গাজায় গণহত্যা একটি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার আগে পঙ্গু করে দেওয়ার প্রয়াস। ৪০০ দিনের বেশি ইসরায়েলি বিমান হামলা এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ক্রমাগত স্থল আক্রমণের ফলে ২২ হাজার ৫০০ জনের বেশি মানুষ আহত হয়েছে। অজস্র মানুষ নিহত হয়ে ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে আছে। গাজার জনসংখ্যার নব্বই শতাংশ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
সব অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায় যখন, যখন রাস্তা বলতে কিছু নেই, চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিহ্ন, তখন পঙ্গু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবন কতটা বিপর্যস্ত হতে পারে, তা কল্পনা করাও কষ্টকর। সবাই হয়তো ইসরায়েলিদের হামলা থেকে পালানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু এই প্রতিবন্ধীরা কী করবে?
আমি গাজায় নুসিরাত শরণার্থীশিবিরে বড় হয়েছি। শৈশবে আমি অনেক লোককে চিনতাম, যাঁরা ইসরায়েলি সহিংসতার ফলে স্থায়ীভাবে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন। যুদ্ধের আগে, গাজার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রতিবন্ধী নাগরিক হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছিলেন। এ রকম অনেককেই আমি চিনি। তাঁদের কিছু কাহিনি শুনুন।
আজমি আলজামালের বয়স ৯ বছর। ১৫ অক্টোবর, ২০২৩ তাকে তার বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে টেনে বের করা হয়েছিল। বাড়িটিতে আঘাত হেনেছিল দুটি ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র। আজমির মা, দাদা-দাদি, চাচা, দুই খালা, দুই ভাই–বোন এবং তিন চাচাতো ভাই নিহত হয়েছিলেন এই হামলায়। আজমি গুরুতর আহত হয়েছিল। সে এখন হুইলচেয়ারে জীবন কাটায়। তার পায়ের চিকিৎসার জন্য অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন। এর জন্য যেতে হবে দেশের বাইরে। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়।
আজমির পরিবার নুসিরাত থেকে রাফায় এসেছিল বাস্তুচ্যুত হয়ে। যখন ইসরায়েলি সেনাবাহিনী রাফায় আক্রমণ করে, তখন আবার তারা নুসিরাতে ফিরে আসে। তার বাবা মুসা আমাকে বলেছিলেন, ‘তার বিশেষ যত্নের প্রয়োজন। বিশেষ ধরনের ডায়াপার দরকার। নির্দিষ্ট ডায়েট ও ভিটামিন প্রয়োজন। কিন্তু সেসব কোথায় পাব?’ আজমির পরিবার সাধারণ যে মলম, সেটা জোগাড় করতেই হিমশিম খায়। যখনই আশপাশে বোমা হামলা হয়, তার বাবা ছেলেকে কোলে নিয়ে ছুটে বেড়ান নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। আজমির স্বপ্ন, আবার সে নিজে নিজে হেঁটে বেড়াবে।
মাহমুদ আদনান শোকরের বয়স ৩১ বছর। তিনিও নুসিরাত শরণার্থীশিবিরে থাকেন। ২০১৮ সালে তিনি পঙ্গু হন। কথা বলতেও সমস্যা হয় তাঁর। তিনি একটি হুইলচেয়ার ব্যবহার করেন। দৈনন্দিন সব কাজের জন্য পরিবারের সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। ৪ নভেম্বর ইসরায়েল তাঁদের বাড়িতে বোমা হামলা করে। এতে তাঁর মা আহত হন। নিহত হন চাচাতো ভাই। পরিবারের জীবিত সদস্যরা প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় মাহমুদকে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে বের করেন।
এ রকম হাজার হাজার গল্পের মধ্যে কয়েকটি মাত্র গল্প জানলেন আপনারা। । কিন্তু এমন চরম অবস্থার মধ্যেও এই সব মানুষ প্রিয়জনকে রক্ষার জন্য কতদূর যেতে পারেন, তা দেখলে বিস্ময় লাগে।
মাহমুদ আগে মিসরে চিকিৎসা নিয়েছেন। এখন মাহমুদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। তাঁর মা আমাকে বলেছিলেন, ব্যথায় বেচারা প্রতিদিন কান্নাকাটি করে। যখন বোমা হামলা হয় আর পালানোর সময় আসে, তখন সে অন্যদের মতো ছুটে যেতে পারে না। মাহমুদের ভাই আবেদ তাঁকে পিঠে করে নিয়ে যায়।
রিম আয়াদের বয়স ১০ বছর। সে জয়তুন থেকে আসা গাজা শহরের অধিবাসী। গত বছর ১৬ অক্টোবর রিম তার ভাইদের সঙ্গে খেলছিল। একটি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান তাদের বাড়িতে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র ফেলে। রিমের বয়ানে, ‘আমাদের মাথার ওপরের ছাদ অর্ধেক উড়ে যাওয়ার পর বাড়ি থেকে ছুটে বের হয়ে এলাম আমরা। আমরা যখন পালিয়ে যাচ্ছিলাম, আমাদের ঠিক পাশের রাস্তায় বোমা পড়ল। আমার ডান হাত ছিন্ন হয়ে গেল।’
রিমের বাবা কামালের কাছে শুনেছিলাম, কীভাবে তিনি রিমকে কাঁধে নিয়ে নিকটতম অ্যাম্বুলেন্সের কাছে পৌঁছান। তারপর ইসরায়েল হাসপাতালটি খালি করার নির্দেশ দেয়। তখন পালিয়ে দক্ষিণে গিয়ে রিমের অস্ত্রোপচার হয়েছিল। রিমের ভিটামিন, খাবার আর ওষুধ পাওয়া যায় না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটি প্রয়োজন, তা হলো একটি কৃত্রিম অঙ্গ। কিন্তু সে ব্যবস্থা করা তো অসম্ভব।
চারপাশে আগুন, ইসরায়েলি ট্যাংক সামনে, মাথার ওপর কোয়াডকপ্টার। এই সবকিছুর ভেতর দিয়ে আমিনা যখন পালাচ্ছিলেন, তখন তিনি গর্ভবতী ছিলেন। দক্ষিণে পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন আমিনা। হয়েছিলেন পঙ্গু। অপুষ্টি এবং স্বাস্থ্যসেবার অভাবের কারণে তাঁর গর্ভে বহন করা সন্তানকে হারিয়েছিলেন। নাজাহর বাস্তুচ্যুতদের জন্য একটি শিবিরে সীমিত সম্পদ দিয়ে পরিবারকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন তিনি। প্রচণ্ড গরমে তাঁবুতে মাটির চুলা ব্যবহার করে রুটি সেঁকেন। কিছু রুটি বিক্রি করেন।
দৈনন্দিন কাজগুলো কঠিন আমিনার জন্য। হাঁটতে না পেরে শিবিরের ধুলার মধ্য দিয়ে নিজেকে টেনে নিয়ে যেতে হয়। তাঁর একটা হুইলচেয়ার দরকার। কিন্তু সেটা পাওয়া অসম্ভব। আমিনার দুর্বল পাচনতন্ত্র বেশির ভাগ খাবার হজম করতে পারে না। ফলে তাঁর বমি হয়, ডায়রিয়া হয়।
এ রকম হাজার হাজার গল্পের মধ্যে কয়েকটি মাত্র গল্প জানলেন আপনারা। যাঁদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তাঁরা চরম কষ্টের ভেতর আছেন। প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়া অসম্ভব তাঁদের পক্ষে। কিন্তু এমন চরম অবস্থার মধ্যেও এই সব মানুষ প্রিয়জনকে রক্ষার জন্য কতদূর যেতে পারেন, তা দেখলে বিস্ময় লাগে।
ইউসুফ এম আলজামাল, আমেরিকান ফ্রেন্ডস সার্ভিস কমিটির গাজার সমন্বয়ক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন