হোয়াইট হাউসে মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক প্রধান কর্মকর্তা ব্রেট মেকেগার্ক ফিলিস্তিন ইস্যু সমাধানের আগে ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের পক্ষে জোরালো তদবির করছেন।
অভিযোগ আছে, তিনি বিশ্বাস করেন, বিপর্যস্ত ফিলিস্তিনে স্থিতিশীলতার জন্য ইসরায়েল-সৌদির বন্ধন জরুরি। এ জন্য মার্কিনি, ইসরায়েলি, ফিলিস্তিনি ও সৌদি কর্মকর্তাদের জরুরি ভিত্তিতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা দরকার।
গাজায় যুদ্ধ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে এমন একটি চুক্তি হতে পারে।
এই যদি হয় কৌশল, তাহলে এটি পরিষ্কার, মেকেগার্ক ও বাইডেন প্রশাসন ৭ অক্টোবর থেকে কোনো শিক্ষা নেননি।
হামাসের এই হামলার পেছনে সম্ভাব্য বিশ্বাসযোগ্য কারণ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে ট্রাম্প প্রশাসনের গৃহীত পন্থা এবং আব্রাহাম অ্যাকর্ড। এ কথা অনেকেই মনে করে থাকেন।
আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনিদের ঘাড়ে পা রেখে স্বার্থসিদ্ধির ঘটনা ঘটেছে, তাদের উপেক্ষা করা হয়েছে এবং তারা প্রান্তিক ইস্যু হিসেবেই থেকে গেছে।
এদিকে ইসরায়েল ৭ অক্টোবরের বহু আগেই পশ্চিম তীরে নিবর্তনমূলক নীতি গ্রহণ করেছে। ফিলিস্তিনিদের নিয়মিত হয়রানি করতে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ চরমপন্থী বসতি স্থাপনকারীদের বারবার উসকে দিয়েছে এবং তাদের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে ওয়াশিংটনের এই পরিকল্পনা প্রায় ৫০ বছর আগের ক্যাম্প ডেভিড শান্তি চুক্তির পুনরাবৃত্তি বই কিছু নয়। ১৯৭৮ সালের ওই চুক্তির মূলকথা ছিল, ‘চলুন প্রথমে আমরা ইসরায়েল এবং মিসরের মধ্যে শান্তি স্থাপন করি, পরে ফিলিস্তিন নিয়ে আলোচনা করা যাবে।’
পার্থক্য শুধু এটুকুই। এই দফায় মিসরকে সরিয়ে আলোচনাটা হচ্ছে সৌদি আরবকে নিয়ে।
প্রথমে নিরাপত্তা...
‘প্রথমে নিরাপত্তা’ এই মতবাদ অতীতেও কাজ করেনি, এবারও করবে না। কারণ, এই মতবাদের গোড়ার কথা হলো, অধিকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চলে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ জারি রাখতে হবে। এই ‘প্রথমে নিরাপত্তা’ মতবাদ আসলে ইসরায়েল এবং শুধু ইসরায়েলের নিজস্ব নিরাপত্তা চাহিদার ওপর প্রতিষ্ঠিত। সবটাই ইসরায়েলের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল, হোক তা দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দিকে অগ্রসর হওয়া কিংবা এই সমাধানকে গ্রহণ করার মতো বিষয়।
যেভাবে তারা সমাধান চায়, তার সঙ্গে রূপকথার গল্পের কোনো পার্থক্য নেই। কারণ, গত তিন দশকে ইসরায়েলের যে আচরণ, তা নিশ্চিত করে দুই রাষ্ট্রের ধারণা কেবল কল্পনাই।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ মনে করে নিজেদের প্রয়োজনে ইসরায়েল দেশটির অভ্যন্তরে ইহুদিদের সংখ্যাধিপত্য রাখতে চায়। সময় গড়ালে ফিলিস্তিনে জনসংখ্যা বাড়বে। তখন নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে ইসরায়েল ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে মেনে নিতে বাধ্য হবে।
এর বদলে ইসরায়েলের নেতারা বিগত বছরগুলোয় এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে সময় এখন তাঁদের পক্ষে। ফিলিস্তিন প্রশ্ন মোকাবিলায় তাঁরা দ্রুততার সঙ্গে বিস্তারিত কোনো পরিকল্পনা নয়; বরং জোড়াতালি পন্থা নেবেন এবং ক্রমাগত গোলপোস্ট সরাতে থাকবেন।
