টিং টং!
—কে?
—আমি ফরিদ। এই বিল্ডিংয়ের কেয়ারটেকার।
দরজা খুলে গেল।
—কী ব্যাপার ফরিদ?
—ঈদ আসতেছে। বোনাস দেন।
খানিক বাদে—
টিংটং!
দরজা খোলা হলো।
—আমি ডিশ লাইনের লোক। ঈদ তো সামনেই, বকশিশ দেন।
টিংটং!
—আমি ইন্টারনেটের লোক। বোনাস দেন।
টিংটং!
—আমি আপনার ছেলের অঙ্কের মাস্টার। বোনাসের ব্যাপারটা...।
টিংটং!
—আমি আপনার ছেলেরে স্কুলে আনা নেওয়ার করা স্কুলভ্যানের ড্রাইভার। খুশি হয়ে কিছু দেন।
টিংটং!
—আমরা আসছি পাশের এতিমখানা থেকে। ফিতরা দেবেন না? সামনে ঈদ...
টিংটং!
—আমরা মহল্লায় সাহরির আগে ক্বাসিদা গাই। খুশি হয়ে সবাই এক হাজার করে টাকা দিচ্ছে।
সকাল থেকে এইভাবে ‘টিং টং’ চলছে। যতবার কলিং বেল বাজছে, ততবারই গৃহকর্তা ইদ্রিশ আলি আতঙ্কিত হয়ে দরজা খুলছেন। তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, তাঁর রেগে যাওয়া ঠিক হবে কিনা। তবে তিনি কাউকে মেজাজ খারাপ করা মুখভঙ্গি দেখাচ্ছেন না। হাসি হাসি মুখ করে প্রত্যেককেই বলছেন, ‘আপনার কথা আমার মনে আছে। কিন্তু আজকে না, পরশু দিন বা তার পরের দিন পেয়ে যাবেন।’
এক সময় ইদ্রিশ আলির মনে হলো, বোনাস ও বকশিশের দাবিদার এই সব লোকদের যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে বাসার বাইরে গিয়ে হেঁটে আসা দরকার।
ইদ্রিশ আলি যে ভবনের একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন, তাঁর নিচে রাস্তার উল্টো দিকের লণ্ড্রিতে তিনি জামাকাপড় ইস্ত্রি করতে দিয়েছিলেন। হাঁটাহাঁটি করে ফেরার সময় সেখানে কাপড় আনতে যাওয়ার পর লণ্ড্রিওয়ালা ছেলেটা বলল, ‘কাকা, ঈদের বোনাস দ্যান কিছু। আগেভাগে দ্যান কিনাকাটা আগে আগে সাইরালামু।’
ইদ্রিশ আলি হাসলেন। বললেন, ‘আজ না, পরশুদিন কিংবা তার পরের দিন।’
দিন দুই আগে আগের এক দুর সম্পর্কীয় ভাগনি ফোন করে বলেছেন, মাস দু-এক আগে তাঁর স্বামী চাকরি হারিয়েছেন। তাঁকে কিছু টাকা না পাঠালে ঈদের দিন তিন সন্তানের সামনে তাঁকে বিরাট লজ্জা পেতে হবে।
সবাইকে ইদ্রিশ আলি ‘পরশুদিন বা তার পরের দিন’ দেখাচ্ছেন। এ ছাড়া তাঁর উপায় নেই। কারণ ইদ্রিশ আলি নিজেই এখনো ঈদের বোনাস পাননি। পাওয়ার সম্ভাবনা যতখানি আছে, না পাওয়ার আশঙ্কা তার চেয়ে বেশি। কারণ তিনি যে বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন, তাঁদের ব্যবসার অবস্থা ভালো না।
করোনা মহামারির দুই বছর পর ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্ববাজারের অস্থিরতায় কোম্পানির অবস্থা খারাপ।
ইদ্রিশ আলির মতো অসংখ্য মধ্যবিত্তের কাছে ঈদ যতটা না উদ্যাপনের, তার চেয়ে অনেক বেশি অস্বস্তি ও আতঙ্কের। এক ধাক্কায় জিনিসপত্রের দাম দ্বিগুণের কাছাকাছি হলেও সে তুলনায় আয় বাড়েনি একেবারেই। কিন্তু ইন্টারনেট সংযোগ, ক্যাবল টিভির লাইন, সপ্তাহান্তে ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটু রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি অনুষঙ্গ নিয়ে যে জীবন যাপনে তাঁদের পরিবার অভ্যস্ত, সেই অনুষঙ্গ আচমকা না ছেঁটে ফেলা যাচ্ছে, না ধরে রাখা যাচ্ছে।
ইদ্রিশ আলিদের আয়ের ভিতটা আসলে মোটেও মজবুত নয়, কিন্তু ওপরে-ওপরে ঠাটবাট ধরে রাখতেই হয়।
সমাজকর্মী ও অর্থনীতিবিদেরা প্রান্তিক গরিবদের নিয়ে যত মাথা ঘামান, তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশও এই শ্রেণিকে নিয়ে ঘামান না। অথচ, এই শ্রেণিটি না থাকলে জিনিসপত্র কে কিনত? যে চাহিদার ওপর ভরসা করে কারখানার চাকা ঘুরছে, কে সেই চাহিদার জোগান দিত?
বছর তিনেক আগেও কোনো রকম ভালো-মন্দ মিলিয়ে এক রকম চলে যাচ্ছিল, কিন্তু কোভিড-১৯ ও ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত এসে মধ্যবিত্তের জীবন তছনছ করে দিয়েছে। কারও চাকরি গেছে, কারও বেতন অর্ধেক হয়ে গেছে। এখনো যাঁরা সে অবস্থায় পড়েননি তাঁদের অনেকেই আসন্ন সর্বনাশের আশঙ্কায় সিঁটিয়ে গেছেন।
এই শ্রেণির সামান্য একটা অংশ অবশ্য আছে, যাঁদের চাকরি যাওয়ার বা বেতন কমার ভয় নেই। তাঁরা সরকারি চাকুরে। কিন্তু এই বিরাট জনগোষ্ঠীর কয়জন সেই দলে পড়েন?
সমাজকর্মী ও অর্থনীতিবিদেরা প্রান্তিক গরিবদের নিয়ে যত মাথা ঘামান, তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশও এই শ্রেণিকে নিয়ে ঘামান না। অথচ, এই শ্রেণিটি না থাকলে জিনিসপত্র কে কিনত? যে চাহিদার ওপর ভরসা করে কারখানার চাকা ঘুরছে, কে সেই চাহিদার জোগান দিত?
সামনে ঈদ। গ্রাম থেকে রাজধানী বা বড় বড় শহরে উঠে আসা হাজার হাজার ইদ্রিশ আলি শুধুমাত্র গ্রামের বাড়ির আত্মীয় পরিজনের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন না বলে দেশের বাড়িতে যাবেন না। কিন্তু টাকার অভাবই যে সেই যেতে না পারার একমাত্র কারণ—সেটিও গ্রামের স্বজনদের কাছে কস্মিনকালেও মুখ ফুটে বলতে পারবেন না। তাঁদের বলতে হবে, ‘সময় পাচ্ছি না’ অথবা ‘জরুরি কাজে আটকা পড়েছি রে...।’
মধ্যবিত্তদের এই আত্মবঞ্চনার ঢেউয়ে ভাসিয়ে ডুবিয়ে ফি বছর ঈদ আসে, ঈদ যায়। কিন্তু এ বছরের কষ্টটা সম্ভবত বিগত বছরের চেয়ে একটু বেশিই ভারী।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]