ডোম, পুলিশ, পাবলিক এবং একটি লাশ

বছরখানেক আগের কথা। সিরাজগঞ্জের একটি স্টেশনে এসে ট্রেন থেকে নামলাম। তখনই বাথরুমের বেগ অনুভূত হলো। ছোট্ট স্টেশন ঘর। খুঁজতে খুঁজতে তার ভেতরেই ঢুকে গেছি।

বাথরুমের দরজা খোলা পেয়ে ঢুকতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় একজন নারী এসে বেশ বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘বাবা, পাবলিক টয়লেট ওই যে নিচে।’ তাঁর কথামতো বের হয়ে নিচের পাবলিক টয়লেটে গেলাম। দেখলাম, বেশ পরিপাটি নতুন টয়লেট। পরিষ্কার। হাত ধোয়ার সাবানও আছে। বাক্স নিয়ে এক কাকি বসে টাকা আদায় করছেন। শুধু টয়লেট ব্যবহারের বিল পাঁচ টাকা।

বের হয়ে আসতে আসতে দেখলাম টয়লেটের গায়ে লেখা রয়েছে, ‘পাবলিক টয়লেট’। তখন মনে হলো, আমারই বুঝতে ভুল হয়েছে, আমরা আসলে ‘পাবলিক’।

এর কিছুদিন পর রাজশাহীতে এক সরকারি অফিসে গেছি একটা কাজের জন্য। ওই অফিসে গিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। এর আগেও অনেকবার গেছি। সেবার গিয়ে দেখলাম, গ্রাউন্ড ফ্লোরে সেবাগ্রহীতাদের বসার জন্য সোফা পাতা হয়েছে। আগে এই ফ্লোরে পায়চারি করতে করতে পা ব্যথা হয়ে যেত। হঠাৎ সেখানে সোফা দেখে তাড়াতাড়ি গিয়ে বসার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠল। গা এলিয়ে বসে পড়লাম।

আমার পাশে বসেছেন অন্য একটি অফিসের প্রথম শ্রেণির একজন কর্মকর্তা। আয়েশ করে বসার কারণে মনের অজান্তেই কখন যে পায়ের ওপর পা তুলে ফেলেছি খেয়াল করিনি। কিছুক্ষণ পর একজন লোক এসে বললেন, ‘পা’টা নামিয়ে বসেন।’ আমি বললাম, ‘কেন?’ লোকটি জবাব দিলেন, ‘স্যার, ওপর থেকে সিসি ক্যামেরায় দেখতে পান। কেউ পায়ের ওপর পা তুলে বসলে স্যার মাইন্ড করেন, বকাবকি করেন।’

এসব কথা শুনে ভদ্রলোকের পরিচয় জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, তিনি এই প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারি করেন। ঠিকাদারের এই দায়িত্ববোধের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পা নামিয়ে বসলাম! কোনো বাক্য ব্যয় না করে আমার পাশে বসা কর্মকর্তা বেচারাও পা নামিয়ে বসলেন, কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না। তবে আমার সিরাজগঞ্জের পাবলিক টয়লেটের অভিজ্ঞতাটা মনে উঁকি দিল, আমরা আসলে ‘পাবলিক’।

এর কিছুদিন আগে আমার গ্রামের এক ছেলে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যায়। ছেলেটার মায়ের দাবি, তাঁর ছেলেকে হত্যা করে ট্রেনের নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আর এলাকাবাসীর মুখে মুখে একটি কথা প্রচার হয়েছিল, ছেলেটা ঋণের দায়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়েছে। তবে তার মা এ কথা মানতে নারাজ।

তাঁর ভাষ্য, ছেলেকে যখন মারা হয়, তখন সে মোবাইল ফোনে কথা বলেছিল এবং ছেলের কথা স্পষ্ট তিনি শুনতে পেয়েছেন, ‘মা, আমাকে ওরা মেরে ফেলল।’ ঘটনাটি ঘটেছে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী রেলওয়ে স্টেশনে।

যা–ই হোক, লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত যাওয়ার অভিজ্ঞতা এ রকম:  ঈশ্বরদী থেকে রেলওয়ে থানার পুলিশও এসেছে। লাশ গাড়িতে তোলা হলো। এখন ময়নাতদন্ত করার প্রয়োজনে পুলিশকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মর্গে যেতে হচ্ছে। তাঁরা দাবি করে বসলেন, তাঁদের তেল খরচ হবে ১ হাজার ৮০০ টাকা।

একে তো হতদরিদ্র পরিবার, তার ওপর সত্যিই যদি ঋণের দায় মরে থাকে তাহলে সেই পরিবার পুলিশকে টাকা দেবে কোত্থেকে। কিন্তু বোঝাতে পারলাম না। ছেলেটার আত্মীয়স্বজন আমাকে ধরলেন। একটা উপায় করে দিতে হবে। তাঁদের কাছে কোনো টাকাপয়সা নেই। মনে আছে, তখন নিজের পরিচয় দিয়ে ঈশ্বরদী রেলওয়ে থানায় ফোন করলাম। ভিকটিমের পরিবারের আর্থিক সংকটের কথা বুঝিয়ে বললাম। সব শুনে ওসি বললেন, ‘ঠিক আছে, টাকা দেওয়া লাগবে না, আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি।’

ফোন পেয়ে এক পুলিশ সদস্যকে অন্যদিকে তাকিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে শোনা গেল, ‘মানুষ মরে গেলেই সব শেষ। তার রেখে যাওয়া টাকাপয়সা-ধনসম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে আত্মীয়স্বজন ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার লাশটা যে সৎকার করা দরকার, তখনই তারা ভুলে যায়। এই তেল খরচের পয়সাটা আর বের করতে চায় না। এই হচ্ছে শালার “পাবলিক”।’

ময়নাতদন্তের সময় ডোমের গড়িমসি যায় না। একটু অনুরোধ করায় সিনিয়র একজন এসে বললেন, তাঁকে কিছু দিতে হবে না। সঙ্গে পাঁচটা ছেলে আছে তাঁদের পাঁচজনকে পাঁচ দিতে হবে। পাঁচ হাজার নাকি পাঁচ শ তা পরিষ্কার করে বললেন না।

এবার পুলিশ ডোমের ওপরে চটে গেলেন। ‘কেন টাকা নিতে হবে?’ ডোম পাল্টা উত্তরে বললেন, ‘আমরা কোনো বেতন পাই না, স্যার। ল্যাশের গারজেনরা (স্বজনেরা) যা দেয়, তাই দিয়ে আমরা চলি।’

এবার পুলিশ বললেন, ‘শালা ডোম, তোকে ২০ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হলেও তুই লাশের টাকা নিবি, তোরে চিনি না! দেশে যত ডিপার্টমেন্ট আছে, তার মধ্যে পুলিশই একমাত্র সততার সঙ্গে চাকরি করে। পুলিশের মতো সততার সঙ্গে কেউ চাকরি করে না’—বলে পুলিশ সদস্য আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুললেন। ডোম ততক্ষণে টাকার নিশ্চয়তা পেয়ে গেছে। তাই পুলিশের কথার কোনো জবাব দিতে গেল না।

একদিন লোকাল বাসে উঠেছি। দুই সিটের মাঝখানে কিছুতেই হাঁটু ঢোকানো যাচ্ছে না। কন্ডাক্টরকে বললাম। তিনি ঝাড়ি দিয়ে বললেন, ‘আপনারা আসলে বসতেই জানেন না। সব পাবলিককে বসার ট্রেনিং দেওয়া দরকার।’

পরে বিআরটিএ-তে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ‘জ’ সিরিজের গাড়িগুলো ৩১ আসনের। আর ‘ব’ সিরিজের গাড়িগুলো হয় ৫২ আসনের। ওই গাড়িটি ‘জ’ সিরিজের ছিল, কিন্তু আসন ছিল ৪৮টি। পাবলিক তো ‘ব’ আর ‘জ’ সিরিজের মাহাত্ম্য বোঝে না!

  • আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী