‘নাই’ বলে দিলেই কি গেস্টরুমে নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলা যাবে

বছরের পর বছর ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গেস্টরুম, গণরুম নামে শিক্ষার্থীদের ওপর যে নিপীড়ন চলে আসছে, তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় দৃষ্টান্ত।

পাখিগোত্রীয় হয়েও উড়তে অক্ষম উটপাখি মরুঝড়ের সময় বালুতে ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকে। বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ত্রিশের পাঁচ কবির একজন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। আধুনিক মানুষের জীবনের এই বৈশিষ্ট্য তিনি ধরতে চেয়েছিলেন উটপাখির রূপকে। সুধীন্দ্রনাথ তাঁর ‘উটপাখি’ কবিতায় আধুনিক মানুষদের উদ্দেশে মোক্ষম এক প্রশ্ন দিয়েছিলেন—অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের বার্ষিক অধিবেশনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একজন শিক্ষক প্রতিনিধির ‘গেস্টরুম নির্যাতন’ নিয়ে দেওয়া বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করছেন। ভিডিওটা দেখে মাথার ভেতরে ‘অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে’—প্রশ্নটিই ঘুরছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষক নেতাদের ক্ষেত্রে উত্তরটি সম্ভবত হ্যাঁ বোধকই হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে অধিবেশনে কী ঘটেছিল, তার চিত্র পাওয়া যায় ২১ জুন প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘“গেস্টরুম নির্যাতনের” কথা বলায় বক্তব্য এক্সপাঞ্জ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে। সেই প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ‘বিএনপিপন্থী সাদা দলের আহ্বায়ক লুৎফর রহমান অধিবেশনের বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোয় ‘গেস্টরুম নির্যাতন’ নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, হলগুলোয় গেস্টরুমে ছাত্রদের নির্যাতন করা হয়, বিরোধী মতের ছাত্রদের এখানে দাঁড়াতে দেওয়া হয় না। এই গণতন্ত্র ও মূল্যবোধ নিয়ে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশেষ মর্যাদা দাবি করা যায়, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি।

বছরের পর বছর ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গেস্টরুম, গণরুম নামে শিক্ষার্থীদের ওপর যে নিপীড়ন চলে আসছে, তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় দৃষ্টান্ত। সবার চোখের সামনেই সেটা ঘটে চলেছে অথচ সম্মিলিতভাবে সবাই নীরব। শুধু নির্যাতনে আবরার ফাহাদ, হাফিজুলদের যখন মৃত্যু হয়, তখন সবাই  শোর তোলে। সম্মিলিত এই নীরবতা কি ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষকনেতাদের একটা জলজ্যান্ত সত্য অস্বীকার করার সুযোগ তৈরি করে দেয় না?

‘গেস্টরুম নির্যাতন’ নিয়ে লুৎফর রহমানের দেওয়া বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করার দাবি জানান নীল দলের সাবেক আহ্বায়ক মো. আবদুস ছামাদ। অধ্যাপক লুৎফরের বক্তব্য নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান শিক্ষক সমিতির সভাপতি নিজামুল হক ভূঁইয়া ও শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রাধ্যক্ষ আবদুর রহিমও। রহিম বলেন, ‘অছাত্রদের হলে থাকার সুযোগ নেই। আমি একটি হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্বে আছি। ছাত্ররা কেউ কখনো আমার কাছে অভিযোগ করেনি যে তারা হলে থাকতে পারছে না। অছাত্র-অপরাধীরা তো ক্যাম্পাসে আসতে পারার কথা নয়। হল নিয়ে ভুল স্টেটমেন্ট দেওয়া হচ্ছে।’
লুৎফর রহমানের বক্তব্যকে ক্যাম্পাসের ‘নেতিবাচক চিত্রায়ণ’ বলে আখ্যা দিয়ে উপাচার্য বলেন, ‘এটি খুবই অসত্য। এসবের সঙ্গে আমরা পরিচিত নই। গেস্টরুমে অতিথিরা আসেন, বসেন।’

অতিথিকক্ষে ‘গেস্টরুম কর্মসূচি’। চেয়ারে বসা ছাত্রলীগের কর্মীরা (দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তাঁরা)। সামনে দাঁড়ানো প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। ২০১৯ সালে কবি জসীমউদ্‌দীন হলের অতিথিকক্ষে
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতির নেতাদের বক্তব্য থেকে মনে হচ্ছে, গেস্টরুম নির্যাতন বলে আদতেই কিছু নেই। তাঁরা এটিকে বলছেন, ভুল স্টেটমেন্ট, খুবই অসত্য, নেতিবাচক চিত্রায়ণ, এসবের সঙ্গে আমরা পরিচিত নই। তাঁদের ভাষ্যে, গেস্টরুম মানে সত্যি, সত্যি, তিন সত্যি- যেখানে অতিথিরা আসেন ও বসেন।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বক্তব্য খারিজ করে দিতে গিয়ে গত চার দশকে এ পর্যন্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় ক্ষতের জায়গাটিকে গায়ের জোরে অস্বীকার করা হলো।

গত চার দশকে গ্রাম থেকে, মফস্বল থেকে আমরা যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছি, হলে থেকেছি—গেস্টরুমে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের কাছে শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়নি—এমন ভাগ্যবান কাউকে কি পাওয়া যাবে? আমরা কি আমাদের গায়ে, আমাদের হৃদয়ে সেসব নিপীড়নের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছি না?

আরও পড়ুন

শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উদার একটা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা শিক্ষকেরা গেস্টরুমে নির্যাতন নেই বললেন আর সেটা নাই হয়ে গেল? গুগল সার্চ ইঞ্জিনে গেস্টরুম, গেস্টরুম নির্যাতন, গেস্টরুম সংস্কৃতি শব্দগুলো সার্চ দেওয়া যাক। গেস্টরুম শব্দের বিপরীতে ফলাফল আসছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার, গেস্টরুম নির্যাতন ২৩ হাজার ৮০০ ও গেস্টরুম সংস্কৃতি ২০ হাজার ২০০ বার। গুগল সার্চ ইঞ্জিনের একটার পর একটা পেজে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গেস্টরুমের নির্যাতনের সংবাদ উপচে পড়ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কি  গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের এই ফলাফলকে খুবই অসত্য, নেতিবাচক চিত্রায়ণ বলে এক্সপাঞ্জ করবেন? গত জানুয়ারি মাসে প্রথম আলো ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেনকে প্রশ্ন করেছিল, গার্ডরুম ও গণরুম বন্ধের ব্যাপারে তাঁর সংগঠনের অবস্থান কী? উত্তরে তিনি দায়টা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। এবারে উপাচার্য ও প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা শিক্ষকেরা গেস্টরুম নির্যাতনকে হাওয়া করে দিলেন।

যে প্রভোস্টরা জোর গলায় বলছেন, তাঁদের হলে গেস্টরুমে নির্যাতনের কোনো ঘটনার অভিযোগ নেই, তাঁদের খুব সবিনয় একটা প্রশ্ন করতে চাই, ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে তাঁরা কি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সিট বরাদ্দ দিতে পারেন? হলে হলে গণরুম ও রাজনৈতিক কক্ষের নামে মফস্বল থেকে আসা অসহায় শিক্ষার্থীদের জোর করে ছাত্রসংগঠনের সদস্য বানানোর যে প্রক্রিয়া জারি আছে, সেটাকেও তাঁরা নিশ্চয়ই দেখতে পান না।

আরও পড়ুন

বিশ্ববিদ্যালয় ধারণা আর স্বায়ত্তশাসনের ধারণা সমান বয়সী। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে পাকিস্তানি সামরিক শাসক আইয়ুব খান বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ করে বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার আয়োজন করেছিলেন। এর বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সামনে থেকে আন্দোলন করেছিলেন। এর ফলে ’৭৩-এর অধ্যাদেশে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার পেয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়।

দুঃখজনক সত্য হলো, দীর্ঘ স্বৈরশাসনের পর ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক শাসনের শুরুতেই শিক্ষকনেতারা তাঁদের স্বায়ত্তশাসনকে রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছে সঁপে দিয়েছিলেন। এক পক্ষ ভিড়ে গিয়েছিলেন বিএনপিতে, অন্য পক্ষ আওয়ামী লীগে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নয়, দলীয় রাজনৈতিক পরিচয়ই এখন তাদের কাছে মুখ্য পরিচয়। অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি—এই পরিচয় সামনে আনার মূল কারণ।

আরও পড়ুন

বছরের পর বছর ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গেস্টরুম, গণরুম নামে শিক্ষার্থীদের ওপর যে নিপীড়ন চলে আসছে, তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় দৃষ্টান্ত। সবার চোখের সামনেই সেটা ঘটে চলেছে অথচ সম্মিলিতভাবে সবাই নীরব। শুধু নির্যাতনে আবরার ফাহাদ, হাফিজুলদের যখন মৃত্যু হয়, তখন সবাই  শোর তোলে। সম্মিলিত এই নীরবতা কি ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষকনেতাদের একটা জলজ্যান্ত সত্য অস্বীকার করার সুযোগ তৈরি করে দেয় না? সাদা দলের যে শিক্ষকনেতা আজ গেস্টরুম নির্যাতনের প্রশ্ন তুলেছেন, বিএনপি আমলে গেস্টরুম, গণরুমের নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটনা নিয়ে তিনি কখনো কথা বলেছেন? এ ক্ষেত্রে দুই দলের শিক্ষক নেতাদের মধ্যেই দারুণ ঐকমত্য চলে আসছে।  

  • মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী