ন্যাটো যদি ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর ব্যাপারে এতটাই বিরোধী হয়, তাহলে কেন দেশটিতে তাদের যেসব সেনা অবস্থান করছেন, তাঁদের দেশে ফেরত আনছে না?
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বলেছেন, জার্মান সরকার ইউক্রেনে দূরপাল্লার টরাস ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দেবে না। কেননা এই ক্ষেপণাস্ত্র দিতে গেলে সেটা পরিচালনার জন্য ইউক্রেনে জার্মান সেনা পাঠাতে হবে। ব্রিটিশরা যেমন স্ট্রম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র পরিচালনার জন্য তাদের সেনাদের ইউক্রেনে পাঠিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তারা বলছেন, এ বক্তব্য দিয়ে জার্মান চ্যান্সেলর মোটেই ঠিক করেননি। তাঁরা বলছেন, এটা ঘোরতর গোয়েন্দাবৃত্তি। কিন্তু ওলাফ শলৎজ এখন যেটা প্রকাশ্যে নিশ্চিত করলেন (ন্যাটোর সেনারা অস্ত্র পরিচালনা ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ইউক্রেনে রয়েছেন), গোয়েন্দা চ্যানেলে সেটা সবাই জানতেন।
ইউক্রেনে ন্যাটোর কতজন সৈন্য ও কর্মকর্তা রয়েছেন, তার প্রকৃত তথ্য জানা যায় না। কিন্তু এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে সংখ্যাটা অনেক। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স পোল্যান্ড, কানাডা ও অন্য সব দেশ থেকে তাঁরা এসেছেন।
এসব ‘স্বেচ্ছাসেবকদের’ অনেকেই যখন মারা যান ও আহত হন, তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের সমাজকর্মী অথবা চিকিৎসাকর্মী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। তবে অতি সম্প্রতি অন্তত যুক্তরাষ্ট্র তাঁদের লড়াইয়ের সেনা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
২৯ ফেব্রুয়ারি ভ্লাদিমির পুতিন জাতির উদ্দেশে দুই ঘণ্টা ধরে তাঁর বাৎসরিক বক্তৃতা দেন। বক্তৃতায় তিনি সতর্ক করেন যে ন্যাটো যদি ইউক্রেনে সেনা পাঠায়, তাহলে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি হবে। রাশিয়ার জয়রথ ঠেকাতে প্রয়োজনে ন্যাটো ইউক্রেনে সেনা পাঠাবে—ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর এই বক্তব্যের জবাবে পুতিন এই হুমকি দেন।
যদিও মাখোঁর এই বক্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের মধ্যে কোনো আলোড়নই তুলতে পারেনি। কিন্তু ইইউর মতো ফোরামে খোলাখুলিভাবে এ ধরনের বক্তব্য আসায় তা অনিবার্যভাবেই রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপীয় সংস্থার বড় উত্তেজনার কারণ হয়ে উঠেছে।
কিছু কিছু সময় ইউক্রেন সংঘাতে ন্যাটো উত্তেজনার পারদ চড়িয়েছে। এর কারণ হলো, ধারণা করা হয় যে ইউক্রেনের ভূখণ্ড থেকে রাশিয়ানদের হটিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ইউক্রেনীয়দের সহায়তা দিচ্ছে তারা।
পুতিনকে হত্যার অনেকবার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। এর একটি ঘটেছে সম্প্রতি। ক্রেমলিনে তাঁর কার্যালয়ে ড্রোন হামলা হয়েছে। আরেকটি প্রচেষ্টা চালানো হয় ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর ছয় বছর আগে। পুতিনের লিমো গাড়ি মস্কোর রিং রোডে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এই দুর্ঘটনায় তাঁর চালক নিহত হন। ভাগ্যচক্রে পুতিন সেই গাড়িতে ছিলেন না।
যা–ই হোক, এ পর্যন্ত যেসব প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে করে ন্যাটো তাদের সেনাদের ঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা করছে এবং রাশিয়ার দিকে তাদের অস্ত্র তাক করতে চাইছে। নিউইয়র্ক টাইমস–এর সূত্রমতে, ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তে সিআইএ ১২টির মতো ঘাঁটি করেছে।
একই সঙ্গে ন্যাটো খুব শক্তভাবেই মস্কোয় সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করে চলেছে। ওয়ারইড ম্যাগাজিন সম্প্রতি জানিয়েছে যে পুতিনের অবস্থান শনাক্ত করার জন্য তাঁর কর্মচারী ও সহকর্মীদের ফোন ট্র্যাক করার বিশেষ প্রযুক্তির উন্নয়ন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
যা হোক, এ তথ্যের মূল্য ততক্ষণ পর্যন্ত সামান্য, যতক্ষণ পর্যন্ত না পুতিনকে খুন করার উদ্দেশ্যে তা ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রকৃত বাস্তবতা হলো, ইউক্রেনীয়দের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো রাশিয়ান নেতা ও তাঁর সেনাবাহিনীর কমান্ডারদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য গভীরভাবে কাজ করে চলেছে। এর মানে হচ্ছে, তাদের কাছে যুদ্ধক্ষেত্রে জয়ের চেয়ে রাশিয়ার সরকার পরিবর্তন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড সম্প্রতি বলেছেন, ‘পুতিনের রাশিয়া আমরা যে রাশিয়া চাই, সেটা নয়।’
পুতিনকে হত্যার অনেকবার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। এর একটি ঘটেছে সম্প্রতি। ক্রেমলিনে তাঁর কার্যালয়ে ড্রোন হামলা হয়েছে। আরেকটি প্রচেষ্টা চালানো হয় ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর ছয় বছর আগে। পুতিনের লিমো গাড়ি মস্কোর রিং রোডে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এই দুর্ঘটনায় তাঁর চালক নিহত হন। ভাগ্যচক্রে পুতিন সেই গাড়িতে ছিলেন না।
রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি প্রায়ই নিষ্ঠুর। খুনোখুনিও সেখানে ঘটে। এরপরও পুতিন ন্যাটো নেতাদের সঙ্গে কিংবা ইউক্রেনীয় নেতাদের সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারে খুবই সতর্ক।
এদিকে পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থা, থিঙ্কট্যাংকগুলো বলছে, ইউক্রেনের পরিস্থিতি খুব খারাপ এবং তিন মাসের মধ্যে ইউক্রেন পরাজয়ের মুখে পড়তে পারে। আর এ পরিস্থিতিকে ইউরোপীয়রা সতর্কঘণ্টা হিসেবে দেখছে। প্যারিসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জরুরি সভা ডাকার পেছনে প্রকৃত কারণ এটাই।
সেই সভায় মনে হয়েছিল যে ইউরোপের নেতারা কিয়েভকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দেওয়ার ব্যাপারে অঙ্গীকার করেছেন। কিন্তু জার্মান চ্যান্সেলরের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট হলো যে তাঁরা ইউক্রেনকে টরাস ক্ষেপণাস্ত্র দিতে চান না। রাশিয়ার দিক থেকে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হবে, সেই ভয় পেয়েছে জার্মানি।
ইউক্রেন নিয়ে ন্যাটোর নীতি জরুরি ভিত্তিতে পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। ন্যাটো যদি প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর বিরোধী হয়, তাহলে ইউক্রেনের ভূখণ্ডে তাদের যে সেনা অবস্থান করছে, তাদের ব্যাপারে অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
ইউক্রেনে স্ট্রম শ্যাডো মিসাইল পরিচালনা করছেন ব্রিটিশ সেনারা, এটা বলে ওলাফ শলৎজ থলের বিড়াল বের করে দিয়েছেন। গোয়েন্দা চ্যানেলে এত দিন যে বিষয় সীমাবদ্ধ ছিল, এখন সেই সত্য প্রকাশ্যে চলে এল।
ন্যাটো নিজেই কোনোভাবেই রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত নয়। ইউক্রেন সংঘাত শুরুর আগে তাদের যে শক্তিসামর্থ্য ছিল, এখন সেটা অনেকটাই কমেছে। আরও শোচনীয় বিষয় হচ্ছে, ন্যাটোর বর্তমান ও সাবেক অনেক নেতা একের পর এক গরম বক্তব্য দিয়ে উত্তেজনার পর উত্তেজনা ছড়িয়ে চলেছেন। রাশিয়ার দিক থেকে তথাকথিত ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্র দূরে থাক, প্রথাগত আক্রমণ এলেও সেটা প্রতিরোধের সক্ষমতা ন্যাটোর নেই।
স্টিফেন ব্রায়েন ইয়র্ক টাউন ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত