুত্র অমর্ত্য সেন। বাংলা ভাগের আগে আগে মানিকগঞ্জ-বগুড়া-ঢাকার ঠিকানাগুলো পেছনে ফেলে ওখানেই উঠেছিলেন পূর্ববঙ্গের সেনরা।
পশ্চিমবঙ্গের একজন রাজনৈতিক সংগঠক সুমন সেনগুপ্ত তাঁর সংগৃহীত তথ্য তুলে ধরে ফেসবুক আইডিতে লিখেছেন আলোচিত ‘লিজ এগ্রিমেন্ট’টি হয়েছে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আশুতোষ সেনের—১৯৪৩ সালের অক্টোবরে। এসব তথ্যের যেটাই পূর্ণসত্য হোক—কোনভাবেই জমি নিয়ে অর্মত্য সেনের সঙ্গে কিছু হয়নি। এটা পুরানো আমলের একটা বিষয়।
বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য অবশ্য বলছেন, ওখানকার ‘প্রতীচী’ বাড়িটিতে ১৩ ডেসিমেল জমি আছে বেআইনিভাবে দখল করা, সুতরাং অশোক সেনের উত্তরসূরি হিসেবে নোবেল বিজয়ীকে এই জমি ছাড়তে হবে। তবে কলকাতার মানুষ মনে করছে, এটা কেবল ১৩ ডেসিমেল জমির বিষয় নয়।
অতঃপর অমর্ত্য সেনকে বসতভিটার একাংশ ছাড়ার নোটিশ
শব্দ হিসেবে ‘প্রতীচী’র মানে পশ্চিম দিক বা পশ্চিমমুখী। শান্তিনিকেতনে সেন পরিবারের যন্ত্রণার ‘পূর্ব দিকে’ রয়েছে অমর্ত্য সেনের ওপর ভারত শাসকদের রাগ-ক্ষোভ। এই ক্ষোভে আরএসএস পরিবার বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্তাদের দিয়ে ঘি ঢালছে বলে বিশ্বাস করে অনেক বাঙালি। কোনো ধরনের আর্থিক ত্রুটি না পেয়ে নজর পড়েছে অশোক সেনের বাড়ির দিকে। অথচ ১৯৯৮ সালে অমর্ত্য সেন নোবেল পাওয়ার পরের বছর অটল বিহারির বিজেপি সরকার তাঁকে ‘ভারতরত্ন’ দিয়ে ফায়দা নিতে মোটেও বিলম্ব করেনি। কিন্তু এখন তিনি আপত্তিকর হয়ে উঠেছেন। বেশ কয়েক বছর ধরে এমন চলছে। তাঁর অপরাধ কী, সেটা অনুমান করা কঠিন নয়।
নরেন্দ্র মোদির শাসনপদ্ধতি নিয়ে ভিন্নমত লুকিয়ে রাখতে পারেননি অমর্ত্য সেন। ভারতের উন্নয়নে কেরালার অবিজেপি বামপন্থী সরকারের উন্নয়ন মডেলে তাঁর পক্ষপাত। তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সেসব ভিন্নমত আরএসএসবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের কাজে লাগে। সেই সূত্রে অমর্ত্য সেনের জমির মোকদ্দমা এখন বিজেপি বনাম অন্যদের ‘খেলা’র অংশ হয়েছে বা হবে। কিন্তু মাঝখানে ৮৯ বছরে এসে এই নোবেলজয়ীকে চরম বিড়ম্বিত পরিস্থিতিতে পড়তে হলো।
পাকিস্তানে আবদুস সালাম ভিন্নধাঁচের বিড়ম্বনার আভাস পেয়ে ৬৮ বছর বয়সে দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। পরে তাঁর মৃতদেহ কেবল দেশে ফেরে। মিয়ানমারে সু চির পক্ষে পালানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু এখন তাঁর বার্ধক্যও প্রতিপক্ষের কাছ থেকে ছাড় পাচ্ছে না। লিউ শিয়াবো বাঁচতেই পারেননি। মালালাকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে আধা গোপন, আধা প্রকাশ্য এক জীবনে। সেন পরিবারের বসতভিটাও হয়তো ‘উদ্ধার’ করে নেবে সে দেশের কেন্দ্রীয় সরকার।
নোবেল পুরস্কার পাওয়া ভিন্নমতাবলম্বীদের এ রকম পরিণতির বার্তাটি এত স্পষ্ট যে ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। একই সঙ্গে সেটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভবিষ্যতেরও স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, যা নুইয়ে চলাকে মানদণ্ড মানতে বলছে। কিন্তু এ অঞ্চলের নীতিনির্ধারকেরা যখন জ্ঞানভিত্তিক বহুত্ববাদী সমাজ গড়ার কথা বলেন, তার সঙ্গে এই নুইয়ে দেওয়ার চেষ্টা কতটা মানানসই?
আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক