র‍্যাব বিলুপ্ত করার এখনই উপযুক্ত সময়

একটার পর একটা ‘ক্রসফায়ার’-এর ঘটনা ঘটত। এরপর র‍্যাবের তরফ থেকে দেওয়া হতো প্রেস রিলিজ। সেই প্রেস রিলিজে নিহত ব্যক্তির নাম, ঘটনাস্থল আর সময়ের ভিন্নতা ছাড়া প্রায় একই রকম ঘটনার বর্ণনা থাকত। প্রেস রিলিজে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে অনেকের মনেই হয়তো প্রশ্ন তৈরি হতো। কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। একসময় প্রেস রিলিজ দেওয়া বন্ধ হলো, কিন্তু ‘ক্রসফায়ার’ চলতে থাকল।

২০০৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এভাবেই চলেছে র‍্যাবের ‘ক্রসফায়ার’। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগে র‌্যাব এবং এর কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ। এরপর লক্ষণীয়ভাবে র‍্যাবের ‘ক্রসফায়ার’ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এরই মধ্যে এ বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে প্রায় ৩ হাজার মানুষ। (র‍্যাব প্রতিষ্ঠার ২০ বছর: অন্তত ২,৯৫৪ বিচারবহির্ভূত হত্যা, ডয়চে ভেলে বাংলা, ৪ নভেম্বর ২০২৪)

বিএনপি আমলে শুরু, আওয়ামী লীগ আমলে আরো আক্রমণাত্মক

২০০৪ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ‘এলিট ফোর্স’ ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) গঠন করা হয়েছিল। সেই আমলে তৎকালীন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এ বাহিনী গঠনকে তাঁদের একটি ‘সাফল্য’ হিসেবে অভিহিত করতেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও সন্ত্রাস দমনে র‍্যাবের ভূমিকা নিয়ে তাঁরা ছিলেন প্রশংসামুখর।

দুই দশক পরে এসে তাঁদের (বিএনপি) এখন ‘ভিন্ন’ উপলব্ধি হচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তুলে পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাছে নিজেদের গড়া র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে বিএনপি। (নিজেদের গড়া র‍্যাবের বিলুপ্তি চায় বিএনপি, দেশ রূপান্তর, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪)

বিএনপির এই ‘বোধোদয়’ এবং র‍্যাব বিলুপ্তির সুপারিশের জন্য দলটির নীতিনির্ধারকেরা সাধুবাদ পেতে পারেন। কিন্তু এত দিনে বহু ঘটনা ঘটে গেছে, বহু মানুষের প্রাণ গেছে, বহু পরিবার তছনছ হয়ে গেছে। র‍্যাবের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো, ‘ক্রসফায়ার’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালানো।

লক্ষণীয় হলো, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলেই ‘ক্রসফায়ার’ শুরু হয়েছিল। সেই সময় কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করা হয়। এতে সাময়িকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিল এবং বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীন জনগণের সমর্থনও পাওয়া গিয়েছিল।

কিন্তু কিছুদিন পর থেকে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও র‍্যাবের লক্ষ্যবস্তু হতে থাকেন। শুরুর কয়েক বছরে র‍্যাবের হাতে র‍্যাডিক্যাল বামপন্থী দলগুলোর বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা নিহত হন। কিন্তু এ ধরনের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে তখন কেউ তেমন কোনো উচ্চবাচ্য করেনি।

২০০৬ সালে চারদলীয় জোট সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করে এবং ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়। এ সরকারের আমলেও র‍্যাবের তৎপরতা ছিল প্রায় একই রকম। এরপর ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ; র‍্যাবের ভূমিকা হতে থাকে আরও বেপরোয়া ও আক্রমণাত্মক; ‘ক্রসফায়ারের’ পাশাপাশি শুরু হয় গুম।

শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনামলে (২০০৯-২৪) হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বারবার এমন অভিযোগ উঠেছে, র‍্যাব একটি ‘খুনে বাহিনী’ বা ‘দানবে’ পরিণত হয়েছে; একই সঙ্গে এ বাহিনী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। পরিহাসের বিষয় হলো, ১৮ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির নেতা-কর্মীরা ছিলেন এর অন্যতম ভুক্তভোগী।

র‍্যাব বিলুপ্ত করা নিয়ে ‘ঐকমত্য’

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগে ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মাথায় প্রথমবারের মতো র‍্যাব বিলুপ্তি করার পরামর্শ দিয়েছিল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। ২০০৯ সালের মে মাসে প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়েছিল, ‘ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরকে (ডিজিএফআই) বিলুপ্ত করার পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।’ (র‌্যাব ও ডিজিএফআই ভেঙে দিন: মানবাধিকার সংস্থা, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৮ মে ২০০৯)

সেই সময় র‍্যাব বিলুপ্ত করা তো দূরে থাক, আওয়ামী লীগ তার অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ পর্যন্ত নেয়নি। বরং অল্প কিছুদিনের মধ্যে ‘ক্রসফায়ারের’ সঙ্গে যুক্ত হয় গুমের ঘটনা। গত দেড় দশকব্যাপী শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে র‍্যাবের ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, গুমসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যান্য ঘটনা।

সম্প্রতি এসব ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ এবং ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন র‍্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমান। তিনি বলেছেন, ‘র‌্যাব সৃষ্টির পর থেকে যেসব জনসাধারণ র‌্যাব সদস্যদের দ্বারা নির্যাতিত, অত্যাচারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের কাছে এবং নারায়ণগঞ্জের সাত খুনসহ যাঁরা র‌্যাবের দ্বারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তাঁদের পরিবারের কাছে আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি এবং ক্ষমাপ্রার্থনা করছি।’ (সাত খুনসহ নানা ঘটনায় ক্ষমা চাইল র‌্যাব, স্বীকার করল আয়নাঘরের কথা, প্রথম আলো, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪)

একটা বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে, গুম-খুনসহ এরকম ফৌজদারি এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়ে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে দায়ী র‍্যাবের কর্মকর্তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। এর পাশাপাশি র‍্যাব বিলুপ্ত করার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। ভুক্তভোগীদের স্বজনেরা সে রকমটাই দাবি করেছেন। (র‌্যাব বিলুপ্তির দাবি গুম হওয়া পরিবারের, যুগান্তর, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। এ ছাড়া গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনও গুমের ঘটনায় জড়িতদের বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুসহ র‍্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে। (গুমের নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা, প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিশন, প্রথম আলো, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪)

বিএনপির মতো একটি বড় রাজনৈতিক দলের চাওয়া এবং গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের দাবির পাশাপাশি গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সুপারিশ হলো র‍্যাব বিলুপ্ত করা। এ থেকে স্পষ্ট, র‍্যাব বিলুপ্ত করার বিষয়ে জনগণের একটা বড় অংশের মধ্যে একধরনের ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের কালক্ষেপণ করা বা সময় নষ্ট করার কোনো সুযোগ নেই; সেই রকম কিছু হলে তাদের সদিচ্ছা বা উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তাছাড়া রাজনৈতিক সরকার দায়িত্ব নিলে এ বিষয়টি ঝুলে যেতে পারে বা অনিশ্চয়তা তৈরি পারে, সেই আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায়না। এ কারণে র‍্যাব বিলুপ্ত করা বা ভেঙে দেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।

  • মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক