ড. ইউনূসকে নিয়ে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের নিবন্ধ
কার জন্য ঘণ্টা বাজছে...
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী, জাতির সম্পদ অধ্যাপক ড. ইউনূসের মতো একজন ব্যক্তি নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অথচ কীভাবে তাঁকে কাজে লাগানো যায় বা একজন দূত হিসেবে যেসব বিশ্বনেতা, যাঁরা সাধারণত আমাদের মন্ত্রী ও কূটনীতিকদের নাগালের বাইরে থাকেন, তাঁদের কাছে তাঁকে কীভাবে পাঠানো যায়, সেই উপায় খুঁজে বের করতে আমাদের নেতারা কোনো চেষ্টাই করেননি।
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী, বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ও সর্বজনীন সম্মানিত ব্যক্তি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চলতি বছরের প্রথম দিন শ্রম আদালতের ছয় মাসের কারাদণ্ডের রায় দেওয়ার ঘটনা দেখাটা ছিল দুঃখজনক। অথচ দিনটি নতুন বছরের প্রতিশ্রুতির দিন হওয়া উচিত ছিল।
ড. ইউনূস ইতিমধ্যে দেশে-বিদেশে মর্যাদার এমন একটি অবস্থান অর্জন করেছেন, যা তাঁর খ্যাতির ওপর লেপন করা কলঙ্ক থেকে তাঁকে নিষ্কলুষ মানুষ হিসেবে বেরিয়ে আসতে সক্ষম করে তুলবে। তাঁর বিরুদ্ধে বিচারে অবস্থান নেওয়া সরকারি কৌঁসুলিরা এতটা সুবিধাপ্রাপ্ত না–ও থাকতে পারেন।
সরকারের প্রভাবশালী কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিস্ময়করভাবে এই মামলা থেকে সরকারকে আলাদা করার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা এটিকে সম্পূর্ণ আইনি বিষয় বলে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করছেন। তাঁরা বলছেন, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর—যা রাষ্ট্রের একটি ছোট ও অখ্যাত প্রতিষ্ঠান এই মামলা করেছে।
অন্যায্য একটি সমাজে শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের অগুনতি ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। এ ধরনের হাজার হাজার মামলা শ্রম আদালতে বিচারের অপেক্ষায় পড়ে আছে। যেখানে মামলার ফাইল চলে শম্বুকগতিতে, রায় হয় কদাচিৎ। আর রায় হলেও কারাদণ্ডের সাজা বিরল। সরকারের অতীত কর্মকাণ্ডের কারণে খুব কম লোকই এ কথা বিশ্বাস করেন যে অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এমন একটি মামলা করেছেন, যে মামলার বৈশ্বিক প্রভাব থাকতে পারে। আর মামলাটি অভূতপূর্ব গতিতে এগিয়েছে, যাতে রেকর্ড কম সময়ের মধ্যে সাজার রায় হয়ে গেছে।
এমন একটি বহুল আলোচিত ও প্রচারিত রায় ইতিমধ্যে আমাদের বিচারব্যবস্থা ও শাসনচর্চাকে জনপরীক্ষার মুখে ফেলেছে। নোবেলজয়ী ও বিশ্বের বিশিষ্ট ১৬৪ ব্যক্তি ইতিমধ্যে অধ্যাপক ইউনূসকে ‘হয়রানি’ করার বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। তাঁরা আদালতের এই রায়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে থাকবেন। এসব বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের অনেকেই এখন বাংলাদেশের শ্রম আদালতের রায়ের বিশদ বিবরণ আরও নিবিড়ভাবে যাচাইয়ে তাঁদের উচ্চ ধীশক্তি প্রয়োগে মনোনিবেশ করতে পারেন, যাতে তাঁরা মামলার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্পর্কে নিজস্ব সিদ্ধান্ত টানতে পারেন।
এ ধরনের একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশে মুহাম্মদ ইউনূসের মতো বৈশ্বিকভাবে অনেক উঁচু পর্যায়ের একজন ব্যক্তির অধিকারের ওপর আক্রমণের অর্থ হলো, যে কেউ—রাজনৈতিক বিরোধী, বন্ধুহীন ব্যবসায়ী, নাগরিক সমাজের সংগঠন, স্পষ্টভাষী ব্যক্তিরা ‘বিপন্ন প্রজাতি’ হিসেবে থাকছেন। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত যে অধ্যাপক ইউনূসের মতো কোনো ব্যক্তির জন্য যখন ঘণ্টা বাজছে, তখন একদিন সেই ঘণ্টা আমাদের যে কারও জন্য বাজতে পারে।
ইউনূসের বিরুদ্ধে রায় যদিও বিশ্বব্যাপী যাচাই-বাছাইয়ের মুখে পড়তে পারে, তবু বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতি নিয়ে আমাদেরও অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে চিন্তাভাবনার দাবি রাখে। এটা সেই পরিস্থিতি, যেখানে একজন ব্যক্তি তাঁর পেশাগত জীবনের সেরা সময়টা বাংলাদেশের দরিদ্র নারীদের জীবনমান উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে বিনিয়োগ করেছেন। আর তিনি এখন কারাবাসের শঙ্কার মুখে।
এই আদালতের মামলাই প্রথম ঘটনা নয়, যেখানে অধ্যাপক ইউনূস নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। সরকার ও তাদের বুদ্ধিজীবী সহযাত্রী—উভয়ের কাছ থেকে তিনি অবজ্ঞা আর নিন্দার চলমান এক সংগঠিত প্রচারণার শিকার হয়েছেন। এ ধরনের একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই প্রতিকূল সম্পর্কের যৌক্তিকতা, প্রয়োজন বা প্রাসঙ্গিকতা ব্যাখ্যা করতে প্রমাণসিদ্ধ কোনো যুক্তি তুলে ধরা হয়নি।
ড. ইউনূসের মতো উচ্চ মর্যাদার একজন ব্যক্তিকে নিজেদের মধ্যে পাওয়ার সৌভাগ্য যখন একটি জাতির হয়, তখন আশা করা যেতে পারে, দেশের সেবায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নেতৃত্ব তাঁর কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করবে। আর সরকারের দেশ গঠনের কাজে সহায়তার জন্য এ ধরনের সব ব্যক্তি তাঁদের শক্তি–সামর্থ্য দিয়ে কাজ করবেন।
অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে এই কল্পিত বা বাস্তব মতপার্থক্যের বিষয়ে সমাধান করতে সংলাপ আয়োজনে আমাদের নেতৃত্ব কোনো ধরনের চেষ্টা করেছেন, এমন কিছু আমার জানা নেই। জাতির সম্পদ হিসেবে কীভাবে তাঁকে কাজে লাগানো যায় বা একজন দূত হিসেবে যেসব বিশ্বনেতা, যাঁরা সাধারণত আমাদের মন্ত্রী ও কূটনীতিকদের নাগালের বাইরে থাকেন, তাঁদের কাছে তাঁকে কীভাবে পাঠানো যায়, সেই উপায় খুঁজে বের করতে আমাদের নেতারা কোনো চেষ্টাই করেননি।
বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের ওপর এই ঘটনার ব্যাপক প্রভাব নিয়ে আমার গুরুতর উদ্বেগ রয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে বছরের পর বছর ধরে আইনের একতরফা অপব্যবহার করা হচ্ছে। সরকার সামরিক বা রাজনৈতিক যেমনই হোক না কেন, এই অপব্যবহারের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
বছরের পর বছর ধরে আমাদের গণতন্ত্র ও শাসনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ব্যাপক আক্রমণের অংশ হিসেবে বিচারব্যবস্থাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু আমাদের বিচারব্যবস্থাই নয়; আমাদের প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান, আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আমাদের সাংবিধানিক সংস্থা—যেমন সংসদ, নির্বাচন কমিশন (ইসি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক); আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আমাদের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, সবই এমন পর্যায়ে দলীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে তারা সুশাসনের স্তম্ভ হিসেবে কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
বিরোধী রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, স্বাধীন গণমাধ্যম, এমনকি সরকারের সমালোচক হিসেবে বিবেচিত ব্যক্তিদের দমন–পীড়নে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিটিকে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে।
আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতার এই ক্ষয়ের লক্ষণ হচ্ছে অধ্যাপক ইউনূসের ঘটনা। তাঁর বিরুদ্ধে তুচ্ছ ঘটনা ও সংকীর্ণতার এই মামলা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত কোনো বিচারব্যবস্থায় প্রাথমিক ভিত্তি পেত না।
হাজার হাজার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কারাগারে বন্দী। বিপুলসংখ্যক ভুক্তভোগী জামিন ছাড়াই জেল খাটছেন। কিংবা মাথার ওপর ঝুলে থাকা বিপদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) বা সাইবার নিরাপত্তা আইনের (সিএসএ) মামলায় অভিযুক্ত হচ্ছেন। যা যথাযথ প্রক্রিয়ায় নাগরিক সুরক্ষাকে অগ্রাহ্য করার মাধ্যমে আমাদের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরে।
সাদাপোশাকের ব্যক্তিরা কোনো পরোয়ানা ছাড়াই মধ্যরাতে যেকোনো বাড়িতে আসতে পারেন এবং আপনাকে টেনেহিঁচড়ে কোনো অজানা গন্তব্যে নিয়ে তাঁরা আপনার সঙ্গে যা ইচ্ছা তা–ই করতে পারেন। আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এ ধরনের কাজ এ জন্যই করতে পারে, তারা আইনের সামনে নিজেদের জবাবদিহির ঊর্ধ্বে মনে করে। অন্যদিকে নাগরিকদের মধ্যে এই ভয় কাজ করে যে তাঁরা তাঁদের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় আর আমাদের আদালতের ওপর নির্ভর করতে পারছেন না।
টানা কয়েকবার অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনের (ইসি) স্বাধীনতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আমাদের দুদককে রাজনৈতিক বিরোধীদের বিচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও পছন্দের ব্যবসায়িক বন্ধুদের বিদ্যমান সুস্পষ্ট দুর্নীতির ব্যাপারে তারা যেন অন্ধ। সংসদে এখন একচেটিয়া ক্ষমতাসীন দলের আধিপত্য। নির্বাহী বিভাগকে জবাবদিহি করার একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে খোদ সংসদ তার দায়িত্ব থেকে পিছু হটেছে। জনগণের কিছু গুরুতর উদ্বেগ চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে এই সংসদের তৎপরতার অভাব প্রকট।
সব স্তরে আমাদের নির্বাচনী সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিত্ব এখন স্বঘোষিত ও প্রত্যাশিত ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই তাঁদের ব্যবসায়িক স্বার্থে নিজেদের দপ্তর ব্যবহার করতে পছন্দ করেন, যা স্বার্থের দ্বন্দ্বের নিয়মের লঙ্ঘন। যার ফলে প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ার কাজ দুর্বল হয়ে পড়ে।
আইনের শাসন রক্ষা ছাড়া ব্যবসায়িক অগ্রগতি, তা দেশি বা বিদেশি যা-ই হোক না কেন, বিষয়টি রাজনৈতিক পরিচয়, সঠিক যোগাযোগ ও বস্তুগত প্রণোদনা দেওয়ার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ড নিয়ে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগের কারণে অন্যান্য এশীয় দেশের তুলনায় আমাদের এখানে কম প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আসছে।
শাসনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সমর্থন–সহযোগিতা ছাড়া নাগরিক সমাজ বিপন্ন থেকে যায়। তাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানের করুণায় চলতে হয়। কারণ, তাদের টিকে থাকার আর্থিক উপায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো হাতে রাখা হয়েছে। একটি নাগরিক সমাজের সংগঠনের (সিএসও) ভাগ্য নির্ধারণের জন্য কোনো বস্তুনিষ্ঠ মানদণ্ড নেই। এটা নির্ভর করে ক্ষমতার সঙ্গে তাদের সমীকরণ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ওপর।
এ ধরনের একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশে মুহাম্মদ ইউনূসের মতো বৈশ্বিকভাবে অনেক উঁচু পর্যায়ের একজন ব্যক্তির অধিকারের ওপর আক্রমণের অর্থ হলো, যে কেউ—রাজনৈতিক বিরোধী, বন্ধুহীন ব্যবসায়ী, নাগরিক সমাজের সংগঠন, স্পষ্টভাষী ব্যক্তিরা ‘বিপন্ন প্রজাতি’ হিসেবে থাকছেন। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত যে অধ্যাপক ইউনূসের মতো কোনো ব্যক্তির জন্য যখন ঘণ্টা বাজছে, তখন একদিন সেই ঘণ্টা আমাদের যে কারও জন্য বাজতে পারে।
রেহমান সোবহান জানুয়ারি ২০২৪