ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন সপ্তম মাসে প্রবেশ করেছে। এই সংঘাত শিগগিরই শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত যুদ্ধের যে গতিপ্রকৃতি, তাতে কৌশলের দিক থেকে এটি ‘বজ্রনির্ঘোষ যুদ্ধ’ বলেই ধারণা করা হচ্ছে। বলা চলে, সংক্ষিপ্ত, তীব্র ও নিষ্পত্তিমূলক এই যুদ্ধের ধরণ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য মরুঝড়ের মতো।
ইউক্রেনের প্রতিরোধযোদ্ধাদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর যে সমর্থন, সেটিকে ধন্যবাদ জানাতেই হবে। ফলে যে লক্ষ্য নিয়ে আগ্রাসন শুরু করেছিল রাশিয়া, তা পূরণ হয়নি। একই সঙ্গে পশ্চিমারা রাশিয়ার ওপর একগাদা নিষেধাজ্ঞার বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে এবং রাশিয়ার অর্থনীতি পঙ্গু করে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে চলেছে।
এ যুদ্ধের মাধ্যমে মস্কো শুধু নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনেনি, বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিও নিশ্চিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে সেটা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং সামগ্রিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে।
রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের নানা পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপের পরও ইউক্রেনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এখনো কার্যকর। কিন্তু যুদ্ধ যতই দিন গড়াচ্ছে, ততই যুদ্ধে জড়িত জাতিগুলো, বিশেষ করে রাশিয়ায় ঘোরতর সব রাজনৈতিক সংকট দেখা দিচ্ছে।
দুই সপ্তাহ আগে আলেকসান্দর দুগিনের কন্যা দারিয়া দুগিনা মস্কোর ১০০ কিলোমিটার দূরে একটি সাংস্কৃতিক উৎসবে অংশ নিয়েছিলেন। আলেকসান্দর দুগিনকে কেউ কেউ ‘পুতিনের মস্তিষ্ক’ বলে মনে করেন। উৎসব থেকে মস্কোতে ফেরার পথে তিনি আলাদা একটা গাড়িতে ওঠেন। মহাসড়কে দারিয়ার গাড়ি বিস্ফোরিত হয়, সঙ্গে সঙ্গে তিনি মারা যান। এ ঘটনায় ক্রেমলিন ন্যাটো ও ইউক্রেনীয় গুপ্তহত্যাকারীদের দায়ী করেছে।
এই ব্যর্থতার নানামুখী প্রভাব রাশিয়াজুড়ে পড়েছে। রাজনৈতিক নেতা ও কৌশলবিদ হিসেবে পুতিনের সক্ষমতা বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকার বদলে চীন ও ভারতে নতুন ক্রেতা ধরার পরও অর্থনীতির চাপ থেকে কোনোভাবেই বের হয়ে আসতে পারছেন না পুতিন। এতে ক্ষমতা তাঁর হাত থেকে ফসকে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় পরিষ্কার যে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার অর্থনীতি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দারিয়া দুগিনা হত্যার কয়েক দিনের মধ্যে এশিয়া টাইমসে ডেভিড পি গোল্ডম্যান লিখেছেন, জনপ্রিয় টেলিগ্রাম চ্যানেলে দুগিন ভ্লাদিমির পুতিনের জমানার সমালোচনা করে মন্তব্য লিখেছিলেন। হামলার মাত্র এক দিন আগে দুগিন বলেন, পুতিন একটি ‘সন্ধিক্ষণের শাসনামল’ পার করছেন। পশ্চিমাদের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা এবং ইউক্রেনীয়দের কার্যকর প্রতিরক্ষার কারণে রাশিয়ার সেনাবাহিনী, অর্থনীতি ও সমাজের ব্যাপক যে ক্ষতি হয়েছে, তাতে পুতিন আর ছয় মাসও টিকতে পারবেন না। দুগিন মস্কোর সরকার পরিবর্তনের আহ্বান জানান। তাঁর আকাঙ্ক্ষা হলো, পুতিনের পরিবর্তে এমন কেউ মস্কোর নেতৃত্ব আসুক, যিনি আরও বেশি চটকদার, সামরিক শক্তির ওপর আরও নির্ভরশীল ও ত্রাতাবাদী চরিত্রের হবেন।
সামরিকবাদ ও মৌলবাদ
দুগিন এমন একজন তাত্ত্বিক, যিনি রাশিয়াকে কাইজারের আমলের রাশিয়া হিসেবে দেখতে চান। নিজের জন্মভূমিকে শক্তিধর সাম্রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সামরিক শক্তি ব্যবহার করেই থামতে চান না দুগিন। তিনি বিশ্বাস করেন যে সভ্যতার অনিবার্য পরিণতি হিসেবেই এটা ঘটবে। আবার একই সঙ্গে দুগিন প্রাচ্যের অর্থোডক্স বা গোঁড়া খ্রিষ্টীয় মতবাদের একজন মৌলবাদী বিশ্বাসী। এটি এখন রাশিয়ার প্রাধান্যকারী ধর্মমত।