’ ৯০ দশকের শুরুর দিকে, ফিলিস্তিনিদের বলা হয় ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। ২০০০ সালের শেষের দিকে তারা দাবি তোলে, ইসরায়েলকে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। এখন আলাপটা শুরু হয়েছে, দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের আগে হামাসকে নিষ্ক্রিয় করতে হবে।
এমন চাতুরীপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর খেলায় হয়তো মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ইচ্ছা করে যুক্ত হয়নি। কিন্তু তারাও ইসরায়েলের এই ধূর্তামির কাছে পরাস্ত হয়েছে। এই খেলায় বাকি সব নেতাকে পরাজিত করেছেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, যিনি গত ১৫ বছর ধরে কার্যত ক্ষমতায় আছেন।
শক্তিশালী ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপ্রমাণ বলে ধারাবাহিকভাবে অধিকৃত অঞ্চলে ফিলিস্তিনিদের অধিকার অস্বীকার করা ও বর্বরতাই ইসরায়েলের নিরাপত্তাহীনতার মূল কারণ। ৭ অক্টোবরের বিয়োগান্ত ঘটনা এর সর্বশেষ উদাহরণ।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সরকার গঠনের পর তাঁর পূর্বসূরির অনেক কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন; কিন্তু আব্রাহাম অ্যাকর্ডকে তিনি সমর্থন দেন। আরও পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে এই চুক্তির প্রাণভোমরা ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অবিচল।
মেকেগার্ক তিন বছর ধরে ক্রমে তাঁর লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইসরায়েলি সরকারের কর্কশ আচরণ থেকে ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষার প্রসঙ্গটি তিনি বরাবর এড়িয়ে গেছেন।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালত দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা গণহত্যাবিষয়ক মামলার গুরুত্ব সম্পর্কে একটি অস্থায়ী আদেশ দিয়েছে। এই আদেশে যে পদক্ষেপগুলো নিতে বলা হয়েছে, সেগুলোকে একত্র করলে গাজায় যুদ্ধবিরতির কথাই বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের চারপাশে যে দায়মুক্তির দেয়াল তুলেছে, তাতে প্রথমবারের মতো ফাটল দেখা যাচ্ছে। তেল আবিব ও ওয়াশিংটন কি শেষ পর্যন্ত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে তাদের নীতি পরিবর্তন করবে?
ইসরায়েলের সেনা ও নিরাপত্তা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা আঁচ করতে পারছিলেন, ফিলিস্তিনিরা ফুঁসছে; কিন্তু তেলআবিব ও ওয়াশিংটনের নেতারা অমার্জনীয়ভাবে অন্ধ ও বধিরের ভূমিকা নিলেন। ৭ অক্টোবরের এই বিয়োগান্ত ঘটনা তাই অপ্রত্যাশিত কিছু ছিল না।
কেন ফিলিস্তিনি অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়ার আগে ইসরায়েল ও আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ করতে হবে, তার পক্ষে এখন পর্যন্ত বাইডেন প্রশাসন কোনো জোরালো যুক্তি দাঁড় করাতে পারেনি। তাঁদের হাতে একটিই অস্ত্র আছে, আর তা হলো ‘প্রথমে নিরাপত্তা’ মতবাদ।
হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের মতে, মেকেগার্কের পরিকল্পনা ছিল সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য দেশ—কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছ থেকে পুনর্নির্মাণের টাকার প্রতিশ্রুতি আদায় করা। এতে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল দুই দেশের ওপরই চাপ পড়বে। ফিলিস্তিনি নেতারা গাজা ও পশ্চিম তীরে নতুন সরকার গঠন করবেন এবং ইসরায়েলকে আর অত সমালোচনা করবেন না।
এদিকে ইসরায়েলও গাজায় তাদের প্রভাব কমিয়ে আনবে।
এ ধরনের পরিকল্পনায় কোনো বৃহৎ রাজনৈতিক সমাধান থাকে না। এটাকে গড়পড়তা, অস্থায়ী, নিরুৎসাহী এবং আধখানা একটি সমাধান বলা যায়। তিন দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমন আধাখেঁচড়া সমাধানের পক্ষেই চিল্লাচ্ছেন যা শুধু ফিলিস্তিনিদের ক্ষোভ আর সহিংসতাকে বাড়িয়েছে।
এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারকারী শক্তিগুলোর এখন বোঝা উচিত, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে ধাপে ধাপে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ কখনোই সফল হবে না; বরং এ ধরনের উদ্যোগ ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে এমন অস্ত্র তুলে দেবে যা পুরো প্রক্রিয়াকে লাইনচ্যুত করবে।
শান্তির জন্য এখন প্রয়োজন ‘বিগ ব্যাং’। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণে এখনই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠন হবে সেই বিগ ব্যাং। ফিলিস্তিনিদের জন্য যখন ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যাবে, কেবলমাত্র তখনই অন্য সংকটগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
আব্রাহাম অ্যাকর্ডের মূল ধারণা হলো, ফিলিস্তিনিদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হলেই এই চুক্তির ব্যাপারে তাদের সম্মতি আদায় করা যাবে। কিন্তু পশ্চিম তির ও গাজা উপত্যকায় তাদের সেই আগের মতোই খাঁচাবন্দী থাকতে হবে।
এই পরিকল্পনা কাজ করেনি, এই পরিকল্পনা কখনো কাজ করবে না। যুক্তরাষ্ট্রের এই ব্যর্থ চেষ্টা আলবার্ট আইনস্টাইনের ‘পাগলামি’র সংজ্ঞার কথা মনে করায়, যেখানে আইনস্টাইন বলেছিলেন, পৃথক কোনো ফলের আশায় বারবার একই কাজ করে যাওয়াকে বলে পাগলামি।
ইসরায়েলপন্থী ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি সম্প্রতি সৌদিদের ওপর একটি মতামত জরিপ চালিয়েছে। গাজার প্রতি ইসরায়েলের যে আচরণ, সে প্রেক্ষাপটে আরব দেশগুলোর ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন ৯৬ শতাংশ সৌদি নাগরিক।
তাঁরা মনে করেন, আরব দেশগুলোর আরব পিস ইনিশিয়েটিভেই থিতু হওয়া উচিত। এই উদ্যোগের মূল কথা হলো আগে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা, পরে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ। এর ব্যত্যয় চলবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের অপর উদ্দেশ্য—একটি নতুন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠন করা, যার ব্যাপ্তি গাজা পর্যন্ত, সেটিও একরকম প্রলাপই। গাজা ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা তাদের নেতৃত্ব কেমন হবে, সে সম্পর্কিত সমাধান যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে মেনে নেবে, এমনটা কল্পনাতীত। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের মদদেই গাজায় রক্তগঙ্গা বইছে। নিরাপত্তা কাউন্সিলে দুই দুবার তারা ভেটো দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালত দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা গণহত্যাবিষয়ক মামলার গুরুত্ব সম্পর্কে একটি অস্থায়ী আদেশ দিয়েছে। এই আদেশে যে পদক্ষেপগুলো নিতে বলা হয়েছে, সেগুলোকে একত্র করলে গাজায় যুদ্ধবিরতির কথাই বলা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের চারপাশে যে দায়মুক্তির দেয়াল তুলেছে, তাতে প্রথমবারের মতো ফাটল দেখা যাচ্ছে।
তেল আবিব ও ওয়াশিংটন কি শেষ পর্যন্ত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে তাদের নীতি পরিবর্তন করবে?
মার্কো কার্নেলস ইতালীয় কূটনীতিক। তিনি সিরিয়ায় মধ্যপ্রাচ্য শান্তি চুক্তি সম্পাদনে ইতালি সরকারের পক্ষ থেকে তিনি বিশেষ দূত হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত আকারে অনুবাদ: শেখ সাবিহা আলম।