দেশব্যাপী কনটেন্ট ব্লকিং কেন অকার্যকর কৌশল

যেকোনো দেশের জন্য ইন্টারনেট একটা লাইফলাইন। ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়া দেশের কী রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি সংসারের হালহকিকতও বদলে যায়। সেই ইন্টারনেট তথা তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে অনেক দেশ। কিন্তু ডিজিটাল এই যুগে তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা ক্রমেই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে।

আমাদের দেশের মতো অনেক দেশের সরকার এখনো দেশব্যাপী কনটেন্ট ব্লকিং করে এই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টা করেছে কদিন আগেও। তবে, এই পদ্ধতি কতটা কার্যকর, সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে। বরং এর পরিবর্তে ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এটা সেই সাক্ষরতা, যার মাধ্যমে মানুষই সিদ্ধান্ত নেবে কোন কনটেন্ট সত্যি বা মিথ্যা।

রাস্তায় নামলে যেভাবে একজন পাঠাগারে অথবা পানশালায় যেতে পারেন, সেখানে রাস্তা বন্ধ করার কার্যক্রম একটা অকার্যকর কৌশল।

কনটেন্ট ব্লকিংয়ের ইতিহাস বেশ পুরোনো। চীনের ‘গ্রেট ফায়ারওয়াল’ এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এর মাধ্যমে তারা ফেসবুক, গুগল, ইউটিউবের মতো পশ্চিমা ওয়েবসাইটগুলো ব্লক করে রেখেছে। ইরান ও উত্তর কোরিয়াও এ ধরনের কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করে। বাংলাদেশেও এই জিনিস এখনো চলমান। কিন্তু এই পদ্ধতি দিন দিন অকার্যকর হয়ে পড়ছে, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক দেশে।

ভিপিএন (ভার্চ্যুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক, একটা প্রযুক্তি যা সাধারণত কনটেন্ট ব্লকিংয়ের মধ্যে পড়ে না বা আটকানো যায় না) এবং প্রক্সির মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে নাগরিকেরা সহজেই এই বাধা অতিক্রম করতে পারছেন। বলা যেতে পারে, তুরস্কে টুইটার ব্লক করা সত্ত্বেও ভিপিএন ব্যবহার করে অনেকেই এই প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় রয়েছেন। বাংলাদেশেও একই জিনিস ঘটেছে বিগত দিনগুলোতে।

ইন্টারনেটের গ্লোবাল অ্যাকসেস ওপেননেসের কারণে একটা নির্দিষ্ট দেশে কনটেন্ট সম্পূর্ণভাবে ব্লক করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের মতো ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। যার ফলাফল অনেকটাই আত্মঘাতী হয়েছে।

সরকারগুলোর উচিত কনটেন্ট ব্লকিংয়ের মতো অকার্যকর কৌশল ফেলে দিয়ে নাগরিকদের ক্ষমতায়নের দিকে মনোযোগ দেওয়া। এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান পাওয়া যাবে। ব্লকিংয়ের বদলে সত্য মিথ্যা বোঝার দক্ষতা বৃদ্ধি দীর্ঘস্থায়ী ফল দেবে। সচেতন নাগরিক তৈরির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া জোরদার হবে।

এ পরিস্থিতিতে টেকজায়ান্ট অর্থাৎ গুগল ও মেটা (ফেসবুকের মূল কোম্পানি) সম্প্রতি নতুন কিছু প্রটোকল চালু করেছে, যা কনটেন্ট ব্লকিং এড়াতে সাহায্য করছে। তারা ডিএনএস-ওভার-এইচটিটিএস (ডিওএইচ) নামে একটা প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, যা ব্যবহারকারীদের ওয়েব ট্রাফিক এনক্রিপ্ট করে দেয়।

এতে ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী সংস্থা বা সরকারের পক্ষে কোন ওয়েবসাইট একজন ব্যবহারকারী দেখছেন, তা জানা কঠিন হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া তারা টর নেটওয়ার্কের সঙ্গে সহযোগিতা করছে, যা ব্যবহারকারীদের ‘অ্যানোনিমাস’ হিসেবে ইন্টারনেট ব্রাউজ করতে সাহায্য করে। এর পাশাপাশি ইন্টারনেটে ‘কুইক’–এর মতো প্রটোকল বাড়তে থাকায় কনটেন্ট ফিল্টারিং কোম্পানিগুলোর কাজ বাড়ছে।

যেসব দেশ এ ধরনের দেশব্যাপী কনটেন্ট ব্লকিং করে, তারা প্রায়ই আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখোমুখি হয়। যেমন রাশিয়া/চীন/মধ্যপ্রাচ্যের ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ নীতি নিয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে (https://www.nbcnews.com/news/amp/wbna31486856)।

এ ছাড়া ব্লকচেইনের মতো বিকেন্দ্রীভূত প্রযুক্তি এ ধরনের নিয়ন্ত্রণকে আরও কঠিন করে তুলেছে। একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজে নাগরিকদের অবাধে তথ্য পাওয়ার অধিকার থাকা উচিত। কনটেন্ট ব্লকিং এ অধিকারকে শুধু খর্ব করেই না, বরং বাক্স্বাধীনতাকে সীমিত করে।

এ পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন যে সরকারগুলোর উচিত ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া। এর ফলে নাগরিকেরা নিজেরাই অনলাইন তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করতে শিখবে। তারা তথ্যের সোর্স পরীক্ষা, ফ্যাক্ট চেকিং এবং একই বিষয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হবে।

ফিনল্যান্ডের উদাহরণ এ ক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে। তারা তাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘মিডিয়া লিটারেসি’ অর্থাৎ ইন্টারনেটের মতো নতুন মিডিয়ার ‘ব্যবহার প্রক্রিয়া’ অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর ফলে ছাত্রছাত্রীরা সহজেই ভুয়া খবর চিনতে পারছেন, যেকোনো তথ্যকে প্রশ্ন করার মানসিকতা গড়ে উঠেছে। এতে গুজব ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের বিরুদ্ধে সমাজ সচেতন হয়েছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ একটি আধুনিক ও উন্মুক্ত সমাজের জন্য দরকারি জিনিস।

এতে নতুন আইডিয়ার জন্ম হয়, সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ অনেক বড় হয়। বিভিন্ন ধারণার সংমিশ্রণে নতুন সৃজনশীলতার সৃষ্টি হয়, বিভিন্ন মতামতের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি হয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, মুক্ত তথ্যপ্রবাহের মাধ্যমে ব্যবসা ও উদ্যোক্তাদের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়।

সরকারগুলোর উচিত কনটেন্ট ব্লকিংয়ের মতো অকার্যকর কৌশল ফেলে দিয়ে নাগরিকদের ক্ষমতায়নের দিকে মনোযোগ দেওয়া। এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান পাওয়া যাবে। ব্লকিংয়ের বদলে সত্য মিথ্যা বোঝার দক্ষতা বৃদ্ধি দীর্ঘস্থায়ী ফল দেবে। সচেতন নাগরিক তৈরির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া জোরদার হবে।

পাশাপাশি মুক্ত তথ্যপ্রবাহের মাধ্যমে বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধি পাবে, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নয়নে সাহায্য করবে। তাই সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর উচিত একসঙ্গে কাজটা করা। এতেই গড়ে উঠবে একটা জ্ঞানভিত্তিক, মুক্তচিন্তার ও গণতান্ত্রিক সমাজ, যেখানে সক্রিয় অংশীদারত্বের ভিত্তিতে প্রতিটা নাগরিক ক্ষমতায়নে আসবেন।

  • রকিবুল হাসান টেলিকম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক বইয়ের লেখক এবং ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান লিংকত্রি-এর প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা