বাইডেন প্রশাসন ও তার বশংবদ কর্মকর্তারা একরকম ধনুর্ভঙ্গ পণ করে বসে আছেন যে তাঁরা ফিলিস্তিন বিষয়ে অসত্য বলে যাবেন।
এতে করে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েল যে অপরাধ করে চলেছে, তা ধামাচাপা দেওয়া যাবে। মাঝেমধ্যে মনে হয় মৃত্যুর দুই বছর পর যেন ডোনাল্ড রামসফেল্ডেরই অসুখী আত্মা ফিরে এসেছে আবার।
অক্টোবরের শুরুর দিক থেকে এই পৃথিবী রামসফেল্ডের উৎকট উত্তরসূরির কথা শুনে আসছে। এই উত্তরসূরি আর কেউ নন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কারবি। রামসফেল্ডের মতোই সাবেক এই নৌ কর্মকর্তা চড়া গলায় একঘেয়ে বক্তৃতা দেন।
রামসফেল্ডের মতো, কারবিকেও রাষ্ট্রের গেলানো ব্রোমাইড ওগরাতে হচ্ছে। তিনি ক্রমাগত নিরীহ বেসামরিক মানুষকে শেষ করে দেওয়ার পক্ষে বলছেন। যদিও এসব ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের সুপরিচিত ‘আগে খুন, পরে ভাবনা’বিষয়ক পররাষ্ট্রনীতির ফল।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘ছিন্নমস্তক শিশু’র গল্পের ফাঁদে পড়েছিলেন। তিনি ফিলিস্তিনি শিশু, নারী ও পুরুষের প্রাণহানির সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।
আমি ভেবেছিলাম কারবির পক্ষে তাঁর নড়বড়ে বসকে ছাড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব হবে। কিন্তু আমি কি বোকা!
কারবি নিয়মিত আমাদের সামনে হাজির হচ্ছেন পাটভাঙা কালো স্যুট পরে। সেই স্যুটের বুকপকেট থেকে তিনি আবার কায়দা করে সাদা রুমাল বের করে রাখেন। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, একচোখা আরও অনেকের মতো ফিলিস্তিনিদের উচিত একটু সময় নিয়ে ভেবে আমেরিকার যে মহান অবদান, তা স্বীকার করে নেওয়া।
গত সপ্তাহে হোয়াইটহাউসে ডোরাকাটা ও তারকা খচিত পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে কারবি বলেন, ‘দেখুন, মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে অন্য অনেকের মতো আমরাও উদ্বিগ্ন। কিন্তু আমাকে আর একটি দেশের কথা বলুন, মাত্র একটি—যে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের মতো করে গাজার মানুষের বেদনা ও যন্ত্রণা কমানোর চেষ্টা করেছে। আপনি পারবেন না। স্রেফ পারবেন না।’
এই বিস্ময়কর প্যারাগ্রাফ কারবির সমাধিফলকে লেখা থাকবে। কারণ, এ থেকে বোঝা যায় বাইডেন প্রশাসন ও তার বশংবদ লোকজন কীভাবে সত্যকে ধামাচাপা দিতে মিথ্যে বলছে। কিন্তু কারবির এই শোচনীয় অনুযোগের একটা জবাব দেওয়া প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলে উপহার হিসেবে প্রাণঘাতী যেসব অস্ত্র পাঠিয়েছে, সেগুলোর আঘাতে এখন পর্যন্ত গাজার ১৮ হাজার ৬০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। তাঁদের বড় অংশই আবার শিশু ও নারী।
গাজার বুক থেকে গাজাবাসীকে মুছে দেওয়া হচ্ছে, তাদের আশ্রয় হচ্ছে গণকবরে। হাজার হাজার মানুষ পঙ্গু হয়ে গেছে। অনেকে ধসে পড়া ভবনের নিচে চাপা পড়ে আছে। এই ভবনগুলো একসময় ছিল বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, স্কুল, মসজিদ বা হাসপাতাল।
অল্প অল্প করে অধিকৃত পশ্চিম তীরও বেদখল হয়ে যাচ্ছে, মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে এই ভূখণ্ডকেও। শত শত ফিলিস্তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, বিচারিক কার্যক্রম ছাড়াই অনেককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনি হওয়াই তাদের অপরাধ।
ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার মুখে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি এক জায়গা থেকে অন্যত্র ছুটেছেন। তাদের খাবার, পানি ও জ্বালানি নেই। অগুনতি ফিলিস্তিনি না খেয়ে আছেন। অস্থায়ী আশ্রয়শিবির, মাটি দিয়ে কোনো রকমে বানানো শরণার্থীশিবিরের তাঁবুতে দ্রুত ছড়াচ্ছে রোগ–শোক।
কিশোর-তরুণ-বয়স্ক ফিলিস্তিনিদের প্রায় নগ্ন করে, চোখ বেঁধে হাঁটু গেড়ে রাস্তায় বা খোলা ময়দানে বসে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে।
এই নিষ্ঠুর, অমানবিক কাজের প্রতিটি ঘটেছে বাইডেনের অনুমোদনক্রমে। বাইডেন প্রশাসন এই দুষ্কর্মের দোসর।
কারবির কথায় কিছুই যায় আসে না, কারণ যা ঘটছে তা গোপন করা যাবে না। কারণ, আমাদের চোখ খোলা। ইসরায়েলকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার যে অভিপ্রায় বাইডেনের আছে, তা–ও আর কংগ্রেসের কাছে লুকানো যাবে না।
কারবির এই তিরস্কারের কারণ তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র গাজাবাসীর বেদনা আর যন্ত্রণা লাঘবে যে ‘দানবিক’ সহায়তা করছে, ফিলিস্তিনিরা তা স্বীকার না করে অকৃতজ্ঞতার প্রমাণ রেখেছে।
কারবির মতো লোকজনের প্রশিক্ষণই দেওয়া হয় এসব চাতুরী করার জন্য। তাঁদের কাছে প্রশাসনের প্রত্যাশা থাকে তারা আজ্ঞাবহ হয়েই থাকবে। তাঁদের কাছে যুদ্ধ মানে শান্তি। ক্ষত মানে প্রশমন। বোমা মানে ফুলের তোড়া।
● এন্ড্রু মিট্রোভিকা কানাডার অনুসন্ধানী সাংবাদিক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত