ইতিহাসের শুরু থেকে আমাদের এই মানবসভ্যতার নানামুখী বিবর্তন হয়েছে বহুবার, বিভিন্ন গতিতে। দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও বিশ্বের নানা প্রান্তের সোয়েটশপগুলোয় (যেখানে শ্রমিকদের নামমাত্র মজুরি দেওয়া হয়) নতুন ধাঁচের দাসত্বের কথা প্রায়ই শুনি আমরা। বর্ণবাদের বিপক্ষে সবাই বললেও অনেক সভ্য দেশে বর্ণবাদী চিন্তাধারা কিন্তু এখনো প্রবল। কিন্তু এখনো আশা আছে। জ্ঞান ও বিচক্ষণতার মাধ্যমেই আমরা নিয়মিত নিজেদের গতানুগতিক চিন্তাধারা ঝেড়ে ফেলে এই সভ্যতাকে ঠিক রাস্তায় নিয়ে যেতে পারি। এভাবেই যখন আমরা একদিকে মহামারি আকারে রূপ নেওয়া ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে লড়ছি, তখন আমরা সোচ্চার হচ্ছি অন্যের ওপর অবিচারের বিরুদ্ধেও।
বর্ণবাদ দূর করা থেকে শুরু করে অন্য সবাইকে নিজের মতো করে সমানভাবে মূল্যায়ন করতে আমাদের এখনো অনেক পথ বাকি। তবে আজ আমি প্রথাবিরোধী দার্শনিকের মতো পৃথিবী ও এর জীবজগতের প্রতি মানুষের অবিচারের কথা লিখতে আসিনি। আমি বলতে চাই কিছু মাইলফলকের কথা, যেগুলো মানুষ হিসেবে আমাদের বহু আগেই অর্জন করার কথা ছিল, অর্জন করা উচিত ছিল।
এ রকম একটি মাইলফলক হচ্ছে এমন একটি পৃথিবী তৈরি করা, যেখানে প্রত্যেক মানুষের একটি পরিচয় থাকবে, যেখানে তার একটি দেশ থাকবে। ধর্ম, বর্ণ বা অন্য যা কিছুই তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করুক না কেন, তার মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হওয়ার অধিকার থাকবে। কত মানুষ দিনের পর দিন নিপীড়নের ভয়ে রাষ্ট্রহীন হয়ে কিংবা শরণার্থী হয়ে বেঁচে আছে, একটা সভ্য দুনিয়া কীভাবে এটা সহ্য করতে পারে? প্রযুক্তি যতই আধুনিক হোক আর আমাদের জীবনধারা যতই উৎকর্ষ পাক, মানুষের জন্য মানুষের সহমর্মিতা একান্ত প্রয়োজন। যত দিন পৃথিবীতে লাখ লাখ অসহায় লোক মানুষ হিসেবে তাদের ন্যূনতম সুবিধাটুকুও পাচ্ছে না; তত দিন আমাদের আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই।
রোহিঙ্গাদের শরণার্থী জীবন আর তাঁদের দুরবস্থায় আমাদের অভ্যস্ত হয়ে গেলে চলবে না। সবাই মিলে এর সমাধানে কাজ করতে হবে। যত দিন যাচ্ছে, আমি ততই বুঝতে পারছি যে আমাদের দেশের ও বিশ্বের শরণার্থী সংকট সমাধানে প্রয়োজন বিশ্বের নেতাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। এসব সমাধান রাজনৈতিক আর রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তখনই ফিরতে পারবে যখন মিয়ানমার তাঁদের নিরাপত্তা ও অধিকারের নিশ্চয়তা দেবে।
সভ্যতার বিবর্তনের এই ব্যাপারটা মানুষ হিসেবে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখা জরুরি। একজন শিল্পী হয়ে আমি বহুদিন স্বার্থপরের মতো নিজের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিলাম। কিন্তু আমার সবকিছু বদলে গেল, যখন আমি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরএর সঙ্গে কাজ করা শুরু করলাম। আমি তাদের সঙ্গে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাওয়া শুরু করলাম। বারবার শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের জীবন দেখে আমি বুঝতে পেরেছি, আমাদের খুব সাধারণ জীবনটা তাদের কাছে কত লোভনীয়। একজন স্বার্থপর মানুষ, যার ভেতর বিন্দুমাত্র সহমর্মিতা নেই, সেও জানে, আমাদের খুব কাছের এই বৈশ্বিক সংকট কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
নিজের দেশে হোক, আর পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তেই হোক, কোনো শরণার্থী সংকটকেই চোখ বুজে মেনে নেওয়া যায় না। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসার পাঁচ বছর পর তাদের বাস্তুচ্যুতি আজ একটি প্রলম্বিত সংকটে রূপ নিয়েছে। তাঁদের প্রায় ৯ লাখ ৩০ হাজার জন এখন বাংলাদেশে আছে। একটা জনগোষ্ঠী দীর্ঘ সময় ধরে নিজ দেশে ফিরতে পারছে না… এটা মেনে নেওয়া যায় না। রোহিঙ্গারা যত দিন নিরাপদে নিজ দেশে ফিরতে না পারছে, তত দিন আমাদের উচিত তাদের সাহায্য করা। কারণ, মানুষ হিসেবে তাদের অধিকার আছে একটি পরিপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের।
ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের পাশে আছে; আর পাশাপাশি সারা বিশ্বকে আহ্বান জানাচ্ছে, আমাদের বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের জন্য সহায়তা জোরদার করতে। এই সংকটের শুরুর দিকের জরুরি অবস্থা কেটে গেছে আর এখন আমরা কাজ করছি যেন শরণার্থীদের সুরক্ষা এবং মৌলিক সেবা ও চাহিদাগুলো নিশ্চিত করা যায়। এর মধ্যে আছে শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ও জীবিকা; আর এর মাধ্যমে প্রত্যাবাসনের পর নতুন করে জীবন গড়ে তোলার জন্য এখন থেকেই তাদের প্রস্তুত করা যায়।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের মানুষেরা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে উদারভাবে, যদিও তাঁদের মধ্যে সবাই এক রকম নয়। তবে আজকের এই ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বর্ণবাদী আচরণে অভ্যস্ত পৃথিবীতে এটা স্বাভাবিক।
রোহিঙ্গাদের শরণার্থী জীবন আর তাঁদের দুরবস্থায় আমাদের অভ্যস্ত হয়ে গেলে চলবে না। সবাই মিলে এর সমাধানে কাজ করতে হবে। যত দিন যাচ্ছে, আমি ততই বুঝতে পারছি যে আমাদের দেশের ও বিশ্বের শরণার্থী সংকট সমাধানে প্রয়োজন বিশ্বের নেতাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। এসব সমাধান রাজনৈতিক আর রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তখনই ফিরতে পারবে যখন মিয়ানমার তাঁদের নিরাপত্তা ও অধিকারের নিশ্চয়তা দেবে। কিন্তু এই বাস্তবতাও মনে রাখতে হবে যে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে শিক্ষিত করে গড়ে তোলাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাহলেই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মে এমন নেতা হবেন, যাঁরা জানবেন ও বুঝবেন যে প্রত্যেক মানুষের একটি পরিচয় আছে, একটি দেশ আছে; ধর্ম, বর্ণ বা যেকোনো কিছুই তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করুক না কেন, তার মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হওয়ার অধিকার আছে।
তাহসান খান জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের শুভেচ্ছাদূত।