ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমের কৌশলগত লক্ষ্য কী

জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস একটি জার্মান ট্যাংক থেকে নামছেন। সামরিক সহায়তা হিসেবে ইউক্রেনের সেনাদের এই ট্যাংক দিচ্ছে জার্মানি
ছবি: এএফপি

চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের বিষয়ে বিশ্ব যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, তা আগামী দশকের বৈশ্বিক পরিসরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গঠন নির্ধারণে প্রধান অনুঘটক হবে।

বিশেষ করে যুদ্ধোত্তর ইউক্রেন পুনর্গঠনে রাশিয়া এবং বৈশ্বিক দক্ষিণের সম্ভাব্য ভূমিকার প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমা মিত্রজোটের নেওয়া পদক্ষেপ, ভাষ্য এবং পরিকল্পনা তাদের সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত লক্ষ্যগুলোকে দৃশ্যমান করবে।

প্রশ্ন হলো, পশ্চিমারা কি কেবল রাশিয়াকে পরাজিত এবং ন্যাটোকে অধিকতর প্রসারিত ও শক্তিশালী সংস্থা হিসেবে দেখতে চায়, নাকি ইউক্রেনে তারা এমন একটি ‘জয়’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যা অধিকতর শক্তিশালী ও সুরক্ষিত গণতন্ত্রনির্ভর এক নিরাপদ বিশ্ব গড়ে তুলতে সহায়তা করবে?

যদিও এই লড়াইয়ের ফলাফল এখন পর্যন্ত অনিশ্চিত, তথাপি পশ্চিমের কৌশলগত লক্ষ্যগুলো, বিশেষ করে ইউক্রেন জয়ী হলে রাশিয়ার সঙ্গে কীভাবে আচরণ করা হবে, তাকে কেন্দ্র করে প্রণয়ন করা হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, ওই পশ্চিমা কৌশলের পরিণতি হবে সুদূরপ্রসারী।

আরেকটি বড় প্রশ্ন হলো, পশ্চিমা মিত্ররা কি আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পুরো রাশিয়াকে সাজা দিতে চাইবে নাকি তার বদলে তারা শুধু প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের স্বৈরাচারী শাসনকে নিশানা করবে, যাতে রাশিয়ার সাধারণ জনগণের ওপর চাপানো নিষেধাজ্ঞার বোঝাকে হালকা করা যায়।

যুদ্ধের শুরুতে পশ্চিমা মিত্ররা জোর দিয়ে বলেছিল, জাতিসংঘের যুদ্ধসংক্রান্ত সনদ এবং গণতন্ত্র রক্ষা করাই তাদের প্রথম লক্ষ্য। কিন্তু বিগত বসন্তের শেষের দিকে কিছু মার্কিন কৌশলবিদ এবং কর্মকর্তা রাশিয়াকে স্থায়ীভাবে দুর্বল করাকে কৌশলগত লক্ষ্যের অগ্রাধিকার হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষে মত দেন। অবশ্য রাশিয়াকে স্থায়ীভাবে দুর্বল করার লক্ষ্যে তাঁরা পুতিন সরকারের স্থলে অন্য সরকার আনতে চান কি না, তা এখনো স্পষ্ট করেননি।

পশ্চিম মনে করে, ইউক্রেন সংঘাতের সামগ্রিক নিষ্পত্তির জন্য রাশিয়াকে ইউক্রেন পুনর্গঠন খরচের কিছু অংশ বহন করতেই হবে। কারণ, এই ধ্বংসযজ্ঞের শুরুটা রাশিয়াই করেছিল। পাশাপাশি রাশিয়ার জনগণের ওপর আরোপিত শর্তগুলোর তীব্রতার রাজনৈতিক প্রভাব থাকবে। তবে শর্তগুলো যত কঠোর হবে, রাশিয়ার চীনকে তত ঘনিষ্ঠভাবে আলিঙ্গন করার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। চীন ও রাশিয়া পরস্পরকে আঁকড়ে ধরলে একটি শক্তিশালী চীন-রাশিয়ান ব্লক তৈরি হবে এবং সেই ব্লক যুদ্ধোত্তর ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠতে পারে।

এ–জাতীয় জোটের প্রভাবকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। চীন ও রাশিয়া মিলে আলাদা ব্লক হলে যদিও চীন সেই ব্লকের কেন্দ্রীয় শক্তি হবে, কিন্তু রাশিয়ার তুলনামূলকভাবে ছোট জিডিপি দেখে দেশটির বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা, তার পারমাণবিক অস্ত্রাগারের আকার, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং তার বিশাল ভূখণ্ডের গুরুত্বকে তুচ্ছ করা উচিত হবে না।

এ ক্ষেত্রে পুতিন এবং তাঁর স্বৈরাচারী শাসনকে পশ্চিমারা যে চোখে দেখে থাকে, তার থেকে আলাদা চোখে রাশিয়ার সাধারণ জনগণকে দেখতে হবে। পুতিনের সরকার ও রাশিয়ার সাধারণ মানুষের সঙ্গে ভিন্নভাবে আচরণ করে—এমন কতকগুলো পদক্ষেপ নিতে হবে, যার কারণে বিশ্বের গণতন্ত্রগুলো পুতিনের সৃষ্টি করা একটি দীর্ঘমেয়াদি খারাপ ফল ঠেকিয়ে দেওয়া যাবে।

ইউরোপের কিছু নীতিনির্ধারক এখন দলমত–নির্বিশেষে সব রুশ নাগরিককে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ঢুকতে না দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু এ ধরনের ব্যবস্থা দেশটিকে চীনের দিকে ঠেলে দেবে।

বিভ্রান্তিকরভাবে বিশ্বকে গণতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্র—এই দুই ভাগে ভাগ করা হলে তা মেরুকরণের সৃষ্টি করবে। পুতিনের মতো একনায়কতন্ত্রকে মোকাবিলা করার সময় যেকোনো সফল কূটনৈতিক কৌশলের মূল উপাদান হবে রাজনৈতিক নেতা এবং সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে দেয়াল তুলে দেওয়া।

এটি সত্য, নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন মোকাবিলায় জাতিসংঘকে সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করতে দিচ্ছে না। কিন্তু পশ্চিমা মিত্ররা এই কাজটি করতে চেয়েছে। কিন্তু তারা তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক দক্ষিণের সঙ্গে পরামর্শ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। যুদ্ধোত্তর পরিকল্পনা প্রক্রিয়ায় তাদের সংশ্লিষ্ট রাখার চেষ্টাও খুব কমই করেছে।

এটা অবশ্যই সত্য যে বৈশ্বিক দক্ষিণের বেশির ভাগ দেশই গত মার্চ মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা দুটি নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল। এরপর পশ্চিমাদের স্বীকার করা উচিত ছিল, যুদ্ধের প্রতি উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনীহা রয়েছে। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার তিক্ত স্মৃতি এসব দেশকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়। স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় এই অঞ্চলের অনেক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন পেয়েছিলে। সেই স্মৃতিও তাদের রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া থেকে বিরত রাখতে সহায়তা করেছে।

অধিকন্তু, ইউক্রেন পুনর্গঠনের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম চালু করতে জুলাইয়ের শুরুতে পশ্চিমা মিত্ররা যে লুগানো সম্মেলনের আয়োজন করেছিল, সেখানে বৈশ্বিক দক্ষিণের কোনো দেশকে ডাকা হয়নি। কেউ যুক্তি দিতে পারে, এটি প্রাথমিকভাবে দাতাদের একটি সভা ছিল। কিন্তু সেখানে ধনী উপসাগরীয় দেশগুলোকে বাদ দেওয়া হয়েছিল; অন্যদিকে আলবেনিয়া এবং উত্তর মেসিডোনিয়ার মতো এমন কিছু দেশকে ডাকা হয়েছিল, যাদের দাতা দেশ হিসেবে ভূমিকা রাখার কোনো সামর্থ্যই নেই।

ইউক্রেন পুনর্গঠনে শত শত বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। এই উদ্যোগটি বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোকে সহায়তা দেওয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এ অঞ্চলের দেশগুলো এখনো ধনী দেশগুলোকে তাদের দীর্ঘস্থায়ী প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে চাপ দিয়ে যাচ্ছে। দরিদ্র দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন এবং অভিযোজন বাবদ প্রতিবছর ধনী দেশগুলো ১০ হাজার কোটি ডলার দিয়ে থাকে। ইউক্রেন পুনর্গঠনে তারা মনোযোগী হলে সেই সহায়তা দেওয়া হুমকিতে পড়বে।

অবশ্য ইউক্রেনের পুনর্গঠনে বৈশ্বিক দক্ষিণের ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোকে, বিশেষ করে যাদের নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে ভালো প্রযুক্তিগত সক্ষমতা রয়েছে, তাদের যুক্ত করতে পশ্চিমাদের খুব বেশি দেরি হবে না বলে মনে হয়।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • কেমাল দারবিশ তুরস্কের সাবেক অর্থমন্ত্রী এবং ইউএনডিপির প্রশাসক। তিনি ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের একজন সিনিয়র ফেলো।