বীর মুক্তিযোদ্ধারা এ দেশের সূর্যসন্তান। সমগ্র বাঙালি জাতি প্রতিবছর সব গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধাভরে তাঁদের স্মরণ করে। তাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন এই বাংলাদেশের ওপর ঘটে যাওয়া শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে, মাতৃভূমি রক্ষা ও উন্নয়নের স্বার্থে। ব্যক্তিগতভাবে কোনো কিছু পাওয়ার আশায় কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেছেন বলে আমাদের কখনো মনে হয়নি। ৫৩ বছর পর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই আজ আমাদের মাঝে নেই। অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন এবং কেউ কেউ আবার বসবাস করছেন দেশের বাইরে।
এই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা অনেক দিন ধরে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যতটুকু জানি, সঠিক মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০ হাজার (যাচাই সাপেক্ষে)। কিন্তু বর্তমান তালিকা অনুযায়ী এই সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ (যাচাই সাপেক্ষে)। বর্তমানের এ তালিকার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং এই সন্দেহের পেছনে কিছু কারণ আছে। যেমন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই ভাবতেন, দেশের জন্য যুদ্ধ করে আবার তালিকাভুক্ত হওয়ার কী আছে, জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করেছি, এটাই তো আসল প্রাপ্তি।
আবার স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের নেতারা টাকার বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতেও অনেকে অপমানিত বোধ করেন। এতে তাঁদের ত্যাগের সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি বিধায় তাঁরা অভিমান করে তালিকাভুক্ত হননি। কিন্তু এর মধ্যে অনেকেই বিভিন্নভাবে এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে যখন তালিকায় থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি ভাতা বরাদ্দ করা হয় এবং পাশাপাশি বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়, তখন রাজনৈতিক কারণে এই তালিকা দীর্ঘ হওয়া শুরু করে।
প্রাথমিকভাবে দুটি তালিকা পাওয়া যায়—একটি তালিকা ভারত প্রস্তুত করেছিল এবং আরেকটি তালিকা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ দ্বারা প্রস্তুত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছিল। তারপর তালিকা ক্রমবর্ধমান প্রসারিত হয়।
প্রশ্ন আসে, বীর মুক্তিযোদ্ধা কারা? মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছেন তাঁরা, যাঁরা জীবন বাজি রেখে রণাঙ্গনে অস্ত্র নিয়ে সরাসরি যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ওই সময়ে আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ সরকার গঠন করেন, যাঁরা কিনা যুদ্ধের সময়ে ভারতে নির্বাসনে থেকে রণাঙ্গনে থাকা যোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পাশাপাশি ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর এবং এর আগে–পরে হত্যার শিকার বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের এই তালিকায় যুক্ত করা যেতে পারে। বীরাঙ্গনাদের তালিকাটাও বিবেচনায় নিতে হবে।
এ ছাড়া এই মহান মুক্তিযুদ্ধে অনেকেই সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন—কেউ দেশাত্মবোধক গান গেয়ে, কেউ কবিতা লিখে, কেউ চা–পানি বা খাবার বিতরণ করে, কেউ আশ্রয় দিয়ে, তথ্য দিয়ে বা চিকিৎসাসেবা দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের জীবন ও সম্পদের ঝুঁকি নিয়ে। অনেক ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার কারণে তাঁদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল তৎকালীন পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসররা।
আবার অনেকেই বিদেশের মাটিতে বসে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ক্যাম্পেইন করেছিলেন, তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন এবং সংগৃহীত অর্থ মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ব্যয় করেছিলেন। তা ছাড়া অনেকেই ভারতে শরণার্থীশিবিরে বা অন্য কোনো জায়গায় নিরাপদে অবস্থান নিয়ে ভাতা নিয়ে সাধারণ জীবনযাপনে লিপ্ত ছিলেন। জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করা আর সহায়ক ভূমিকা পালন করাকে এক পাল্লায় মাপা উচিত নয়। সহায়ক মুক্তিযোদ্ধাদের অবশ্যই অবদান আছে তবে, তাঁদের ভিন্নভাবে স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে। তাঁর সঙ্গে রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করার মুক্তিযোদ্ধাকে কখনো একভাবে মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না।
অনেক দিন ধরেই আমাদের দেশে এই বিতর্ক চলছে এবং এটা একটা জাতীয় বিতর্কে পরিণত হয়েছে। বংশানুক্রমে মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিকসহ নানান সুযোগ-সুবিধা দেওয়া, চাকরি–বাকরি ও লেখাপড়ায় অন্তর্ভুক্ত করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে যে টাকাগুলো যাচ্ছে, এটা অনেক বড় অঙ্কের এবং আমাদের দেশের মতো একটা দেশে ৮০ হাজারের স্থলে যদি আড়াই লাখ বা তার বেশি অমুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারকে সহায়তা দিতে হয়, তাহলে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার বা তার অধিক মানুষের আর্থিক সহায়তা দেওয়া সরকারি কোষাগারের ওপর বড় একটা অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক চাপ। সে কারণেই এ তালিকার সত্যতা খতিয়ে দেখা উচিত।
যদিও ব্যাপারটি একটু স্পর্শকাতর, তারপরও এর যৌক্তিক সমাধান হওয়া উচিত।
সমাধানটা কীভাবে হতে পারে, তার একটা প্রস্তাবনা এখানে দেওয়া হলো। আমরা আমাদের দেশে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে এনআইডি প্রজেক্ট সম্পন্ন করেছি, যার মধ্যে পেশাদার লোকও ছিল। এখানে প্রস্তাব করতে চাই, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে এবং বিভিন্ন পেশাদার সংগঠনের সহযোগিতায়, মাঠপর্যায়ের বিভিন্ন লোককে একত্র করে, প্রয়োজনে গ্রাম থেকে ইউনিয়ন, ইউনিয়ন থেকে থানা, থানা থেকে জেলা, জেলা থেকে বিভাগ এবং বিভাগ থেকে সমগ্র বাংলাদেশ একসঙ্গে যাচাই–বাছাই করে এই মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সঠিক ও সুন্দর তালিকা প্রণয়ন করা যেতে পারে।
কাগজপত্র ঘেঁটে দেখার পাশাপাশি একটা চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করে, যাঁদের ছবি আছে, তাঁদের ছবিসহ একটি ডিরেক্টরি প্রকাশ ও সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা বা ভাতা যা–ই দিতে হয়, ওই ডিরেক্টরির সহযোগিতা নিয়ে দেওয়া যাবে। যাঁরা অমুক্তিযোদ্ধা এবং সনদ গ্রহণ করেছেন, তাঁদের নাম বাদ দিয়ে, তাঁদের সুবিধা ফেরত নেওয়াসহ যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। একজন উপদেষ্টার মন্তব্য শুনেছি। উনি বলেছেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় যদি কোনো অমুক্তিযোদ্ধা অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। তাঁর এ উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
আমরাও মনে করি, অমুক্তিযোদ্ধাদের শাস্তি হওয়া উচিত। কেননা, তাঁরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে অন্যায় ও অবৈধভাবে আর্থিক, চাকরি-বাকরি ও অন্যান্য সুবিধা গ্রহণ করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বঞ্চিত করেছেন এবং রাষ্ট্রের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদের সহযোগী বা অন্যদের কী সুবিধা দেওয়া হবে, তা সরকারের বিষয় এবং এখানে সেটা আমরা আলোচনা করতে চাই না। সঠিক তালিকা প্রণয়ন এবং তা সংরক্ষণই এ আলোচনার মূল উদ্দেশ্য।
এই বৈষম্যমূলক আচরণের ফলে যাঁরা যোগ্য, তাঁরা নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যাহোক, বিলম্ব না করে এখনই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সঠিক তালিকা প্রণয়ন করা উচিত। সঠিক তালিকা জাতির জন্য অতি প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। তবে সঠিক তালিকা প্রণয়ন করা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। কারণ, ইতিমধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ প্রায় ৫৩ বছর পার করে ফেলেছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সঠিক কাগজপত্র ও দলিলাদি খুঁজে বের করা ও মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি সংগ্রহ করা এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা, অনেক মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছেন এবং অনেকেই আবার স্থান পরিবর্তন করেছেন। তবু হাল ছেড়ে না দিয়ে আমাদের উচিত হবে গ্রাম পর্যায়ে প্রবীণ বা বৃদ্ধদের কাছ থেকে তথ্য, সাক্ষ্য, প্রমাণসহ তখনকার কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে তাঁদের অবদান সংগ্রহ করে নথিভুক্ত করা।
আগের দলমত-নির্বিশেষে সঠিক তথ্য নিয়ে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করাই আমাদের উপযুক্ত কাজ বলে মনে করি। কাজটি আমাদের আগেই করা উচিত ছিল, কিন্তু পারিনি। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’, তবে এখনো সঠিকভাবে তালিকা প্রণয়ন করে এই বিতর্কের অবসান ঘটানো সম্ভব।
এ জাতির জন্য যাঁরা জীবন হারিয়েছেন, ত্যাগ করেছেন, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করেছেন, সেটাও আমাদের মনে রেখে তাঁদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করার ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে বলে আমার মনে হয় না। আমরা সবাই তাঁদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি এবং ভবিষ্যতেও করব। এই বাঙালি জাতি সারা জীবন তাঁদের স্মরণ করবে। এটা আমাদের দায়বদ্ধতা এবং অঙ্গীকার।
এ এফ নেছারউদ্দিন এফসিএ, হোদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানির সিনিয়র পার্টনার এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট, আইসিএবি।