৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের অনেক থানায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। আরও হামলার আশঙ্কায় ১১ দফা দাবি দিয়ে প্রায় সব পুলিশ সদস্য কর্মস্থল ছেড়ে জীবন বাঁচাতে আত্মগোপনে চলে যান। পুলিশের এমন করুণ ও অসহায় দশা আগে কখনো দেখা যায়নি।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে। সড়ক ও মহাসড়কে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়।
পরিস্থিতি সামলাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেন। ডাকাত মোকাবিলায় বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীরা দলবদ্ধ হয়ে রাতে পাহারা দেন। আন্দোলনকে স্মরণে রাখতে বিভিন্ন সড়কে নকশা আঁকেন, দেয়ালে গ্রাফিতি করেন। স্লোগান আর নানা বাক্যে ভরিয়ে দেন দেয়ালের পর দেয়াল।
বিভিন্ন স্থানে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। এরই মধ্যে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লাসহ বিভিন্ন এলাকায় ভয়াবহ বন্যায় বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণির–পেশার মানুষ।
বানভাসি মানুষের জন্য তাঁদের প্রাণান্ত চেষ্টা ও সাধারণ মানুষের আর্থিক সহযোগিতার যে নিদর্শন আমরা দেখেছি, তা অন্য বাংলাদেশ বিনির্মাণেরই একটি প্রতিচ্ছবি।
সম্প্রতি সুনামগঞ্জ জেলা ওষুধ তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয় থেকে ড্রাগ লাইসেন্স নিতে আসা কয়েকজনের কাছ থেকে ঘুষের টাকা নেন কার্যালয়টির অফিস সহকারী মো. ফাহিম মিয়া। খবর পেয়ে ১৬ আগস্ট শিক্ষার্থীরা ওই কার্যালয়ে গিয়ে ঘুষের ১০ হাজার টাকাসহ হাতেনাতে আটক করেন ওই অফিস সহকারীকে। (তথ্যসূত্র: প্রথম আলো অনলাইন)।
ভবিষ্যতেও শিক্ষার্থীদের এমন তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে। প্রতিটি শহর, গ্রাম, পাড়া-মহল্লায় শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদল থাকতে হবে। কোথাও কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি, অন্যায়-অনাচার, সংকট ও দুর্যোগের খবর পেলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতেও ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আর যেন কোনো দিন নষ্টদের দখলে প্রিয় বাংলাদেশ যেতে না পারে, সে জন্য তাঁদের তৎপর থাকতে হবে। তবে এটিও খেয়াল রাখতে হবে আইন কোনোভাবে নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। ‘মব জাস্টিস’কে কোনোভাবে বৈধতা দেওয়ার সুযোগ নেই।
শিক্ষার্থীদের এত এত ভালো কাজের মধ্যে একশ্রেণির তরুণ-যুবক ঢুকে তা কলুষিত করার চেষ্টা করছে। শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারিও করছে কোনো কোনো চক্র। এখানে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আসছে আমরা দেখছি।
প্রত্যেকেই যদি প্রত্যেকের পরিবার সংস্কার করতে পারি, তবে তখন সমাজ ও রাষ্ট্র সংস্কার হতে বাধ্য। আর সেই সংশোধিত রাষ্ট্রে সুশাসন ও আইনের শাসন নিশ্চিত করা সহজ হবে। ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত হয়ে বাংলাদেশ তর তর করে উন্নত দেশের পথে এগিয়ে যাবে।
সম্প্রতি ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে তরুণ-যুবকদের একটি চক্র বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও সহসমন্বয়কের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি ও অর্থসংগ্রহ করে। এমন তথ্য পেয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহসহ অন্যরা গিয়ে হাতেনাতে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকাসহ কয়েকজনকে আটক করেন। দুষ্কৃতকারীদের এসব কর্মকাণ্ডের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সতর্ক থাকতে হবে।
সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। বিগত সরকার দলের সংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি আক্রান্ত হয়েছেন সংখ্যালঘু মানুষেরাও। পূর্ববিরোধ বা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের জেরেও খুনের ঘটনা ঘটেছে। আদালত চত্বরে বিভিন্ন মামলার আসামির ওপর হামলা, কিল-ঘুষি ও লাথি মারার ঘটনা ঘটেছে।
এসব ঘটনায় জড়িতদের বিচারের জন্য শিক্ষার্থীদেরই আওয়াজ তুলতে হবে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানকে ঘিরে ধরে পদত্যাগে বাধ্য না করে আইন ও বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
ইতিমধ্যে পুলিশ সদস্যরা কর্মস্থলে ফিরেছেন। তাঁরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব পালন করছেন। অফিস, আদালত, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যথারীতি চলছে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের এবার নিজ নিজ পরিবার সংস্কারে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
রাষ্ট্র সংস্কারে ভূমিকা রাখার পর এখন যাঁর যাঁর পরিবার সংস্কার করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত লোকজন কারও না কারও পরিবারের সদস্য।
গত পনের বছর ধরে এই রাষ্ট্রে নানাভাবে নৈরাজ্য, লুটপাট হয়েছে। ঘুষ-দুর্নীতি ও অর্থ কেলেঙ্কারি হয়েছে। আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি হয়েছে উপেক্ষিত। বিরোধী মত-পথের লোকজন দমন-পীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
বিভিন্ন বন্দিশালা ও আয়নাঘরে রেখে পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে। এসব ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ভিন্নগ্রহের কেউ জড়িত নন। যাঁরা জড়িত, তাঁরা আমাদের দেশেরই মানুষ। তাঁরা কোনো না কোনো শিক্ষার্থীর বাবা-মা, ভাই-বোন বা কোনো স্বজন।
জেন-জি (১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যাদের জন্ম) প্রজন্মের কিশোর-তরুণদের এখনই সময় নিজ নিজ পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের পারিবারিক জবাবদিহির আওতায় আনা।
বাবা কিংবা মায়ের আয়ের উৎসের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া। উপার্জনের সঙ্গে জীবনযাপনের খরচের সামঞ্জস্য আছে কি না, তা শিক্ষার্থীকে খতিয়ে দেখা। উপার্জনের সঙ্গে পরিবারের জীবনযাপন ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত হলে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে। বেতনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ কীভাবে তাঁর বাবা কিংবা স্বজন উপার্জন করছেন, সে বিষয়ে জানার চেষ্টা করতে হবে।
বাবা-মায়ের সঙ্গে এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। সতর্ক করতে হবে, সচেতন করতে হবে।
এ জন্য হয়তো কোনো কোনো শিক্ষার্থীর বিলাসবহুল জীবন কিংবা পারিবারিক প্রাইভেট কারে চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বাবা-মায়ের গালমন্দও শোনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। দু-এক বেলার জন্য ভাতও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
তারপরও আগামী দিনের আলোর পথের দিশারি ও নবদিগন্তের যাত্রী এই কিশোর-তরুণদের এসব প্রশ্ন তুলতেই হবে। পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতেই হবে। কেননা কয়েক শ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে নতুন স্বাধীনতা পেয়েছি, এই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে।
আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ইয়ামিনসহ অসংখ্য শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না। আমরা যে পণ করেছি রাষ্ট্র সংস্কারের। এ জন্য সবার আগে নিজেকে সংস্কার করতে হবে। এরপর করতে হবে পরিবার ও স্বজনদের সংস্কার।
প্রত্যেকেই যদি প্রত্যেকের পরিবার সংস্কার করতে পারি, তবে তখন সমাজ ও রাষ্ট্র সংস্কার হতে বাধ্য। আর সেই সংশোধিত রাষ্ট্রে সুশাসন ও আইনের শাসন নিশ্চিত করা সহজ হবে। ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত হয়ে বাংলাদেশ তর তর করে উন্নত দেশের পথে এগিয়ে যাবে।
প্রাণ-প্রকৃতি নষ্ট করে, মানুষের অধিকার-স্বাধীনতা হরণ করে ও খুন-গুম করে উন্নয়নের যে মডেল দাঁড় করানো হয়েছিল, তা আমরা চাই না। ভুলে গেলে চলবে না, মানুষের জন্যই সমাজ ও রাষ্ট্র। কিন্তু আমাদের দেশে হয়েছিল উল্টোটা, যেন সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যই মানুষ। আমরা এমন উদ্ভ্রান্ত উন্নয়ন চাই না। তরুণদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে প্রাণ-প্রাচুর্য ও সৌহার্দ্যপূর্ণ এক অবিশ্বাস্য উন্নত বাংলাদেশ দেখতে চাই।
তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোর সহসম্পাদক
towhidul.islam@prothomalo. com