আমরা মুখে যতই বলি ‘বিয়ে-ডিভোর্স ব্যক্তিগত বিষয়’; ঘটনা আসলে তা না। আদতে বিয়ে হয় ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে, ছাড়াছাড়িও ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে; কিন্তু বিয়ে অথবা ছাড়াছাড়ির প্রভাব আর ব্যক্তিগত জায়গায় থাকে না।
ব্যক্তির পরিচিতির দৌড় যদি একটা গ্রাম বা মহল্লার সীমায় আটকা থাকে, তাহলে তার বিয়ে বা ছাড়াছাড়ির খবর সেই গ্রাম বা মহল্লার গরম খবর হয়ে ওঠে।
ব্যক্তি যখন জাতীয় পর্যায়ের সেলিব্রেটি হন, তখন তাঁর বিয়ে-ডিভোর্স ‘জাতীয় আলোচনা’র বিষয় হয়ে ওঠে। আর সেই ব্যক্তি যদি হন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, তখন তা ‘টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ না হয়ে পারে না।
ট্রুডো ও তাঁর স্ত্রী সোফি গ্রেগরি ছাড়াছাড়ির কাগজপত্রে সই করেছেন বলে খবর বের হওয়ার পর তাঁদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিস্তর চর্চা হচ্ছে।
পশ্চিমে বিবাহ বিচ্ছেদ ‘জলভাত’ হলেও দেড় যুগের বিবাহিত জীবনে ৩ সন্তানের জনক-জননী হওয়া ট্রুডো-সোফির বিচ্ছেদে বিশ্ববাসী যে খানিকটা ধাক্কা খেয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। সম্ভবত বিশ্ববাসীর কাছে এই জুটি ‘মোরা আর জনমে হংসমিথুন ছিলাম’ টাইপের প্রেমিক যুগল ও সুখী দম্পতির রোল মডেল হয়ে ওঠায় তাঁদের নিয়ে আলোচনা বেশি হচ্ছে।
আমাদের বাঙালি মানস শিক্ষিত ও পরিণত বয়সের দম্পতির ডিভোর্সকে কোনোকালে সহজভাবে নিতে পারেনি। আজও পারে না। আর তা পারে না বলেই ট্রুডো-সোফির ছাড়াছাড়ির মতো একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে তাদের কৌতূহল মোটেও কম নয়।
বিশ্ব সংবাদমাধ্যম এই বিচ্ছেদের খবর বড় করে প্রচার করেছে। কারণ, এই ডিভোর্স কোনো ‘একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়’ নয়। এই ছাড়াছাড়ির সঙ্গে ট্রুডোর রাজনৈতিক ভবিষ্যতের বিষয়ও জড়িয়ে আছে।
ইতিমধ্যে নিউইয়র্ক টাইমসসহ প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমে ট্রুডোর বিচ্ছেদ নিয়ে বিশ্লেষকেরা মতামত লিখেছেন। কেউ বলছেন, এটি তাঁর ব্যক্তিজীবনের ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে যা তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কেউ বলছেন, দিন শেষে এটি সে ধরনের কোনো প্রভাব ফেলবে না।
ট্রুডো ও সোফি—এই দুজন রক্ত-মাংসের মানুষের মধ্যে যে আবেগ-অনুভূতি ও মান-অভিমানের মতো অবৈষয়িক বিমূর্ত বিষয় থাকতে পারে, রুচির অতি সূক্ষ্ম পার্থক্য যে তাঁদের এই বিচ্ছেদের দিকে ঠেলে আনতে পারে, তা রাজনীতি ও অর্থের তুলাদণ্ডে মাপায় অভ্যস্ত সাধারণ জনমানস একেবারেই ভুলে বসে আছে।
বছর কয়েক আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ‘বেলা শেষে’ নামের একটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। শিবপ্রসাদ মুখার্জি ও নন্দিতা রায় পরিচালিত ওই ছবিতে দেখা যায় ছবির প্রধান চরিত্র মিস্টার মজুমদার (এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) বিয়ের ৪৯ বছর পার করে এসে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি আর তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে (স্ত্রীর ভূমিকায় ছিলেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত) সংসার করবেন না।
মিস্টার মজুমদার ডিভোর্স চান। সংসারে তাঁর ছেলে মেয়ে-নাতি নাতনি আছে। সংসারে কোনো অশান্তি নেই। স্ত্রীকে তিনি ভালোবাসেনও; তারপরও এত বছর সংসার করার পর তিনি ডিভোর্স চান। এ নিয়ে মজুমদার দম্পতি আদালতে পর্যন্ত যান। মিস্টার মজুমদার কেন ডিভোর্স চাইছেন, সেই কৌতূহলই দর্শককে গল্পের পরিণতি দেখার আশায় টেনে রাখে।
ছবিটিতে অবশ্য শেষ পর্যন্ত মজুমদার দম্পতির বিচ্ছেদ হয় না। বাঙালি মানস বিবাহবিচ্ছেদকে বেদনার ও ব্যর্থতার নিরিখে দেখতে অভ্যস্ত। হয়তো এ কারণেই ছবির কাহিনিকার কেন্দ্রীয় চরিত্রকে একজন ব্যর্থ মানুষ হিসেবে দেখাতে চাননি; ফলে ছবির আনন্দসূচক পরিণতি হিসেবে মজুমদার দম্পতিকে পৃথক করা হয়নি।
কিন্তু দাম্পত্যে ছাড়াছাড়ি কি সব সময়ই বেদনার? পশ্চিমে হয়তো সর্বাংশে তা নয়। কারণ বার্ধক্যে এসে, এমনকি প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেও অনেক দম্পতি সেখানে ডিভোর্সের জন্য আদালতে যাচ্ছেন। দুই-তিন দশক পরস্পরের সান্নিধ্যে কাটিয়েও বিদ্যমান সম্পর্ককে তাঁরা আর বহন করতে পারছেন না। ছাড়াছাড়ি তাঁদের কাছে নিষ্কৃতি হয়ে ধরা দিচ্ছে।
হয়তো সেই সম্পর্ক উভয়ের কাছে আরোপিত ও জোর করে টিকিয়ে রাখা বলে প্রতিভাত হয়েছে। তাই সেই আরোপিত সম্পর্ককে নিষ্প্রাণ কর্তব্যের ভার হিসেবে বহন করতে করতে একটা পর্যায়ে এসে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। সময় যত ফুরাতে থাকে, বয়স যত অস্তগামী হয়, ‘জীবন মহার্ঘ’—এই বোধটি ততই তীব্র হতে থাকে।
ফলে বিয়ে এবং বিচ্ছেদ বিষয়ক প্রচলিত ধারণা বদলে যাচ্ছে। এ কারণেই হয়তো ‘বেলা শেষে’র মিস্টার মজুমদার ছেলেমেয়েদের সামনে স্ত্রীকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা জানানোর পর মিসেস মজুমদারের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘এত দিনে মুক্তি!’
অনেক পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের আড়ালে রয়েছে একাকিত্বের এক অতি মিহি আবরণ। কখনো বা বাইরের দৃশ্যমান সত্যের তুলনায় আবডালে থাকা অন্তর্নিহিত সত্য ততোধিক করুণ। উপেক্ষানির্ভর অবমাননা, উদাসীনতা অগণিত দাম্পত্যকে অসহনীয় করেছে।
হয়তো সেই সম্পর্ক উভয়ের কাছে আরোপিত ও জোর করে টিকিয়ে রাখা বলে প্রতিভাত হয়েছে। তাই সেই আরোপিত সম্পর্ককে নিষ্প্রাণ কর্তব্যের ভার হিসেবে বহন করতে করতে একটা পর্যায়ে এসে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। সময় যত ফুরাতে থাকে, বয়স যত অস্তগামী হয়, ‘জীবন মহার্ঘ’—এই বোধটি ততই তীব্র হতে থাকে।
ট্রুডো ও সোফি বলেছেন, তাঁরা আলাদা হলেন বটে, কিন্তু তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকবে। তিন সন্তান যাতে নিরাপদে ও ভালোবাসা নিয়ে বড় হয়, সেটা নিশ্চিত করতে মনোযোগী হবেন তাঁরা।
তাই ট্রুডো ও সোফির এই ছাড়াছাড়ির মধ্যে যে প্রেম নেই, তা কে বলতে পারে? প্রেম নিয়েই বিচ্ছেদ হতে পারে।
আমাদের বাঙালি সমাজে ‘ডিভোর্স’ কথাটা যখন খুব একটা পরিচিত হয়ে উঠতে পারেনি, তখন সুবোধ ঘোষের কাহিনি থেকে তপন সিংহ বানিয়েছিলেন ‘জতুগৃহ’ ছবিটি।
সেখানে শতদল (উত্তম কুমার) ও মাধুরী (অরুন্ধতী দেবী) প্রধান দুই চরিত্র। তাঁরা স্বামী স্ত্রী। উভয়েই সফল মানুষ। সুন্দর মানুষ। কিন্তু জীবনের একটি পর্যায়ে এসে তাঁরা আবিষ্কার করলেন, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, অন্তরের অতৃপ্তি, ছোটখাটো বিরক্তি ধীরে ধীরে তাঁদের দাম্পত্যকে অর্থহীন করে তুলেছে।
শতদল ও মাধুরী ভেতর থেকে বুঝতে পেরেছিলেন, ভালোবাসার জোরটা আগের মতো নেই। তাই পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাঁরা সরে দাঁড়ান। পাঁচ বছর পর একটি রেল স্টেশনে যখন তাঁদের দেখা হয়, তখন তাঁরা উপলব্ধি করতে পারেন, তাঁদের একে অপরের প্রতি ভালোবাসা মরে যায়নি।
তাঁরা আবিষ্কার করেন, পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা জীবনের ভিন্ন যাত্রাপথ নির্বাচন করেছিলেন।
যে সম্পর্কে দমন-পীড়ন নেই, প্রেমের অভাব ঘটেনি, সেখানেও সার্থকতর ও উন্নততর জীবনের আগ্রহ থেকে বিচ্ছেদ একটি সচেতন সিদ্ধান্ত হতে পারে। ট্রুডো ও সোফি হয়তো সেই উন্নততর পৃথক যাত্রাপথের পথিক হয়েছেন, যেখানে তাঁরা একজনের সঙ্গে আরেকজন না থেকেও থাকবেন।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ই-মেইল: [email protected]