মহাভারতে বর্ণিত যুদ্ধবিদ্যার গুরু দ্রোণাচার্য ছিলেন নেহাতই গরিব। পুত্র অশ্বত্থামাকে সামান্য দুধটুকু কিনে খাওয়াতে পারতেন না। অন্য ধনী ছেলেরা রসিকতা করে পিটালি-গোলা সাদা জল অশ্বত্থামাকে দিয়ে বলল, ‘এই নাও, দুধ খাও।’ ওটাকে দুধ ভেবেই বালক অশ্বত্থামা ‘কী মজা কী মজা’ বলে পান করল। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ডলার-টাকা অদলবদল বা ‘কারেন্সি সোয়াপ’ চালু হওয়ার পর থেকে রিজার্ভ বৃদ্ধির বিভ্রমজাত আনন্দ দেখে আমার অশ্বত্থামার ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো’ তৃপ্তির কথা মনে পড়ছে।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এই পদ্ধতি চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো প্রায় এক বিলিয়ন ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা করেছে। ৬ মার্চ রিজার্ভ ২১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। এই অদলবদল বা সোয়াপের মাধ্যমে প্রাপ্ত ডলারকে রিজার্ভের অংশ মনে করা যুক্তিযুক্ত নয়। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষণকালীন সঞ্চিতি মাত্র।
ব্যাংকগুলো ৯০ দিনের মধ্যে এই ডলার ফেরত নিতে পারবে। ডলার-সংকটের এই দ্বিপ্রহরে ব্যাংকগুলো জমানো ডলার ফেরত নেবে বলেই মনে হচ্ছে। কারণ, প্রচুর আমদানি চাহিদা গলা চিপে দমিয়ে রাখা হয়েছে, যা শেষতক জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দিচ্ছে। সোয়াপ-ব্যবস্থা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য একধরনের নড়াচড়ার লাইসেন্স বা ডলারের ক্ষণকালীন পার্কিং সুবিধা মাত্র। পার্কিং সুবিধা দিয়েই গাড়ির মালিকানা দাবি করা যায় না।
সোয়াপ চালু করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সাবেক গভর্নরের আমলে আর্থিক উদ্ভাবন শূন্যের কোঠায় চলে এসেছিল। বর্তমান গভর্নর একটার পর একটা উদ্ভাবন চালিয়ে যাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে চেষ্টা করে যাচ্ছে, বাজারে সে বার্তাও উপকারী। কিন্তু সোয়াপকে রিজার্ভ বৃদ্ধির সঙ্গে সমার্থক করা কিংবা সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে প্রশংসাকে চুপচাপ হজম করা বিজ্ঞতার লক্ষণ নয়। সোয়াপ-ব্যবস্থা রিজার্ভ বাড়িয়ে ডলার-সংকট দূর করে দিচ্ছে বা দেবে—এ-জাতীয় খোয়াবে আক্রান্ত না হওয়াই মঙ্গল। এ ধরনের প্রশংসায় আত্মপ্রসাদ না নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত বিষয়টি খোলাসা করা।
কারেন্সি সোয়াপ প্রথম চালু হয় ১৯৮১ সালে বিশ্বব্যাংক ও আইবিএমের মধ্যে। এটি মূলত আন্তদেশীয়। দুই দেশের দুই কোম্পানি বিনিময় হারের ঝুঁকি কমানো এবং অপেক্ষাকৃত কম সুদে পুঁজির সহজলভ্যতার কারণে দুই মুদ্রার এই অদলবদল সুবিধা গ্রহণ করে থাকে। আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্সে এটিকে একধরনের ‘হেজিং’ বা নিরাপত্তার ঢাল হিসেবে দেখা হয়। ২০০৮ সালে বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের সময় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ কিছু উন্নয়নশীল দেশকে এ সুবিধা দিয়েছিল তারল্যের স্বার্থে।
২০১৮ সালে জাপানের সঙ্গে এই মুদ্রাবদল-বিষয়ক সুবিধার চুক্তি সই করে ভারত। সে বিচারে বাংলাদেশ ব্যাংক তার অধিভুক্ত ব্যাংকগুলোকে যে সুবিধা দিচ্ছে, তা মাত্রা ও চরিত্রগত দিক থেকে আলাদা। ভারতের সঙ্গে জাপানের সোয়াপের বিষয়টি পুরোপুরি পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট আদান-প্রদানের চুক্তি।
শুধু ডলার বৃদ্ধির একটা বিভ্রম থেকে অনেকেই অহেতুক আত্মপ্রসাদ নিচ্ছেন, যা মনে করিয়ে দেয় শিল্পী মান্না দের সেই কথা, ‘এই বুকের জ্বালা বুকেই গোপন করে/ বলো লাভ কী হবে নকল মালা পরে।’ এই সোয়াপ না থাকলেও গুড ব্যাংকের রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বাবদ অর্জিত ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি হিসাবে যুক্ত হতো। চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাবের সম্মিলিত ফল যদি ধনাত্মক হয়, তাহলে রিজার্ভ বেড়ে যেত। মাঝখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুই দিনের বাদশাহি থাকা না-থাকা সমান কথা।
বাংলাদেশ ব্যাংক অন্য ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ডলার-টাকার অদলবদল নিয়ে যা করছে, তা নির্মলেন্দু গুণের কবিতার ভাষায় অনেকটা ‘পিতার সঙ্গে সন্তানের না-লেখা প্রেমচুক্তি’-এর মতো। এটি অভিভাবক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তব্য। এটি পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো বাণিজ্যিক চুক্তি নয়। তাই একে ঠিক সেই অর্থে ‘কারেন্সি সোয়াপ’ বলা যায় না। এটি ডলারের ‘পার্কিং স্পেস’।
ধরি, একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের নাম ‘গুড ব্যাংক’। চারদিকে ‘ব্যাড লোন’-এর ছড়াছড়ির মধ্যে আশা করছি, এ নামের ব্যাংক ভালো ব্যবসা করছে। এ-ও আশা করছি যে এই লেখা ছাপা হওয়া পর্যন্ত এ নামে হঠাৎ আরেকটি ব্যাংক কালই গজিয়ে উঠবে না। ধরি, গুড ব্যাংক রেমিট্যান্স বাবদ ১০০ মিলিয়ন ডলার এবং রপ্তানি বাবদ ২৫০ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে। এই ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে।
ধরে নিচ্ছি, গুড ব্যাংকের নেট ওপেন পজিশন বা এনওপি ৫০ মিলিয়ন ডলার, যা এই ব্যাংক নিজের ভান্ডারে ধরে রাখতে পারবে। বাকি ৩০০ মিলিয়ন ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সমর্পণ বা জমা করে দিতে হবে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর মোট এনওপি প্রায় পৌনে দুই বিলিয়ন ডলার। সোয়াপের সুবিধাকে একধরনের বাড়তি এনওপি হিসেবে দেখা যেতে পারে।
যে ব্যাংকগুলো বেশি ডলার পায়, কিন্তু বড় অনিচ্ছায় বাড়তি ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়, তারা এই সোয়াপ-সুবিধায় একটু বাড়তি জায়গা পেল। তারা ডলার আপাতত কেন্দ্রীয় ব্যাংককে গচ্ছিত রেখে টাকা নিয়ে বাজারের তারল্য চাহিদা মেটাচ্ছে। এটি ক্যাশ ফ্লো বা নগদ প্রবাহ ব্যবস্থাপনার একটু আরাম বা বাড়তি পরিসর মাত্র; রিজার্ভ বাড়ানোর যোগ্য হাতিয়ার নয়।
নির্বাচনের পর বিনিয়োগকারীরা নতুন করে টাকা চাইছে। ঈদের কেনাকাটা সামনে বলেও টাকার চাহিদা বাড়ছে। এই সোয়াপ শুধুই অভ্যন্তরীণভাবে ডলারের হাতবদল মাত্র; জাতিগতভাবে রিজার্ভ বৃদ্ধি নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এভাবে যে ডলার পেয়েছে, তা দুই দিনের বাদশাহি। রাষ্ট্রীয় মাপে ডলার-সংকট রয়েই গেছে।
শুধু ডলার বৃদ্ধির একটা বিভ্রম থেকে অনেকেই অহেতুক আত্মপ্রসাদ নিচ্ছেন, যা মনে করিয়ে দেয় শিল্পী মান্না দের সেই কথা, ‘এই বুকের জ্বালা বুকেই গোপন করে/ বলো লাভ কী হবে নকল মালা পরে।’ এই সোয়াপ না থাকলেও গুড ব্যাংকের রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বাবদ অর্জিত ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি হিসাবে যুক্ত হতো। চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাবের সম্মিলিত ফল যদি ধনাত্মক হয়, তাহলে রিজার্ভ বেড়ে যেত। মাঝখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুই দিনের বাদশাহি থাকা না-থাকা সমান কথা।
টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার এক গ্রামে শ্বশুরালয়ে বেড়াতে গিয়ে ‘জমির কট’ নামে এক তারল্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে পরিচিত হলাম। এক কৃষকের মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সময় টাকার প্রয়োজন। তিনি তাঁর জমি এক ধনী গৃহস্থের কাছে ‘কট’ মানে আটকা দিয়েছেন। স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে টাকা নেওয়ার রেওয়াজের মধ্যে সুদের ব্যাপার অনেক সময় থাকে না। কিন্তু এই কটপদ্ধতিতে জমির ফসলই সুদের ‘প্রক্সি’ দিয়ে থাকে। যত দিন পর্যন্ত কৃষক পুরো টাকা ফেরত দিতে না পারবেন, তত দিন পর্যন্ত গৃহস্থ ওই জমি চাষ করে ফসল নেবেন।
একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক সোয়াপের বদৌলতে লাভ করবে প্রান্তিক শতকরা প্রায় ২ ভাগ সুদ (টাকার ওপর লব্ধ রিপো হার ৮ ভাগ বিয়োগ ডলারের ওপর প্রদেয় লন্ডনভিত্তিক শতকরা প্রায় ৬ ভাগ)। এটি কটলব্ধ ফসলের উদাহরণের সমতুল্য। গৃহস্থ ‘পরের জায়গা পরের জমি’ আপাতত অধিকারে রাখলেও জমির মালিক নন। গ্রামের সামগ্রিক হিসাবে কোথাও সম্পদ বাড়েনি।
অর্থনীতির পরিভাষায় এই সোয়াপকে ‘রিকার্ডিয়ান ইকুইভ্যালেন্স’ বা রিকার্ডোর সমকক্ষতার তত্ত্ব বলা যেতে পারে। ১৮২০ সালে ডেভিড রিকার্ডো দাবি করেন যে খরচ মেটাতে সরকার জনগণের ওপর করারোপ আজ করুক বা আগামী দিনে করুক, তাতে শেষ পর্যন্ত অর্থনীতির ফলাফলে কোনো পরিবর্তন আসে না। পরে ১৯৭৪ সালে হার্ভার্ডের রবার্ট ব্যারো এর গাণিতিক ভিত্তি প্রদান করেন।
গত দুই বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার-সংকট কাটাতে গভর্নর অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। কিন্তু ডলারের ন্যায্য দাম নিশ্চিত না করে অন্য নানা জাতের কলাকৌশল শুধুই টোটকা চিকিৎসা বা ঝাড়ফুঁক হিসেবে গণ্য হবে। এতে ফুলেফেঁপে উঠবে হুন্ডিওয়ালারা। এদিকে ডলারপ্রতি ১১০ টাকার ফাঁস গলায় নিয়ে দিন দিন রক্তশূন্যতায় দুর্বলতর হবে প্রবাসে অবস্থিত বাংলাদেশের বৈধ এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো। ডলারের ব্যাংক নির্ধারিত দাম বাজারমূল্যের এতটা নিচে পড়ে থাকলে রিজার্ভের সুস্বাস্থ্য কোনোভাবেই নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
● ড. বিরূপাক্ষ পাল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডের অর্থনীতির অধ্যাপক