‘না-পাওয়া’ সাড়ে তিন লাখ কী করবে?

‘পরীক্ষার্থী ১০ জনের ৯ জনই প্রায় জিপিএ ফাইভ পায় না। আর ১০ জনের ২ জনের মতো অকৃতকার্য হয়।’ছবি: প্রথম আলো

এ বছর ১১টি শিক্ষা বোর্ডে ২০ লাখ ১৩ হাজার ৫৯৭ জন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক ও সমমানের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেয়, তাদের মধ্যে ১৬ লাখ ৭২ হাজার ১৫৩ জন পাস করেছে। জিপিএ ফাইভ পেয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজারের কিছু বেশি। এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৩ লাখ ৪১ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি।

যারা জিপিএ ফাইভ পেয়েছে, তাদের সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য বিশাল আয়োজনে আমরা এরই মধ্যে যুক্ত হয়ে পড়েছি। উইনার্স টেক অল। মেধাবীদের সম্মান জানানো উচিত। তাতে ভালো ফল করার জন্য অন্যরা উৎসাহিত হয়।

কিন্তু যে তিন লাখের বেশি ছেলেমেয়ে পাসই করতে পারল না, তাদের কথা কে ভাববে? গণসাক্ষরতা অভিযান ১১ জুন ২০২৪ রাজধানীর একটি মিলনায়তনে দিনব্যাপী আয়োজন করেছিল ‘চ্যালেঞ্জড শিক্ষার্থী’ সম্মেলনের। যারা এ বছর মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হতে পারেনি, এমন শিক্ষার্থী, তাদের অভিভাবক ও শিক্ষকেরা এই সম্মেলনে যোগ দেন। আরও যোগ দেন শিক্ষাবিদ, নীতিনির্ধারক ও শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিজন।

এ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। সরাসরি শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকদের কথা শুনে মুদ্রার অন্য পিঠটা খানিক দেখা এবং তা নিয়ে ভাবার একটা বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ভালো ফলের কি দরকার নেই? অবশ্যই দরকার আছে। ভালো ছাত্ররাই আমাদের জন্য করোনার টিকা আবিষ্কার করে, আমাদের জন্য সেতু কিংবা জাহাজের নকশা করে দেয়, কম্পিউটারে বিপ্লব ঘটায়, আমাদের মুখের অন্ন জোগানোর জন্য অসাধারণ সব গবেষণা করে—ভালো ডাক্তার, ভালো ইঞ্জিনিয়ার, ভালো বিজ্ঞানী, ভালো গবেষক, ভালো কৃষিবিদ, ভালো ব্যাংকার, ভালো রাজনীতিক, ভালো ব্যবসায়ী হওয়ার জন্য পড়াশোনা করা, পরীক্ষায় ভালো করার খুবই দরকার আছে। সে জন্যই পরীক্ষায় যারা সফল হয়, তাদেরকে আমরা সংবর্ধনা দিই।

আমরা সব সময়ই বলে এসেছি, পরীক্ষার সাফল্য আর জীবনের সাফল্য সমার্থক নয়। আমার নিজের উপলব্ধি হলো, জীবন কখনো ব্যর্থ হয় না। অন্যের ক্ষতি না করলেই হলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটা গানে বলেছিলেন:
ও জোনাকী, কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ।
আঁধার সাঁঝে বনের মাঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছ॥
তুমি নও তো সূর্য, নও তো চন্দ্র, তোমার তাই ব’লে কি কম আনন্দ।
তুমি আপন জীবন পূর্ণ ক’রে আপন আলো জ্বেলেছ॥
জোনাকি ছোট, কিন্তু তার জীবন সূর্য-চাঁদের মতোই সফল। কারণ, চাঁদ আর সূর্যের মতো জোনাকিও আলো জ্বালে। ছোট কিংবা বড় আসল কথা নয়, আলো জ্বালানোর চেষ্টা করলাম কি না, এইটাই আসল কথা। দুর্জন বিদ্বানও এ জীবনে কম দেখলাম না! পিএইচডি করা রত্নাকর দেখলাম, আবার পলান সরকারের মতন আলোকসঞ্চারী মানুষও দেখলাম।

ভালো ফলের কি দরকার নেই? অবশ্যই দরকার আছে। ভালো ছাত্ররাই আমাদের জন্য করোনার টিকা আবিষ্কার করে, আমাদের জন্য সেতু কিংবা জাহাজের নকশা করে দেয়, কম্পিউটারে বিপ্লব ঘটায়, আমাদের মুখের অন্ন জোগানোর জন্য অসাধারণ সব গবেষণা করে—ভালো ডাক্তার, ভালো ইঞ্জিনিয়ার, ভালো বিজ্ঞানী, ভালো গবেষক, ভালো কৃষিবিদ, ভালো ব্যাংকার, ভালো রাজনীতিক, ভালো ব্যবসায়ী হওয়ার জন্য পড়াশোনা করা, পরীক্ষায় ভালো করার খুবই দরকার আছে। সে জন্যই পরীক্ষায় যারা সফল হয়, তাদেরকে আমরা সংবর্ধনা দিই।

কিন্তু যারা সফল হয় না, তাদের সংখ্যা বিপুল। পরীক্ষার্থী ১০ জনের ৯ জনই প্রায় জিপিএ ফাইভ পায় না। আর ১০ জনের ২ জনের মতো অকৃতকার্য হয়।

সংখ্যা কিংবা শতকরা হার এক জিনিস, আর আপনার সামনে দাঁড়িয়ে একজন অকৃতকার্য শিক্ষার্থী কথা বলছেন, তা আরেক জিনিস। শিপ্রা রানী নামের একজন শিক্ষার্থী এসেছেন পঞ্চগড় থেকে। দাঁড়িয়ে মাইক হাতে বললেন তাঁর কথা। এত সুন্দর তাঁর বাচনভঙ্গি, এত গোছানো তাঁর কথা। তিনি জানালেন, পরীক্ষার সময় তাঁর কী অসুবিধা ছিল। তিনি একটা বিষয়ে এ পেয়েছেন, বাকি সব কটা এ+ পেয়েছেন, শুধু রসায়ন বিষয়ে ‘ফেল’ করেছেন। তাঁর ওই দিন কী কী অসুবিধা ছিল তা জানিয়ে তিনি বললেন, তারপরও আমি পরীক্ষা ভালো দিয়েছিলাম। ‘ফেল’ করার কোনো কারণ ছিল না।

আমি এই মেয়েটির হয়ে তাঁর পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। তিনি কিন্তু জিপিএ ফাইভই আশা করছিলেন। কিন্তু যখন ফল বেরোল, দেখা গেল, তিনি ফেল করেছেন।

শিলা আস্তা নামের দিনাজপুরের পার্বতীপুরের একজন শিক্ষার্থী জানান যে তিনি ইংরেজিতে অকৃতকার্য হয়েছেন। বাবা ও মা দুজনেই কৃষিকাজ করেন। শিলাকেও তাদের কৃষিকাজে সহযোগিতা করতে হয়। ‘আমি সাঁওতাল সম্প্রদায়ের হওয়ায় স্কুলের শিক্ষকদের লেকচার স্পষ্ট বুঝতে পারতাম না। যে কারণে পরীক্ষায় ফেল করি। আমার মতো অন্য যারা আছেন, তাদের জন্য আমাদের নৃগোষ্ঠী থেকে গৃহশিক্ষক কিংবা স্কুলে শিক্ষক পেলে আমাদের পরবর্তীতে পরীক্ষায় ভালো করা সহজ হবে।’

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী এই সম্মেলনের আমন্ত্রণ জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার কারণে অনেক শিক্ষার্থীকেই পরিবার ও সমাজের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়। তারা প্রায়শ হীনম্মন্যতায় ভোগে ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়ে থাকে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এটি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির বার্তা বহন করে। নিঃসন্দেহে এ পরিস্থিতি দুর্ভাগ্যজনক এবং কোনো সচেতন নাগরিকের পক্ষে মেনে নেওয়া কষ্টকর।

‘নির্দ্বিধায় বলা যায়, পরীক্ষার ফল শুধু শিক্ষার্থীর লেখাপড়া বা প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করে না। এ জন্য পরিবার, সমাজ, বিদ্যালয়, বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা, ব্যবস্থাপনাও দায়ী।’
ওই সম্মেলনে দেখা গেল, অনেক মেয়ে উপবৃত্তি পায় না। রাশেদা কে চৌধূরী জানালেন, মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি সর্বজনীন। কেন উপবৃত্তি পায় না একজন নারী শিক্ষার্থী?
উপস্থিত একজন শিক্ষক তিনটা সমস্যার কথা জানালেন।

এক. অনলাইনে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বৃত্তির তালিকা আসে। দেখা যায়, ১০০ জনের মধ্যে ২০ জন ছেলের নাম চলে এসেছে।

দুই. মোবাইলে টাকা আদান-প্রদানের জন্য একটা নির্দিষ্ট কোম্পানির গ্রাহক হওয়া বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে অনেক শিক্ষার্থী বৃত্তির টাকা পায় না।
তিন. কারিগরি জটিলতা। মোবাইলে তথ্য দেওয়ার পরে বার্তা আসে, আপনার তথ্য ম্যাচ করেনি।

সব মেয়েশিক্ষার্থী উপবৃত্তি পাচ্ছে না, এটা স্পষ্ট। বিষয়টি নিয়ে একটা সার্ভে হওয়া উচিত। কেন সর্বজনীন বৃত্তি সব ছাত্রী পাচ্ছে না? কারিগরি কারণে বৃত্তির টাকা শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছাচ্ছে না, এটা মেনে নেওয়া যায় না।

এই সম্মেলনের সুপারিশগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া দরকার। সুপারিশের মধ্যে আছে, ‘পরীক্ষার আগে প্রস্তুতিমূলক শিক্ষা কার্যক্রমে সব শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, ফলাফল প্রকাশের পরপরই অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিদ্যালয়ভিত্তিক অনুপ্রেরণামূলক কাউন্সেলিং সভার আয়োজন, অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত করার ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যয় কমিয়ে এনে সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা চালু, বিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষক বাড়ানো এবং প্রতিটি বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করা।

আরও পড়ুন

‘এ ছাড়া শতভাগ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়া এবং শিক্ষার্থীপিছু ন্যূনতম ৫০০ থেকে পর্যায়ক্রমে ১ হাজার টাকায় উন্নীত করা, সব বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা চালু করা, মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়ার জন্য উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ করা, বিদ্যালয় মনিটরিং শক্তিশালী করা এবং অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরা যাতে ঝরে না পড়ে, বিশেষ করে শিশুশ্রম এবং বাল্যবিবাহ রোধে অভিভাবকদেরও সচেতন করতে হবে।’ (প্রথম আলো, ১২ জুন ২০২৪)

এই সম্মেলনে গিয়ে আবারও উপলব্ধি করা গেল, বাংলাদেশে বৈষম্য খুবই প্রবল। ধনী-গরিব, রাজধানী-প্রত্যন্ত এলাকা, বাঙালি-নৃগোষ্ঠী, নারী-পুরুষ যে বৈষম্য, তার কুফল শিক্ষাক্ষেত্রেও মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে প্রতিজ্ঞার কারণে মুক্তিযুদ্ধ, তা থেকে আমরা ক্রমাগত সরে যাচ্ছি। এবার সময় হয়েছে ঘুরে দাঁড়ানোর।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক