যে সময় দেশ সাফজয়ী নারী ফুটবল দলের সফলতায় আনন্দের জোয়ারে ভাসছে, ঠিক সেই সময় ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীদের ন্যক্কারজনক ঘটনা যেন জাতির জন্য স্বপ্নভঙ্গ। বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ, পত্রিকা ও সম্প্রচার মাধ্যমের খবর, ইডেন কলেজের ছাত্রীদের সাক্ষাৎকার এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অনেক পোস্ট থেকে এটা স্পষ্ট যে ছাত্ররাজনীতির নামে সেখানে দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসছে এক অরাজকতা।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে উঠে এসেছে অত্যাচার, চাঁদাবাজি, সিট বাণিজ্য এবং যৌন নিপীড়নের মতো অভিযোগ। এই অত্যাচার ও নিপীড়নের রোমহর্ষক কাহিনি যেন ক্রাইম মুভির চিত্রনাট্যকেও হার মানায়। না জানি দেশের দূরদূরান্ত থেকে আসা কত শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন এই ধরনের নিপীড়নের কালো মশালে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে! আহারে স্বপ্ন! আহারে উচ্চশিক্ষা!
অনেকেই মন্তব্য করেছেন, মেয়েরা কেন এই ধরনের আচরণ করবে। মেয়েদের এসব করা শোভা পায় না। আপনি যখন এই ধরনের মন্তব্য করেন, তখন একদিকে আপনি যেমন নারী শিক্ষার্থী বলে একজন নারীর কী করা উচিত বা উচিত নয়, সেই সীমা বেঁধে দিচ্ছেন, অন্যদিকে একজন পুরুষ শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে একই অপরাধের বৈধতা দিচ্ছেন। অপরাধীর কোনো দেশ, জাত কিংবা লিঙ্গ নেই। তাই আমি মনে করি, ধূমপান কিংবা মদ্যপান যেমন নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ক্ষতিকর এবং একইভাবে উভয়েরই জন্যই বর্জনীয়, তেমনি সাধারণ শিক্ষার্থীর ওপর কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর অত্যাচার ও নিপীড়ন নিন্দনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ক্ষেত্রে নিপীড়কের লৈঙ্গিক পরিচয় মুখ্য নয়।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বকে তাঁর লৈঙ্গিক পরিচয় দিয়ে বিবেচনা করা হয় না। ফুটবল, ক্রিকেট কিংবা জিমন্যাস্টিকসে খেলার নৈপুণ্য ও দক্ষতা খেলোয়াড়ের লৈঙ্গিক পরিচয় দিয়ে বিচার করা হয় না। একইভাবে ইডেন কলেজের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অসদাচরণকে আমি কোনো নারীর অপকর্ম হিসেবে না দেখে ছাত্ররাজনীতির নামে এক অপসংস্কৃতির চর্চা হিসেবে দেখছি। কতিপয় ছাত্র নামধারী শিক্ষার্থীর অছাত্রসুলভ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে দেখছি। গণিতের পরিভাষায় ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ যদি একটা ফুল সেট হয়, ‘ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ’ তার একটা উপসেট বৈ অন্য কিছু নয়।
ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতাদের হাতে সাধারণ শিক্ষার্থীর নিপীড়নের চিত্র এটাই প্রথম নয়। ইতিপূর্বে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন ছাত্রদলের নেতা-কর্মীর হাতে সাধারণ শিক্ষার্থীর নির্যাতনের কাহিনি; ছাত্রশিবির কর্তৃক সাধারণ ছাত্রদের ওপর নিপীড়নের নির্মম কাহিনিও পত্রপত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়েছে। কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া বুয়েটের আবরার হত্যাকাণ্ড এবং সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করার কথা আমাদের মনে আছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ কেলেঙ্কারি এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অপসারণ, প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা কর্তৃক ছাত্রলীগকে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন থেকে বাদ দিয়ে একটি সহযোগী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার বিষয়টিও জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। ইডেন কলেজের এই ঘটনা ছাত্ররাজনীতির নামে ক্ষমতার অপচর্চা এবং অর্থ উপার্জনের অবৈধ পন্থাকে উপজীব্য করে নির্মিত ধারাবাহিক নাটকের এক নতুন পর্ব মাত্র।
বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি যেন ছাত্রদের জন্য আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার দ্রুত ও সহজতম উপায়। আর তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্র নামধারী অছাত্র যেমন পদ অলংকৃত করে আছে, তেমনি একই পদে বহাল থাকার জন্য বছরের পর বছর ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখার মানসিকতাও তাঁদের মধ্যে লক্ষণীয়
প্রতিটা দলেই একটি চেইন অব কমান্ড থাকে। প্রতিটা দলের তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে যেমন কেন্দ্রীয় কমিটির ভূমিকা আছে, তেমনি একটি ছাত্রসংগঠন কীভাবে পরিচালিত হবে, সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ নেতা-কর্মীদের কর্মকাণ্ড বিবেচনা, তাঁদের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রয়োজনে পদ বিলুপ্তি এবং দল থেকে বহিষ্কার ইত্যাদি ব্যবস্থাও দলের গঠনতন্ত্রে আছে। যেহেতু ইডেন কলেজের এই ছাত্রলীগের কমিটি দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো কমিটি নয়, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ এবং ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট নেতারা এই দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না।
দেশে অবস্থিত সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সংখ্যা থেকে স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা যায় দেশে প্রতিবছর কয়েক লাখ গ্র্যাজুয়েট উচ্চশিক্ষার সনদ নিয়ে চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। ১৬ বা ১৭ বছর অধ্যয়নের পর যখন তাঁরা চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন, তখন উপলব্ধি করেন প্রতিটি পদের বিপরীতে প্রতিযোগীর সংখ্যা অনেক গুণ বেশি।
অনেকেই সেই প্রতিযোগিতায় জয়ী হন, বেশির ভাগের ভাগ্যেই জুটে এক বুক হতাশা। সুতরাং চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা করার মতো কঠিন পদ্ধতির চেয়ে যদি অধিকতর সহজ উপায়ে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়, তাহলে সেই পথ বেছে নেওয়াই উত্তম। বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি যেন ছাত্রদের জন্য আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার দ্রুত ও সহজতম উপায়। আর তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্র নামধারী অছাত্র যেমন পদ অলংকৃত করে আছে, তেমনি একই পদে বহাল থাকার জন্য বছরের পর বছর ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখার মানসিকতাও তাঁদের মধ্যে লক্ষণীয়। ছাত্ররাজনীতির এই অবস্থার জন্য আমাদের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা যেমন দায়ী, একইভাবে দায়ী একটা অপরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থাও।
৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জাতীয় সংসদের অনেক বর্ষীয়ান সংসদ সদস্য ছাত্ররাজনীতির মধ্য দিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। কিন্তু ছাত্ররাজনীতি এখন পথভ্রষ্ট। এখন ছাত্রনেতা মানেই যেন সাধারণ শিক্ষার্থীর জন্য এক আতঙ্কের নাম, সিট-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, র্যাগিং, গেস্টরুম ইত্যাদি পাওয়ার পলিটিকসের নামান্তর। এমতাবস্থায় ছাত্রদের শিক্ষায় মনোযোগী করতে হলে হয় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে অথবা ছাত্ররাজনীতির নামে এই অনাচার কঠোর হাতে দমন করতে হবে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে দুষ্ট গরু লালন করার চেয়ে গোয়াল শূন্য রাখার পক্ষপাতী। আমার মতে, একজন ছাত্রের প্রথম ও প্রধান কাজ হলো পড়াশোনা করা, নিজেকে ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত করা। আপনি হয়তো বলবেন টারশিয়ারি লেভেলের শিক্ষার্থীরা প্রাপ্তবয়স্ক; ভোটাধিকারের মতো রাজনীতিও তাঁদের অধিকার। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে রাজনীতি একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্রের ওপর অধিকার। কিন্তু সেই রাজনৈতিক অধিকার সংরক্ষণ করতে গিয়ে যদি জাতিকে একটা প্রজন্ম হারিয়ে ফেলতে হয়, তাহলে সেই রাজনীতি কেন চলতে দেওয়া হবে?
শরীরের কোনো অংশে যখন ক্যানসার দানা বাঁধে তখন মানুষটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সেই ক্যানসারআক্রান্ত অংশকে কেটে বাদ দেওয়া হয়। দেশের ছাত্ররাজনীতি এখন ক্যানসার দ্বারা আক্রান্ত। একটা প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এই ক্যানসারে আক্রান্ত অংশ কেটে বাদ দিতে হবে।
ইডেন কলেজের ঘটনায় যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে অভিযোগ করা প্রতিটি অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। অভিযোগ যদি সত্যি প্রমাণিত হয়ে থাকে, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগসহ দলের অন্যান্য নেতা-কর্মীদেরও জবাবদিহির আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। সাধারণ শিক্ষার্থীর যে আর্থিক এবং মানসিক ক্ষতি হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ সাপেক্ষে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। যেকোনো মূল্যে শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমে ফিরিয়ে আনতে হবে।
একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যখন ছাত্রদের জন্য বিদ্যা অর্জনের মাধ্যম না হয়ে ক্ষমতার চর্চা আর অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হয়ে উঠে, তখন বুঝতে হবে সেই প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ সংকটাপন্ন। প্রাকৃতিক সম্পদে অপ্রতুল অল্প আয়তনের দেশে বিপুল জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে পরিণত করতে হলে উচ্চমানের শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগ সরকার ইতিমধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলা, বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ থেকে শুরু করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ করে সারা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ পৃথিবীর বিস্ময়। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই আবারও এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে দেশ এবং জাতিকে এই সংকট থেকে রক্ষা করবেন। ইডেন কলেজ আবার তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে। আমাদের ছেলেমেয়েরা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জন করে ভবিষ্যতে দেশ এবং জাতিকে নেতৃত্ব দেবেন। তাঁরাই গড়ে তুলবে এক সোনার বাংলাদেশ।
নাসরীন সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও, কানাডা
Email: [email protected]