ধনীদের নিয়ে গবেষণা হবে কবে

গরিবদের নিয়ে গবেষণার কমতি নেই বাংলাদেশে। দারিদ্র্য নিয়ে বিশ্বজুড়ে গবেষণার ঢেউ শুরু হয় সত্তর দশকের প্রথম থেকে, যখন দেশে দেশে বিপ্লবী রাজনীতি বিস্তৃত হচ্ছিল। সে সময় বিশ্বব্যাংকের প্রধান রবার্ট ম্যাকনামারা এই দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন আগে যিনি ভিয়েতনামে মার্কিন গণহত্যার অন্যতম পরিচালক-যুদ্ধসচিব ছিলেন, তাঁর এক নীতিনির্ধারণী বক্তৃতায় বিশ্বের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

তখন থেকেই দারিদ্র্য গবেষণা, এনজিওসহ নানা রকম দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির তহবিলের প্রবাহ উন্মুক্ত হয়। দেশে দেশে দারিদ্র্য গবেষণা ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিও জোরকদমে শুরু হয়।

দারিদ্র্য গবেষণার মধ্য দিয়ে এর পরিমাপের পদ্ধতি, এর পরিমাণগত ও গুণগত গবেষণার নানা রকম পথ ও পদ্ধতি উন্নয়ন অর্থশাস্ত্রে যোগ হয়েছে। তাতে দারিদ্র্যের হিসাব-নিকাশের অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এতে দারিদ্র্য পরিস্থিতির খুব উন্নতি হয়নি। মাঝেমধ্যে পরিস্থিতির কিছু উন্নতি দেখা যায়, আবার কিছু ধাক্কায়ই পড়ে যায় নিচে।

আরও পড়ুন

আশির দশকে বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির আগ্রাসী দাপটে গবেষণা কনসালট্যান্সি তার অধীন হয়ে পড়ে। এর আগপর্যন্ত নিজেদের আগ্রহে অর্থনীতিবিদেরা কাঠামোগত পরিবর্তনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজে আগ্রহী ছিলেন।

আশির দশকের পর তাঁদের অনেকে নিজেরাই বিদ্যমান কাঠামোতে সমন্বিত হয়ে যান, কেননা অর্থ উপার্জন ও পেশাগত উন্নতি এই পথে খুব স্বচ্ছন্দ। পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিরও নানা রূপ দেখা যেতে থাকে।

রাষ্ট্রকে সব দায় থেকে মুক্তি দিয়ে, বাজার বা কোম্পানি ও এনজিও দিয়েই সব সমস্যার সমাধান হবে, এই অবস্থানই তথাকথিত নয়া উদারতাবাদী দর্শনের মূল কথা। তার বিপুল প্রভাবে একদিকে দারিদ্র্য সৃষ্টি, অন্যদিকে বিমোচন কর্মসূচি এই খেলার মধ্যে বহু দেশই পড়ে আছে। ক্ষুদ্রঋণ আর এনজিওগুলোর ‘ব্র্যান্ড’ বলে দুনিয়া-বিখ্যাত হলেও বাংলাদেশও তার একটি। পাশাপাশি বাংলাদেশে খুব দ্রুত অতিধনী একটি গোষ্ঠীর উদ্ভব বিশেষ ঘটনা, যার কারণে বৈষম্য ঊর্ধ্বমুখী, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনের অনিশ্চয়তা আর বঞ্চনার বিনিময়েই এগুলো হচ্ছে।

যেসব ব্যক্তি হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে মেরে দিয়েছেন, পাচার করেছেন তার ফলাফলে মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার চাপ, দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে নতুন দারিদ্র্য তৈরি হয়েই যাচ্ছে। মালয়েশিয়াসহ বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির কারসাজি করে সাবেক মন্ত্রীর পরিবারসহ কিছু লোক হাজার হাজার কোটি টাকা বানিয়েছেন, তার জন্য লাখ লাখ মানুষ পথে বসেছে।

দারিদ্র্য নিয়ে এত এত ঢাকঢোলের মধ্যে একটি সহজ সত্য কখনোই উচ্চারিত হয় না যে যেসব দেশে সমাজতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী বা কল্যাণমূলক যে ব্যবস্থাই হোক, দারিদ্র্য কমেছে বা দূর হয়েছে, তার কোথাও দারিদ্র্য নিয়ে এত গবেষণা আর দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির এ রকম উৎসব দেখা যায়নি।

সেসব দেশে প্রকট দারিদ্র্য থেকে মুক্তি ঘটেছে সমাজ অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তরের মাধ্যমে। আর নিজেদের সুবিধামতো দারিদ্র্যসীমা নামে আয়ের একটা রেখা টেনে তার ওপরে নিচে মানুষকে টানাহেঁচড়ার মতো অসম্মানজনক ও অযৌক্তিক আর কিছু নেই। দরকার মানুষকে সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া। আর তার জন্য মানুষের শুধু আয় নয়, সম্মানজনক কাজ ও জীবন নিরাপত্তা, নাগরিক অধিকার, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানে প্রবেশাধিকার, রাষ্ট্রের ওপর কর্তৃত্ব; সবই গুরুত্বপূর্ণ।

মুক্তির ধর্মতত্ত্বের অনুসারী লাতিন আমেরিকার এক ধর্মযাজক বলেছিলেন, ‘আমি যখন দরিদ্রদের সেবা করি বা তাদের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করি, তখন তারা আমাকে বলে সাধু দরবেশ; আর আমি যখন দারিদ্র্যের কারণ জানতে চেষ্টা করি, তখন তারা আমাকে গালি দেয় কমিউনিস্ট বলে!’

আরও পড়ুন

আসলে দারিদ্র্য, বঞ্চনা, বৈষম্য, নিপীড়ন দূর করতে গেলে এর কারণ জানাই তো প্রধান কাজ। আর এই কারণ জানতে গেলে দরিদ্রদের হাত-পা, ঘরবাড়ি, আয়রোজগার নিয়ে মাপামাপির গবেষণার চেয়ে বেশি দরকার কিছু লোকের দ্রুত ধনী হওয়ার উৎস ও ফলাফল অনুসন্ধান। এই গবেষণা থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দারিদ্র্য, বঞ্চনা, নাগরিক অধিকারহীন রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সন্ত্রাস-অপরাধ বৃদ্ধি, নদী-বন-প্রাণপ্রকৃতির বিনাশ; সবকিছুরই কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে।

যেমন বেনজীরের মতো সরকারের একাধিক বাহিনীপ্রধান কিংবা সরকারঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যেভাবে হাজার হাজার একর জমি-বন দখলসহ বহু হাজার কোটি টাকার সম্পদ বানিয়েছেন, তা তো এমনি এমনি ঘটেনি, এই প্রক্রিয়ায় কত মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন, তার হিসাব করা কঠিন।

যেসব ব্যক্তি হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে মেরে দিয়েছেন, পাচার করেছেন তার ফলাফলে মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার চাপ, দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে নতুন দারিদ্র্য তৈরি হয়েই যাচ্ছে। মালয়েশিয়াসহ বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির কারসাজি করে সাবেক মন্ত্রীর পরিবারসহ কিছু লোক হাজার হাজার কোটি টাকা বানিয়েছেন, তার জন্য লাখ লাখ মানুষ পথে বসেছে।

বাসের ফিটনেস লাইসেন্স নিয়ে দুর্নীতি করে, টার্মিনালগুলোয় চাঁদাবাজির ঘাঁটি বানিয়ে যাঁরা টাকা বানিয়েছেন, তাঁদের কারণে কত মানুষ দুর্ঘটনায় মরছে প্রতিদিন, কত পরিবারে দীর্ঘস্থায়ী দারিদ্র্য সৃষ্টি হয়েছে, তার হিসাব আছে?

দেশে–বিদেশে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা ধনী হয়েছেন, কিন্তু তাঁদের এই সম্পদ বানানোর জন্য গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, দেশের আর্থিক খাত দুর্বল হয়েছে, মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। সরকারি দলের নেতা, তথাকথিত এমপি, আমলা-ব্যবসায়ী নদী-জমি-খাল দখল করে বিপুল সম্পদ আত্মসাৎ করেছেন, কিন্তু তার কারণে বহু মানুষের আশ্রয়, জীবন-জীবিকা ধ্বংস হয়েছে।

যেসব মহারথী শেয়ারবাজারে জালিয়াতি করে ব্যাংকঋণ লোপাট করে শীর্ষ ধনীতে পরিণত হয়েছেন, তাঁদের জন্য লাখ লাখ মানুষ তাদের সব সম্বল হারিয়েছে, দারিদ্র্য তাদের ছাড়বে কেন? বড় বড় কোম্পানি বহুতল ভবন করার পথ পরিষ্কার করার জন্য লাখ মানুষের আবাস আগুনে পুড়িয়ে, হুমকি দিয়ে, ভয় দেখিয়ে যাদের জমি দখল করেছে, তাদের দারিদ্র্য কাটবে কীভাবে?

পথে পথে, ফুটপাতে, দোকানে, ব্যবসা; সব জায়গায় যে চাঁদাবাজি ক্রমেই বাড়ছে, তা অনেক দূর পর্যন্ত ক্ষমতার লোকদের সম্পদ বানায়। কিন্তু এর কারণে অসংখ্য মানুষের জীবিকা বিপর্যস্ত হয়, খাদ্যগ্রহণ কমে যায়, অপুষ্টি বাড়ে, জীবন কাটছাঁট হয়। চিকিৎসা, শিক্ষা এখন কিছু লোকের বড় ব্যবসা, কিন্তু বহু মানুষের নতুন দারিদ্র্য সৃষ্টি তার ফলাফল। কারণ না খুঁজে শুধু আহা, উঁহু গবেষণায় কী হবে?

বিশ্বে ধনীদের ধনী হওয়ার সাফল্য নিয়ে বইপত্র কম নেই। সেগুলোয় তাঁদের জীবনকাহিনির খুব রোমাঞ্চকর ত্যাগ আর পরিশ্রমের কাহিনি পাওয়া যায়। এগুলো নতুন নয়, রাজা-বাদশাহদের মধ্যে অনেকেই জীবনীকার পুষতে প্রচুর ব্যয় করেছেন। যাহোক, অতিধনী বৃদ্ধির হারের দিকে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রায়ই প্রথম স্থান লাভ করে। তাঁদের বিপুল চোরাই সম্পদ দুবাই, মালয়েশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকার দেশে দেশে তাঁদের স্থায়ী ঠিকানা তৈরি করেছে। বাংলাদেশ তাঁদের উপনিবেশ।

অতিধনীদের সম্পদ পুঞ্জীভবনের ওপর গবেষণা না হলে বাংলাদেশের উন্নয়নের মহাসড়কের আসল রূপ, প্রাণপ্রকৃতির পরিবেশের বিনাশ, দারিদ্র্যের টেকসই অবস্থা আর বৈষম্য বৃদ্ধির কারণ বোঝা যাবে কী করে? কিন্তু এই চোরাই অতিধনীদের ওপর প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা ব্যক্তিগত, বিদ্যায়তনিক বা থিঙ্কট্যাংক গোষ্ঠী কারও গবেষণার খোঁজ পাওয়া কঠিন। কারণ, এ কাজে তহবিল নেই, মনোযোগও নেই, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেই, গরিবদের মতো তাঁদের সম্পদের নাগাল পাওয়ারও উপায় নেই। উল্টো তাঁদের অনুগ্রহের নিচেই বহু বিদ্বজ্জনের বাস!

সরকার বা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জন্যও এসব কাজ আত্মঘাতী, তারা এগুলো করবে না। সমাজের মুক্ত মানুষ-গবেষকদের মধ্য থেকে এ বিষয়ে উদ্যোগ জোরদার না হলে প্রতারণা আর প্রহসনের সব দলিলের মধ্যেই আমাদের ডুবে থাকতে হবে।

  • আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক