গত এক দশক কি ব্যাংক লুটের দশক হিসেবে চিহ্নিত হবে? এই সময়ে একের পর এক ব্যাংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সাধারণ মানুষের আমানতকৃত অর্থ ঋণের নামে লুটে নিয়েছে এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও ব্যাংকের মালিকশ্রেণি। সর্বশেষ ইসলামী ব্যাংকসহ তিনটি ব্যাংক থেকে ঋণের নামে ৯ হাজার কোটি টাকা লোপাট হাওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা।
এ প্রতিবেদন যদি সত্যি হয় বা ভিত্তিহীন না হয়ে থাকে, তবে দেখা যাচ্ছে, কেবল ইসলামী ব্যাংক থেকে লোপাট হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো, যা পদ্মা সেতুর রেল প্রকল্পের মোট খরচের সমান। বিভিন্ন কাগুজে প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যাংক থেকে এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে। এমনও প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দেওয়া হয়েছে, যাদের অস্তিত্বই নেই। অনেক প্রতিষ্ঠানের ঠিকানায় আবাসিক ভবন পাওয়া গিয়েছে। এসব ভবনে মানুষজন পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন। কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এই হচ্ছে ব্যাংক খাতের অবস্থা। কে কাকে ঋণ দিচ্ছে, তার কোনো জবাবদিহি নেই।
এক যুগ ধরেই ব্যাংকগুলো লুটপাটের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। অভিনব পদ্ধতির এই লুটপাটের কথা বলতে গেলে প্রথমে চলে আসে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সোনালী ব্যাংকের নাম। ২০১১ সালে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে হল-মার্কের নামে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনায় বিচার চলছে। কিন্তু সোনালী ব্যাংক এখনো টাকা ফেরত পায়নি।
সোনালী ব্যাংক দিয়ে যে সূচনা হয়েছে সেই পথ ধরে এরপর একের পর এক বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নানাভাবে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। কখনো ভুয়া কোম্পানির নামে, কখনো মালিকপক্ষ নিজেই টাকা তুলে নিয়েছে। যেমন বেসিক ব্যাংকের মালিক আবদুল হাই বাচ্চু নিজেই অনিয়মে জড়িয়েছেন। এ ছাড়া বেসিক ব্যাংকের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার অনিয়মের তথ্য ফাঁস হয়েছে। মোটামুটি একই পদ্ধতি অনুসরণ করে আরও অন্তত ৯ / ১০টি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে, ঋণপত্র খোলার নামে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
খেলাপি ঋণের অঙ্ক যা-ই হোক, অনেকে নীতি ও কৌশলের কথা বললেও রাজনৈতিক কারণেই দেশের ব্যাংক খাত এই দুরবস্থার মধ্যে পড়েছে। ৪০-৫০টি পরিবারের হাতে দেশের ব্যাংক খাত কুক্ষিগত। এর মধ্যে এক পরিবারের হাতেই আছে সাতটি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক খাতে কয়েকটি পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্য আমাদের পাকিস্তান আমলের ২২টি পরিবারের কথা মনে করিয়ে দেয়। ওই সময় এই ২২ পরিবার ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করত।
এ পর্যন্ত কত টাকা লোপাট হয়েছে, এর কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে একটা আনুমানিক হিসাব প্রস্তুত করা সম্ভব। প্রথম আলোতে ২৪ নভেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব ব্যাংক থেকে গত এক দশকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রদান করা হয়েছে বিভিন্ন স্বল্প পরিচিত ও ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে। এর সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের হিসাব যুক্ত করলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণের নামে হাতিয়ে নেওয়ার অর্থের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। কিন্তু এসব ঋণের অর্থ ফেরত আসার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, বিভিন্ন বেনামি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া হয়েছে। পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা যোগসাজশ করে নিজেরা ঋণ নিয়েছেন। এক ব্যাংকের পরিচালক আরেক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। এমনও হতে পারে, বেনামি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ব্যাংকের মালিকদের সংশ্লিষ্টতাও থাকতে পারে।
এ ধরনের কেলেঙ্কারির কারণে ফারমার্স ব্যাংক পথেই বসে গিয়েছিল। গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারেনি। পরে সরকার মূলধন দিয়ে ব্যাংকটি বাঁচিয়েছে। পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুনভাবে পদ্মা নাম ধারণ করে ব্যাংকটি এখন টিকে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। মোট ঋণের পরিমাণ ১৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে এর ভিন্নমতও রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিক পরিসংখ্যান প্রদান করছে না। দেশে মোট ঋণখেলাপির পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। টিআইবি বলছে, এর পরিমাণ ৩ লাখ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণের অঙ্ক যা-ই হোক, অনেকে নীতি ও কৌশলের কথা বললেও রাজনৈতিক কারণেই দেশের ব্যাংক খাত এই দুরবস্থার মধ্যে পড়েছে। ৪০-৫০টি পরিবারের হাতে দেশের ব্যাংক খাত কুক্ষিগত। এর মধ্যে এক পরিবারের হাতেই আছে সাতটি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক খাতে কয়েকটি পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্য আমাদের পাকিস্তান আমলের ২২টি পরিবারের কথা মনে করিয়ে দেয়। ওই সময় এই ২২ পরিবার ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করত।
রাজনৈতিক দল, আরও স্পষ্ট করে বললে সরকারি দলের ছত্রছায়ায় টাকা হাতিয়ে নেওয়ার নতুন পথ হচ্ছে ব্যাংক খাত। নতুন ব্যাংক খুলে আমানত সংগ্রহ করে বা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ঢুকে দখলের মাধ্যমে আমানত নিয়ে চম্পট দেওয়া। ফারমার্স ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। বিষয়টি এমন নয় যে এ বিষয়ে কেউ কিছুই জানতেন না। সবার জ্ঞাতসারেই ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহকদের টাকা বিভিন্ন কায়দা করে তুলে নেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক চাপের কারণে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রাহকদের সুরক্ষার জন্য কোনো উদ্যোগই নিতে পারেনি। না হলে দীর্ঘ এক দশক ধরে ব্যাংকগুলোর লুটপাটের শিকার হলো কীভাবে?
অনেকেই লুটপাট শব্দটির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। দুর্নীতির মতো সুশীল শব্দ ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ বোধ করতে পারেন। দুর্নীতি শব্দটির মধ্যে একধরনের শ্রী আছে। এতে করে দায়িত্বশীলদের দায় অনেকটা কমে যায়। আমাদের ব্যাংকগুলোতে বুনো পশ্চিমের মতো কেউ বন্দুক ধরে লুট বা ডাকাতি করেনি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সবার সম্মতিতে গুটিকয় মানুষ ব্যাংক থেকে একের পর এক ঋণের নামে টাকা তুলে নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন। সংশ্লিষ্টদের সম্মতি না থাকলে অবশ্যই দু-একটি ঘটনার পর এ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেত।
মনে রাখতে হবে, সাধারণ মানুষের অর্থ কারসাজি করে লুটে নেওয়ার প্রক্রিয়া শেয়ারবাজারে শুরু হয়েছিল। নানা ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে মানুষকে শেয়ারবাজারে এনে সর্বস্বান্ত করা হয়েছিল গত শতকের শেষ দিকে। এখনো শেয়ারবাজারে নানা কারসাজির তথ্য বাজারে আসে। শেয়ারবাজারের পাশাপাশি লুটেরাদের নজর এখন ব্যাংকগুলোর দিকে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই লুটপাটের অর্থ কোথায় যায়? এমন নয় যে ঋণগ্রহীতারা ব্যবসা শুরু করে লোকসানে পড়েছেন। বা অন্য কোনোভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বিস্ময়করভাবে এই লুটপাটকৃত অর্থের প্রভাব বাজারে নেই। ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নেওয়া অর্থ সাধারণত দুভাবে ব্যবহৃত হতে পারে। প্রথমত, এসব অর্থের একটি অংশ বিদেশে পাচার হতে পারে। আরেকটি অংশ দেশের ভেতরেই ব্যবহার করা হতে পারে কালোটাকা হিসেবে। কিন্তু এই পরিমাণ টাকা কোনো খাতে বিনিয়োগ করা হলে বাজারে এর প্রভাব লক্ষ করা যেত। আমরা কিন্তু তেমন কোনো প্রভাব দেখিনি। কারণ, দেশে দিন দিন বেকারত্ব বাড়ছে। নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। বরং বিদ্যমান বিভিন্ন খাত, বিশেষ করে পোশাকশিল্পের অনেক কারখানা বন্ধ হচ্ছে। শ্রমিকদের বেতন-ভাতার জন্য আন্দোলন করতে হয়। একমাত্র অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন ছাড়া তেমন কোনো নতুন শিল্পের বিকাশ ঘটেনি গত এক দশকে।
তাহলে শেষ পর্যন্ত ব্যাংক থকে হাতিয়ে নেওয়া এই এক লাখ কোটি টাকা কোথায় গেল?
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক