পুতিন যেভাবে ইসরায়েলের কাছে ধরাশায়ী হচ্ছেন

ভ্লাদিমির পুতিন

ইসরায়েলে হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার পর কিছু পশ্চিমা বিশ্লেষক ও সংবাদমাধ্যম এই ধারণা প্রচার করতে শুরু করে যে ইউক্রেনের জন্য পশ্চিমাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা যাতে বিভক্ত হয়ে যায়, সে উদ্দেশ্যে রাশিয়া তেল আবিবের বিরুদ্ধে ইরান-সমর্থিত প্রতিরোধ অক্ষকে সংঘাতে নামিয়ে দিয়েছে।

অসমর্থিত সূত্রের খবরে বলা হয়, হামাস ও হিজবুল্লাহকে সামরিক ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তা করছে মস্কো। এ থেকে মনে হতে পারে, ইসরায়েলবিরোধী একটা রুশ কৌশলের জন্ম হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার কর্মকাণ্ডের দিকে ঘনিষ্ঠ দৃষ্টি দিলে ধারণাটি যে ভিত্তিহীন, সেটা প্রকাশ হয়ে যায়। যাহোক, এই অঞ্চলে ইসরায়েলের আগ্রাসী আচরণের বিপরীতে মস্কো একধরনের সংঘাত এড়ানোর জন্য চুপ থাকার কৌশল নিয়েছে।

সংঘাত এড়াতে চুপ থাকার কৌশল নেওয়ায় ইসরায়েল রাশিয়াকে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবক শক্তি হিসেবে দেখতে নারাজ। এভাবেই তেল আবিব হামাসের সঙ্গে লড়াইকে ইরান এবং নতুন একটি আঞ্চলিক ব্যবস্থা তৈরির সংঘাতে পরিণত করার সুযোগ হিসেবে নিয়েছে।

প্রকাশ্যে মস্কো ইসরায়েলের কিছু পদক্ষেপের নিন্দা জানানো সত্ত্বেও রাশিয়া ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করে আসছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইরানে কনস্যুলেট ভবনে হামলার নিন্দা জানিয়েছিল রাশিয়া। সেই হামলায় ইরানের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কমান্ডার নিহত হন। এ ক্ষেত্রে আগাম সতর্কতা জানানোর সুযোগ ছিল রাশিয়ার। তাতে করে ভবনটি থেকে সরে যাওয়ার সুযোগ পেতেন ইরানের সেনা কর্মকর্তরা।

কনস্যুলেটে হামলার ওই ঘটনা ইরান ও ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত শুরু হওয়ার সূচনাবিন্দু।

বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ব্যবস্থা সংস্কারের রাশিয়ার অবস্থান ন্যায্য হওয়া সত্ত্বেও ইসরায়েলের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র যে নতুন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করছে, তাতে নিশ্চুপ থাকছে রাশিয়া।

ইউক্রেন সংঘাতে রাশিয়া বিরাট অঙ্কের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মূল্য বহন করা সত্ত্বেও রাশিয়া শুধু ইসরায়েল যেন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা না করে, সে বিষয়ে সতর্ক করেছে। ইরানে সর্বশেষ ইসরায়েলি হামলায় রাশিয়ার কাছ থেকে কেনা ইরানে এস-৩০০ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

ইসরায়েলের দিক থেকে হামলার হুমকি অব্যাহত থাকার পরও রাশিয়া ইরানকে যুদ্ধবিমান, অগ্রসর প্রযুক্তির প্রতিরক্ষাব্যবস্থাসহ অন্যান্য অস্ত্র হস্তান্তর করেনি। এ ছাড়া রাশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার সাবেক সোভিয়েত শিবিরের দেশগুলো ইসরায়েলবিরোধী কর্মকাণ্ড দমনের পাশাপাশি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধমূলক আক্রমণ না করে, সে জন্য ইরানকে নিবৃত্ত করে চলেছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর, মধ্য এশিয়ার এসব দেশ তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে সাহসী অবস্থান নিয়েছে। প্রযুক্তি ও অর্থের সংস্থানের জন্য তারা আরও স্বাধীন উৎসের প্রতি ঝুঁকছে। সম্ভবত ইসরায়েল তাদের প্রধান একটি বিকল্প হতে পারে।
ইসরায়েলের বিশেষজ্ঞরা মধ্য এশিয়াকে তাঁদের নতুন প্রভাব তৈরির ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ইসরায়েল তাদের কথিত শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের নীতি বিকাশের পথ হিসেবে একে নিয়েছে।

কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের একটা ট্রোজান হর্স (ট্রয় নগরীর কাঠের ঘোড়া) হিসেবে দেখা দরকার। এই কৌশলের মাধ্যমে প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সহায়তা শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে মুসলিম–অধ্যুষিত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে রাশিয়ার অক্ষ থেকে বের করে আনা।

ইসরায়েলের প্রতি রাশিয়ার সংঘাত এড়ানোর জন্য চুপ থাকার কৌশল চারটি বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে। প্রথমত, রাশিয়া ও ইরানের জাতীয় ভূখণ্ডে সরাসরি কোনো সামরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে না, সেই ট্যাবু ভেঙে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেন ও ইসরায়েল—এই দুই প্রক্সিকে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সেটা করে চলেছে।

দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র চায় এমন একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্য তৈরি করতে, যেখানে চীন ও রাশিয়ার প্রাধান্য ও প্রভাব খর্ব হবে। এ ক্ষেত্রে ইসরায়েল তাদের প্রক্সি শক্তি হিসেবে কাজ করছে। এই পরিস্থিতিতে সিরিয়ায় রুশ সেনাদের ওপর ইসরায়েলি কিংবা ইউক্রেনীয় হামলা হতে পারে, এমন ধারণা অবাস্তব বলে মনে হয় না।

তৃতীয়ত, ইরানের সামরিক স্থাপনা ও অস্ত্রভান্ডারে ইসরায়েলের সরাসরি হামলা ইউক্রেন সংঘাতে রাশিয়াকে অস্ত্র জোগান দেওয়ার ক্ষেত্রে ইরানের সক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমে যাবে। সেটা ইরান ও রাশিয়া দুই দেশকেই আরও নাজুক অবস্থায় ফেলবে।

চতুর্থত, রাশিয়াকে ইসরায়েল তার প্রতিপক্ষের মিত্র ও সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে দেখছে। ইসরায়েল মনে করে, রাশিয়া ইরান এবং ইরানের প্রক্সি শক্তি হামাস, হিজবুল্লাহ ও হুতিদের সহায়তা করছে। ইসরায়েলে যে বড়সংখ্যক রুশ প্রবাসী আছেন, তাঁরা দিন দিন রাশিয়ার প্রতি সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠছেন। ফলে তাঁরা আর খুব বেশি দিন মস্কোর জন্য রাজনৈতিক হাতিয়ার বা সফট পাওয়ার হিসেবে থাকবেন না।

সর্বোপরি, এ অঞ্চলে রাশিয়া আগে যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব তৈরি করেছিল, সেটা ধীরে ধীরে কমে আসছে। মস্কোর পররাষ্ট্রনীতি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ও অস্পষ্টতার মুখে পড়েছে।

বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ব্যবস্থা সংস্কারের রাশিয়ার অবস্থান ন্যায্য হওয়া সত্ত্বেও ইসরায়েলের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র যে নতুন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করছে, তাতে নিশ্চুপ থাকছে রাশিয়া।

এখানে বিষয়টি শুধু ইরান ও প্রতিরোধের অক্ষকে রাশিয়া সহায়তা করছে কি করছে না, তাতে সীমাবদ্ধ নয়। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি নিপীড়ন বিবেচনায় নিয়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতিতে কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি না থাকাটাই এখানে প্রধানভাবে দায়ী। ইসরায়েলের নির্বিচারে বেসামরিক লোকদের হত্যা করছে, টার্গেটেড হত্যা করছে, বিভিন্ন দেশে গিয়ে ইচ্ছেমতো বোমা ফেলে আসছে। তাদের বাধা দেওয়ার, তাদের থামানোর কেউ নেই।

  • ফারদিন ইফতেখারি, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক অধ্যয়ন বিভাগে পিএইচডি ক্যান্ডিডেট, মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত