‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার; লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার; ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ (‘আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নাই, আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; আর আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা।’)
ঈদের প্রভাতে ঈদগাহমুখী মুসল্লিদের মুখে স্বগতোক্তির মতো এই ধ্বনি উচ্চারিত হয়। আল্লাহ পাকের একটা বড় ইবাদাত এক মাস রোজা পালন করার তৌফিক পেয়েছি বলে আমরা মহাখুশি; এর মধ্য দিয়ে আমরা তারই শোকর আদায় করে থাকি।
ঈদুল ফিতরের দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় করা। এ জন্যই ঈদের নামাজকে সলাতুশ শোকর বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নামাজ বলা হয়।
মুমিন বান্দার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ইবাদতের মাধ্যমে। আমাদের আনন্দ–উৎসব সবই ইবাদাত। এতে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ রয়েছে। এ কারণে ঈদ পালন করতে হবে আল্লাহর বিধান ও রাসুল (সা.)–এর নির্দেশিত সুন্নত নিয়মের মাধ্যমে। ঈদে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের সব ক্ষেত্রে ইসলামি আদর্শ ও সুন্নত অনুসরণ করতে হবে।
রাসুলে করিম (সা.) বলেন: ‘রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দের মুহূর্ত আছে। একটি হলো, যখন সে ইফতার করে; দ্বিতীয়টি হবে যখন সে তার মাবুদ আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে।’
দীর্ঘ এক মাস রমজানের প্রশিক্ষণের পর ঈদের দিন পুরস্কার প্রদানের দিন। তাই ঈদের আনন্দ ছোট–বড়, ধনী–গরিব সবার জন্য সমান উপভোগ্য।
৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে রবিউল আউয়াল মাসে নবুওয়াতের ১৩তম বছরে ৫৩ বছর বয়সে আল্লাহর হুকুমে সত্য ধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রিয় জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে হিজরত করে মদিনা মুনাওয়ারায় চলে যান।
মদিনাবাসী শান্তিকামী নিরীহ জনগণ খাজরাজ বংশীয় পৌত্তলিক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবায় ইবনে সালুলের জন্য নবনির্মিত স্বর্ণমুকুটটি নবীজি (সা.)–এর পদপ্রান্তে উৎসর্গ করে। মানবতার বন্ধু গরিবের দরদি নবীজি (সা.) সে মুকুট মাথায় ধারণ না করে, তা বিক্রয় করে দুস্থদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। এটি ছিল মদিনার হতদরিদ্র জনগণের প্রথম ঈদ-আনন্দ।
রাসুল (সা.) মদিনায় নানা ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের লোকদের নিয়ে একটি বহুজাতিক আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এই রাষ্ট্রের সংবিধান মদিনা সনদ নামে পরিচিত, যা পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান।
হিজরতের দ্বিতীয় বছর রোজা ফরজ হয়। রমজানের চাঁদ ওঠে। নবুওয়াতের বর্ষপূর্তি, কোরআন নাজিলের বর্ষপূর্তি; রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত প্রাপ্তির আশায় ও তাকওয়া অর্জনে মুসলমানরা সবাই মশগুল। জান্নাতের দরজা খোলা, জাহান্নামের দরজা বন্ধ। সুশীলেরা আনন্দিত, অশীলেরা হতাশাগ্রস্ত। জিন–শয়তান শৃঙ্খলিত। কিন্তু মানুষ শয়তান ও নফসে আম্মারা শয়তান অপকর্মে লিপ্ত।
মদিনায় মানবিক রাষ্ট্রের সহাবস্থান, শান্তি ও স্থিতিশীলতা খোদাদ্রোহী মানবতাবিরোধী শক্তি মেনে নিতে পারে না। তারা নবী করিম (সা)–এর পিছু ছাড়ল না। মুকুট হারানোর বেদনায় প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবায় ইবনে সালুল। তারই প্ররোচনায় মুনাফিক চক্রের ষড়যন্ত্রে ও মদিনার মৈত্রী চুক্তি ভঙ্গকারী কিছু ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের গোপন মদদে মক্কার কুরাইশ পৌত্তলিকেরা হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে রমাদান মাসেই মদিনা আক্রমণ করে।
দ্বিতীয় হিজরি সনের ১৭ রমাদান ইসলামের প্রথম যুদ্ধ ও প্রথম জয় বদরের বিজয়ের ১৩ দিন পর হিজরি দ্বিতীয় বর্ষের ১ শাউয়াল ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ উদ্যাপিত হয়। একই বছর মদিনার ইহুদি সুদখোর মহাজন বনুকাইনুকা সম্প্রদায়কে পরাজিত করার পর দ্বিতীয় হিজরি সনের ১০ জিলহজ প্রথম ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ পালন করা হয়। অষ্টম হিজরি সনে ১৯ রমজান তারিখে ইসলামের শ্রেষ্ঠ বিজয়, মানবতার মহাজয় ও মক্কা বিজয় সংঘটিত হয়। সুতরাং শয়তানি শক্তির শৃঙ্খল থেকে মুক্তির আনন্দই প্রকৃত ঈদ–আনন্দ।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি
সহকারী অধ্যাপক: আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
[email protected]