দুগিন ও তাঁর অনুসারীদের (রাশিয়ার সরকার ও সরকারের বাইরে রুশ সমাজে ব্যাপকভাবে তাঁরা রয়েছেন) মতে, ইউক্রেন যুদ্ধ হলো রুশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও খ্রিষ্টীয় মতবাদের সঙ্গে পশ্চিমাদের অশুভ ও সেক্যুলার (যারা মনে করেন ধর্ম রাষ্ট্র থেকে পৃথক থাকা প্রয়োজন) বিশ্বায়নের সংঘাত। কেন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে দ্রুততম সময়ের মধ্যে যুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি রাশিয়া? দুগিন ও তাঁর অনুসারীরা মনে করেন, এর কারণ পুতিনের নেতৃত্বের ব্যর্থতা।
পুতিনের জমানার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সমালোচনার পথ থেকে রুশ সাম্রাজ্যবাদী পক্ষ যাতে সরে আসে, সে জন্য পুতিন একটি সূক্ষ্ম চাল চেলেছেন। দুগিনের পরিবারের প্রতি হামলার কারণ হিসেবে অনেকে এটা মনে করছেন। এ হামলার সঙ্গে বাইরের শক্তির সঙ্গে নির্বাসিতদের একটি উগ্র গোষ্ঠী ‘ন্যাশনাল রিপাবলিকান আর্মি’ বা এনআরএকে দায়ী করছে পুতিন সরকার। রুশ আইনসভা ডুমার সাবেক উপপ্রধান ইলিয়া পোনোমারেভ (দুমার একমাত্র সদস্য যিনি ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার অবৈধ সম্প্রসারণের বিরুদ্ধ কথা বলেছিলেন) এ গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থা মনে করে, এনআরএ মস্কোর বর্তমান শাসকদের উৎখাত করে পশ্চিমা ধাঁচের একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করতে চায়। অনেক সংশয়বাদী মনে করেন, এনআরএ সম্পর্কে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে গল্প বলছে রাশিয়ার নিরাপত্তা সংস্থাগুলো। দুগিনের ওপর হামলার পর বিরোধীদের ওপর ব্যাপক যে দমন-পীড়ন শুরু হয়েছে, তার একটা ন্যায্যতা দেওয়া হচ্ছে।
দুগিনা হত্যাকাণ্ডের পেছনে দায়ী কে, সেই সত্য হয়তো আমরা কোনো দিনই জানতে পারব না। কিন্তু এ ঘটনার পেছনে সন্দেহভাজনদের তালিকা দীর্ঘ। এতে বিশ্লেষকদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে, রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কতটা ঘোলাটে এখন। রাশিয়ায় চলমান রাজনৈতিক অসন্তোষের (আলোকসান্দর দুগিন টেলিগ্রাম চ্যানেলে যেটা স্পষ্ট করেছেন) কারণ হলো ইউক্রেনের বিরুদ্ধে নিষ্পত্তিমূলক যুদ্ধে জয় আনতে পারেননি পুতিন।
অর্থনৈতিক অস্থিরতা
এই ব্যর্থতার নানামুখী প্রভাব রাশিয়াজুড়ে পড়েছে। রাজনৈতিক নেতা ও কৌশলবিদ হিসেবে পুতিনের সক্ষমতা বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকার বদলে চীন ও ভারতে নতুন ক্রেতা ধরার পরও অর্থনীতির চাপ থেকে কোনোভাবেই বের হয়ে আসতে পারছেন না পুতিন। এতে ক্ষমতা তাঁর হাত থেকে ফসকে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় পরিষ্কার যে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার অর্থনীতি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রাশিয়ার অর্থনীতি এখনো যে পুরোপুরি ধসে পড়েনি, তার কারণ হিসেবে অনেক বিশ্লেষক দেশটির অভ্যন্তরীণ শক্তির প্রসঙ্গ তুলছেন। কিন্তু সেই অভ্যন্তরীণ শক্তিতত্ত্ব ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে। আবার পুতিন যদি তাঁর ভাববিলাসী যুদ্ধ থেকে সরে না আসেন কিংবা ধরা যাক তিনি যুদ্ধে জিতেও গেলেন, এরপরও রাশিয়ার অর্থনীতি ডুবে যাওয়া থেকে রেহাই পাবে না।
সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, দুগিন তাঁর টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধে নাটকীয় কোনো পরিবর্তন না হলে পুতিনের জমানা আর ছয় মাসের বেশি টিকবে না। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, রাশিয়ার অর্থনীতি বড় ধরনের বিপর্যয়ে পড়তে ছয় মাস প্রয়োজন হবে।
পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ তখনই শেষ হবে, যখন মস্কোর বর্তমান শাসকদের বদল হবে। কিন্তু পুতিনের শাসনের অবসান হওয়ার পর রাশিয়ায় কী হবে? সেখানে কি বহুপক্ষীয় গৃহযুদ্ধ শুরু হবে? গণবিধ্বংসী অস্ত্রের ব্যবহারে সেখানে রক্তগঙ্গা বইবে? কিংবা দুগিন যেভাবে বলছেন, সে রকম কোনো ত্রাতাবাদী রুশ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হবে?
ব্রান্ডন জে ওয়াইকার্ট জার্মানির ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে