‘দুজনার দুটি পথ’ বিএনপি–‍জামায়াতের দ্বৈরথ

গাজীপুরের জয়দেবপুরে আওয়ামী লীগ নেতাকে ছাড়িয়ে নিতে থানায় হাজির হন জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা।ছবি : সংগৃহীত

জামায়াতের নেতারা যখন তীব্র ভাষায় আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের দুঃশাসনের সমালোচনা করছেন, ফ্যাসিবাদের পুনরাবির্ভাব সম্পর্কে দেশবাসীকে সজাগ করে দিচ্ছেন; তখন গাজীপুরের ঘটনাটি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক।  

খবরটি হলো, ‘গাজীপুরে আওয়ামী লীগ নেতাকে ছাড়াতে মিছিল নিয়ে থানায় জামায়াতের নেতা-কর্মীরা।’

প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গাজীপুর সদর উপজেলার ভাওয়াল মির্জাপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার আওয়ামী লীগ নেতাকে ছাড়িয়ে নিতে থানায় মিছিল নিয়ে হাজির হন জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় নেতা-কর্মীরা।

৩ জানুয়ারি রাতে গাজীপুরের জয়দেবপুর থানায় নেতা-কর্মীরা জমায়েত হন। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁকে ছাড়েনি পুলিশ। গ্রেপ্তার ব্যক্তির নাম মো. শফিকুল সিকদার । তাঁর বাড়ি গাজীপুর সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের বিকেবাড়ি এলাকায়। তিনি মির্জাপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।

২০২৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর মির্জাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মো. এনামুল হক স্বাক্ষরিত ও অনুমোদিত মির্জাপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ কমিটির তালিকায় ২৩ নম্বর ক্রমিকে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে মো. শফিকুল সিকদারের নাম আছে।

এ বিষয়ে গাজীপুর জেলা জামায়াতের নেতা মোস্তাফিজুর রহমান আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, ‘গ্রেপ্তার শফিকুল সিকদার ২০১৮ সালের আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০১৮ সালের পর তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। পরে তিনি জামায়াতের ফরম পূরণ করে আমাদের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন।’

তাঁর দাবি, অন্য একটি দলের নেতারা তাঁকে (শফিকুল) দলে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। তাঁদের দলে যোগ না দেওয়ার কারণে তাঁরা তাঁকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন।
জামায়াত নেতার ভাষ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের নেতাকে অন্য একটি দলে নেওয়ার চেষ্টা করে সফল না হয়ে তাঁকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন বলে জামায়াতের নেতা–কর্মীদের থানায় যেতে হয়েছে তাঁকে ছাড়িয়ে আনতে। তিনি নাম না বললেও এটা পরিষ্কার যে দলটি বিএনপি।

সেখানকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলেও  তথ্যটি নিশ্চিত করা গেছে।

আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় এখন জামায়াত বিএনপির অথবা বিএনপি জামায়াতের প্রতিপক্ষ। নিজের পক্ষে যত লোক টানা যায়, বিরোধী পক্ষকে তত দুর্বল করা যাবে—এই নীতিতেই দল দুটি হাঁটছে।

জামায়াতের নেতা বলেছেন, শফিকুল ২০১৮ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ করেছেন। এর অর্থ কি ২০১৮ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা খুবই সৎ ও শান্তিপ্রিয় ছিলেন। সে সময় আওয়ামী লীগ থেকে লোক ভাগিয়ে জামায়াতে আনা খুবই ভালো কাজ ছিল।

আওয়ামী লীগও নব্বইয়ের দশকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে জামায়াতকে নিয়ে আন্দোলন করেছে। এই নেতার শেষ হলো যারা নির্বাচনকে সংস্কারের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে তারাই দেশকে বিরাজনীতিরণের দিকে নিয়ে যেতে চায়। এই প্রলয় থেকে দেশকে রক্ষা করার দায় কেবল বিএনপির নয়, সব গণতান্ত্রিক শক্তির।

এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে যে সত্য বেরিয়ে এল, তা হলো, সাবেক আওয়ামী লীগ নেতারা চাইলে জামায়াতে এসে নিজেদের ‘সাচ্চা দেশপ্রেমিক’ প্রমাণ করতে পারেন।

ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক নেতা–কর্মীদের ‘জার্সি বদল’ শুরু হয়ে গেছে।
ডুবে যাওয়া জাহাজের যাত্রীরা যেভাবে খড়কুটো ধরে বাঁচতে চান, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরাও সেটি করবেন—এটাই স্বাভাবিক।

তাদের সরকারের আমলে কোনো কোনো এলাকায় জামায়াতের নেতা–কর্মীরাও আওয়ামী লীগের দীক্ষা নিয়েছিলেন। ‘দীক্ষাগুরুদের’ অনুপস্থিতিতে হাইব্রিড আওয়ামী লীগারেরাও একই পথ অনুসরণ করবেন—সেটা অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ বাংলা প্রবাদেই আছে, নিজে বাঁচলে বাপের নাম। এখন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা–কর্মীরা নিজে বাঁচার চেষ্টা করছেন।

এ রকম ঘটনা যে কেবল গাজীপুরে ঘটেছে, তা নয়। ৫ আগস্টের পর অনেক আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মী আত্মরক্ষার জন্য নানা কৌশল নিচ্ছেন।  বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে কার কোথায় আত্মীয়স্বজন, সহপাঠী, অগ্রজ–অনুজ বন্ধ আছেন, সেটা খুঁজছেন। ক্ষমতায় থাকতে তাঁরা বিএনপি জামায়াত খুঁজেছেন ধরার জন্য, মারার জন্য; আর এখন খুঁজছেন আত্মরক্ষার জন্য।

সম্প্রতি বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে যে বাহাস চলছে, তারও লক্ষ্য আগামী নির্বাচন। ভোটের হিসাব নিকাশ। বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণের মোক্ষম তির ছুড়ছেন। একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছেন।

সম্প্রতি এক সমাবেশে  রুহুল কবির রিজভী  বলেন, শেখ হাসিনার আমলে ব্যাংক লুটকারী এস আলমদের উত্তরসূরি হয়েছে অনেকে। বড় বড় কথা বলে বিএনপির নামে কলঙ্ক লেপন করছে। টেন্ডারবাজি, পাড়া-মহল্লায় টার্মিনালসহ নানা কিছু দখল করেছে একটি দল। পায়ের রগ কারা কাটে, তাদের চেনে জনগণ।

রিজভীর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেছেন, ‘রিজভীর বক্তব্য বিভ্রান্তিকর, ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। জামায়াতের রাজনীতি ভারতের আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। এ ভূমিকা জাতি গ্রহণ করেছে। এ কারণেই সম্ভবত রিজভীর গাত্রদাহ হয়েছে।’

সিলেটে আরেক সমাবেশ  রুহুল কবির রিজভী  জামায়াতকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন ‘আমি সেই ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলকে বলতে চাই আপনাদের ৭১ সালে কী ভূমিকা ছিল, আপনারা কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন, কোন সেক্টর কমান্ডারের আন্ডারে যুদ্ধ করেছেন?’

এর আগে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেছিলেন, ‘দেশে পরীক্ষিত দুটি দেশপ্রেমিক শক্তি আছে, এর একটা সেনাবাহিনী আরেকটা জামায়াতে ইসলামী।’

জামায়াতে ইসলামীকে দেশপ্রেমিক অ্যাখ্যায়িত করে দলটির আমিরের দেওয়া বক্তব্যকে ‘ইতিহাসের নির্মম রসিকতা’ বলেছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব। নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর একটি টক শোতে জামায়াতের আমিরের বক্তব্যকে ‘ঐতিহাসিক বেয়াদবি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

তিনি বলেছেন, জামায়াতের আমির আজ সেনাবাহিনীকে ব্রাকেটবন্দী করে যেসব কথা বলেছেন, একাত্তরে যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ দেশের জনগণের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল, তখনো জামায়াতের তৎকালীন আমির একই কথা বলেছিলেন। পাকিস্তান সেনা বাহিনী ও জামায়াতই খাঁটি দেশপ্রেমিক।

বিএনপির এক শীর্ষস্থানীয় নেতা ব্যক্তিগত আলাপে বলেছেন, অতীতে একটি মহল বিএনপিকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে জামায়াতের সঙ্গে ব্রাকেটবন্দী করেছে, স্বাধীনতাবিরোধী বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে। অথচ পনের বছরের আন্দোলন সংগ্রামে করে বিএনপির নেতা–কর্মীরাই বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছেন। জামায়াত প্রসঙ্গে তাঁর মূল্যায়ন হলো, বিএনপি ও জামায়া্তের রাজনীতি কখনোই এক ছিল না, ভবিষ্যতেও এক হবে না। গণতন্ত্র উদ্ধার করতে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে কৌশলগত ঐক্য করেছিল।

আওয়ামী লীগও নব্বইয়ের দশকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে জামায়াতকে নিয়ে আন্দোলন করেছে। এই নেতার শেষ হলো যারা নির্বাচনকে সংস্কারের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে তারাই দেশকে বিরাজনীতিরণের দিকে নিয়ে যেতে চায়। এই প্রলয় থেকে দেশকে রক্ষা করার দায় কেবল বিএনপির নয়, সব গণতান্ত্রিক শক্তির।

সাম্প্রতিকবালে দুই দলের নেতাদের কথাবার্তায় এটা স্পষ্ট যে  বিএনপি আর জামায়াতের দুটি পথ যে  আলাদা হয়ে গেছে, নিকট ভবিষ্যতে তা এক হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

  • সোহরাব হাসান কবি ও প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক