গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের ওপরে গণমাধ্যমের মূল দৃষ্টি নিবদ্ধ। কিন্তু এর বাইরেও সিরিয়া ও ইরাকে শিয়া সশস্ত্র যোদ্ধাদের সঙ্গে সেখানে অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের সংঘাত যে বাড়ছে, সে খবরও বাড়ছে।
এ খবরও পাওয়া যাচ্ছে (যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান দুই পক্ষই তা চাপা দিতে আগ্রহী), স্থানীয় হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিতে যাওয়া আহত মার্কিনদের সংখ্যা বাড়ছে। এ ঘটনা পরিস্থিতিকে সবচেয়ে বিপজ্জনক করে তুলছে। পরিস্থিতি হঠাৎ উত্তেজক হয়ে ওঠার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
অক্টোবরে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটা স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, ইরানের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নসরুল্লাহ প্রকাশ্যে পরিস্থিতি শান্ত করতে চেষ্টা করেছেন। তিনি এটিও স্পষ্ট করেছেন যে ইসরায়েল ও দেশটির মিত্রদের সঙ্গে এখনই সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে চায় না হিজবুল্লাহ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমরা অন্যতম বড় একটি মানবিক বিপর্যয় দেখছি গাজায়। অবরুদ্ধ ২৩ লাখ মানুষের ওপর সামষ্টিক শাস্তি চাপিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল। হামলায় এরই মধ্যে ১৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিন মারা গেছেন, যাঁদের ৫ হাজারের বেশি শিশু। অথচ জি-৭-এর নেতারা ‘যুদ্ধবিরতি’ নামের শব্দটি উচ্চারণ করতেও কুণ্ঠার মধ্যে আছেন।
এর বদলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আরও পলকা ও স্বল্পমেয়াদি সমাধানের ওপর নির্ভর করছে। সেটার তারা নাম দিয়েছে ‘মানবিক বিরতি’। এমনকি ৪৭ দিনের যুদ্ধাপরাধ ও বাছবিচারহীন সহিংসতার পর যে চার দিনের যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে, সেটা শেষে ইসরায়েলি বাহিনী আবার তাদের বর্বর হামলা শুরু করার যে ঘোষণা দিয়েছে, তাতে খোলাখুলি সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা।
ইরানের প্রক্সি সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী লেবাননের হিজবুল্লাহ। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলাকালে প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদের সরকারের পাশে হিজবুল্লাহ যেভাবে শক্তভাবে দাঁড়িয়েছিল, গাজার ঘটনায় সেটা তারা পারছে না। লেবাননের যে ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থা, তাতে অন্য একটি দেশের যুদ্ধ নিজেদের ভূখণ্ডে টেনে আনার ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সতর্ক হিজবুল্লাহ। কেননা, এ রকম কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে অনিবার্যভাবে লেবাননের গোটা অর্থনীতি ধসে পড়বে।
এর একটা আংশিক কারণ হলো, হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার একটা বিভ্রান্তিকর বয়ান দাঁড় করিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সেদিনের হামলাকে হলোকাস্টের সঙ্গে তুলনা করে আইএসআইএসের সঙ্গে সম্পর্কিত একটা খারাপ শক্তি এটা করেছে—সেই ভাষ্য দাঁড় করিয়েছেন তিনি।
আইএসআইএসের সঙ্গে হামাসের যোগসূত্রতার কথা বলে নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনিদের অমানুষ হিসেবে চিত্রিত করেছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই বুঝ দিয়েছেন যে হামাসকে সমূলে উৎপাটন করতে হলে গাজাকে ধ্বংস করে ফেলতে হবে। কয়েক বছর আগে ইরাকের মসুলে আইএসআইএস নির্মূলে পশ্চিমা বিশ্ব এই একই কাজ করেছিল।
আইএসআইএসের মতো হামাস অন্ধ মতাদর্শ দিয়ে চালিত নয়। নেতানিয়াহু এটা ভালো করেই জানেন যে হামাস লড়াকুদের একটি সংগঠন। তিনি ভালো করেই জানেন যে একটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে নিপীড়নের শিকল থেকে বের করে আনার প্রেরণা থেকেই হামাসের জন্ম।
নেতানিয়াহু যদি সবটাই জেনে থাকেন, তাহলে কেন তিনি হামাসের সঙ্গে আইএসআইএসের যোগসূত্র আছে, সেটা যেকোনো মূল্যে প্রতিষ্ঠা করে হামাসকে নির্মূল করতে চান?
উত্তরটা সরল। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁর হয়ে যুক্তরাষ্ট্র যাতে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে। ইসরায়েলের ঝানু প্রধানমন্ত্রী এর জন্য দীর্ঘদিন ধরে নিরলসভাবে ওকালতি করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে ইরাক ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ার পর থেকে তিনি এটা করে আসছেন। বলা চলে, এ কাজে নেতানিয়াহু সফলও। কেননা, এখনকার মতো যুক্তরাষ্ট্র কখনো ইরানের সঙ্গে বাস্তব সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়েনি।
অন্যদিকে ইরানও সর্বোচ্চ মাত্রার কথার লড়াই চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে চলেছে। ইরান এরই মধ্যে স্পষ্ট করেছে যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড় কোনো যুদ্ধ জড়াতে চায় না। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার পরও তেহরান কড়া প্রতিক্রিয়া দেখানোয় সংযত থাকে। ৭ অক্টোবরের পর থেকে সিরিয়া ও ইরাকে অবস্থিত ইরানের ঘাঁটিগুলোয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল বারবার বোমা হামলা করলেও তেহরান আপাতত নীরব।
১৯৭৯ সালের পর সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইরান বড় ধরনের কূটনৈতিক সফলতা পেয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় জব্দ থাকা ৬ বিলিয়ন ডলারও ছাড় করতে সক্ষম হয় ইরান।
এ প্রেক্ষাপটে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার চেয়ে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের বিভিন্ন প্রক্সি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে দিয়েই নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধি করতে চায় ইরান। এই প্রক্সি গোষ্ঠীগুলো ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি নিয়ন্ত্রিত সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে। এর পেছনে তাদের উদ্দেশ্য হলো প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য তারা যে প্রস্তুত আছে, সেটা দেখানো।
ইরানের প্রক্সি সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী লেবাননের হিজবুল্লাহ। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলাকালে প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদের সরকারের পাশে হিজবুল্লাহ যেভাবে শক্তভাবে দাঁড়িয়েছিল, গাজার ঘটনায় সেটা তারা পারছে না। লেবাননের যে ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থা, তাতে অন্য একটি দেশের যুদ্ধ নিজেদের ভূখণ্ডে টেনে আনার ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সতর্ক হিজবুল্লাহ। কেননা, এ রকম কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে অনিবার্যভাবে লেবাননের গোটা অর্থনীতি ধসে পড়বে।
যাহোক, ইরান ও হিজবুল্লাহ সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে চলতে চাইলেও নেতানিয়াহু যেকোনো মূল্যে তার রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চায়। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা ব্যর্থতার প্রতিশোধ নিতে নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য এখন ফুঁসছে। ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধের সঙ্গী হওয়ায় আরব বিশ্ব, মুসলিম ও দক্ষিণ বিশ্বের জনগণের মধ্যে মার্কিন বিদ্বেষ বেড়ে চলেছে। আরব বসন্তের স্মৃতি আরব দেশগুলোর নেতাদের মধ্যে এখনো জাগ্রত। আরব নেতারা তাঁদের জনগণকে পরীক্ষার মধ্যে ফেলবেন কিনা সে বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকবেন।
কিন্তু এ ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সরাসরি সংঘাত বাধানোর সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে ইসরায়েল। এটা যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত যে তারা মধ্যপ্রাচ্যে নেতানিয়াহুর দোসর হয়ে আরেকবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মাতবে কি না? আরও কয়েক বছরের জন্য সেখানে সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে কি না? সেটা হলে সম্ভবত ইরাক, আফগানিস্তানের চেয়েও আরও খারাপ অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়তে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে।
সুলতান বারাকাত কাতার ফাউন্ডেশনের হামাদ বিন খলিফা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংঘাত ও মানবিক স্টাডিজের অধ্যাপক
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত