নির্দয় সত্য হলো, যে রাশিয়া সিরিয়া থেকে ইউক্রেন পর্যন্ত সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে এসেছে, শুক্রবার রাতে সে রাশিয়াই সন্ত্রাসী হামলার শিকার হলো। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সন্ত্রাসীরা মস্কোর ক্রোকাস সিটি হলের একটি কনসার্ট ভেন্যুতে ঢুকে ১৩৩ জনকে হত্যা করেছে। এই হামলায় আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ।
হামলার পর দ্রুত ইসলামিক স্টেট দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়। পরে আরও জানা যায় যে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা আফগানিস্তানভিত্তিক ইসলামিক স্টেট-খোরাসান (আইএসআইএস-কে) যে মস্কোয় হামলার পরিকল্পনা করছে, সে খবর আগেই জানিয়েছিল। মস্কোর মার্কিন দূতাবাস এমনকি সে দেশের নাগরিকদের কনসার্ট হল এড়িয়ে চলার নির্দেশনাও দিয়েছিল।
কিন্তু রাশিয়ার স্বৈরাচার ভ্লাদিমির পুতিন ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে আসা প্রকৃত হুমকিকে পাত্তা না দিয়ে তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলেন কল্পিত ইউক্রেনীয় নাৎসিদের দিকেই। হালকা চালে যুক্তরাষ্ট্রের এই সতর্কবার্তা তিনি উড়িয়ে দেন। তাঁর মনমানসিকতা কেমন একবার ভাবুন, গত সপ্তাহের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কবার্তাকে তিনি ‘উসকানিমূলক’ বলে উল্লেখ করেন। এটুকু বলেই থামেননি। বলেছেন, সমাজের স্থিতিশীলতা নষ্ট করে সবার মধ্যে ভীতি জাগাতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার যে ইচ্ছা তাতে গুরুত্ব দেননি। এতে করে তাঁর নিরাপত্তা বাহিনী মস্কোয় হামলা প্রতিরোধ করতে পারল না। এবার বুঝুন পুতিন সরকারের ধরনটা কী। পুতিন প্রকৃত হুমকি থেকে রুশ জনগণকে সেবা বা সুরক্ষা দিতে চান না। তাঁর সব মনোযোগ বিরুদ্ধমতের শান্তিপূর্ণ প্রকাশকে দমন করায়। এই কাজকে তিনি সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
জারদের মতো পুতিনেরও উদ্দেশ্য হৃত সাম্রাজ্যের গৌরব ফিরিয়ে আনা। এ জন্য যত উচ্চমূল্যই চুকাতে হোক না কেন, তা নিয়ে পুতিনের কোনো হেলদোল নেই। প্রকৃত শত্রুর পেছনে না ছুটে পুতিন এখন মস্কোর হামলায় ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের হাত খোঁজার চেষ্টা করতে পারেন। এতে করে নির্দোষ ইউক্রেনীয়দের ওপর হামলা চালানোর ন্যায্যতা দেওয়া সহজ হয়।
আইএসআইএস-কের হামলা প্রতিরোধে ক্রেমলিনের এই ব্যর্থতার ঘটনা ঘটল ইরানে জঙ্গিগোষ্ঠীদের একই ধাঁচের হামলার মাত্র কয়েক মাসের মাথায়। ইরানকেও যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করেছিল। কিন্তু তারা ‘শ্রেষ্ঠ শয়তানের’ কথায় কান দেয়নি। গত ৩ জানুয়ারি ইসলামিক স্টেট ইরানে দুটি বোমা হামলা চালায়। এতে কেরমান শহরে ৯৫ জন মানুষ নিহত হন। মার্কিন বোমা হামলায় নিহত কুদস ফোর্সের কাশেম সোলাইমানির মৃত্যুবার্ষিকীতে এই মানুষগুলো সমবেত হয়েছিল।
প্রকৃত সন্ত্রাসীদের বদলে কল্পিত শত্রুদের বিরুদ্ধ যুদ্ধকে বরং তারা শ্রেয় মনে করে। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে তাদের তথ্যসূত্র ও পদ্ধতি এই শত্রুমনোভাবাপন্ন দেশগুলোর কাছ থেকে সামলে রাখা। কারণ এই রাষ্ট্রগুলো এত বেশি বিভক্ত যে আইএসএস-কে সুযোগ পেলেই হামলা চালাতে পারে। এই হামলার নিশানা হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র অথবা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের মিত্ররাষ্ট্রগুলো।
ইরান সরকারও রুশ সরকারের মতো যুক্তরাষ্ট্র তাদের শত্রু এই প্রোপাগান্ডায় বুঁদ হয়ে আছে। সে কারণে শত্রুরাষ্ট্র সতর্ক করায় তারা খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি। সত্যিই তো, তাঁরা তাঁদের মতো করে ভেবেছেন। ভ্লাদিমির পুতিন অথবা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি কি ওয়াশিংটনে সাধারণ মার্কিন নাগরিকদের হামলার ব্যাপারে কোনো খবর থাকলে জানাতেন?
তাই এই স্বৈরশাসকেরা ভাবতেও পারেননি যে ওয়াশিংটন নিরীহ রুশ বা ইরানি জীবনকে বাঁচাতে চায়। তাঁরা নিশ্চয়ই ধারণা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের এই সতর্কবার্তা কোনো একটা ফাঁদ। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র তাদের শত্রুরাষ্ট্রকে সাহায্য করতে পারে, এ তাদের কল্পনার বাইরে।
ইরানকে যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করেছিল এই খবর প্রকাশ হওয়ার পর, মার্কিনদের কেউ কেউ বাইডেন প্রশাসনের সমালোচনা করেন। তাঁদের যুক্তি ছিল তেহরানকে আগাম সতর্ক কেন করতে হবে? কারণ ইরানের প্রক্সিরা বহুদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনাদের ওপর হামলা চালিয়ে আসছে। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এভাবেই কাজ করে। এ নিয়ে আমাদের গর্বিত হওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্রধারী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য করে। আর যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুরা এই পার্থক্যটুকু করে না।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্ব ছিল সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলা সম্পর্কে সতর্ক করা। যেহেতু এই সতর্কবার্তা মার্কিন নাগরিক ও মার্কিন মিত্রদের কাছে পৌঁছেছিল, এটাই স্বাভাবিক যে বাইডেন প্রশাসন মস্কো ও তেহরানকেও সতর্ক করবে। এখন সন্ত্রাসীদের মানবজাতির শত্রু হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন। প্রতিটি দেশের উচিত তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা। রাশিয়া ও ইরান জঙ্গিবাদে মদদ দেয়, সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের রাশিয়া ও ইরানের সাধারণ নাগরিকদের ওপর সম্ভাব্য জঙ্গি হামলার ব্যাপারে নীরব থাকা উচিত নয়।
একটা বিষয় আমাকে স্বীকার করে নিতে হবে, যখন আমি মস্কোয় সন্ত্রাসী হামলার কথা প্রথম শুনতে পাই, তখন আমারও মনে হয়েছিল হয়তো ইউক্রেন এই হামলার জন্য দায়ী। তারা দায়ী নয়, এটা জানতে পেরে আমি আনন্দিত হলাম। সন্ত্রাসী হামলায় যুক্ততার খবর সত্য হলে ইউক্রেনের প্রতি যে সহানুভূতি তা ফুঁয়ে উড়ে যেত। ২০০০ সালের প্রথমার্ধে চেচেন যোদ্ধারা আন্তর্জাতিক সমর্থন হারিয়েছিল রাশিয়ায় গণ খুনের কারণে। (রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী চেচেনদের ঘাড়ে দোষ চাপাতে ১৯৯৯ সালে রুশ অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে হামলা চালিয়েছিল। )
কিন্তু ইউক্রেনীয়রা এমন কিছু করবে, এটা প্রায় অসম্ভব। কারণ ইউক্রেনেও যুক্তরাষ্ট্রের মতো আইনের শাসন ও গণতন্ত্র আছে। যাদের মূল লক্ষ্য সেনা অভিযান থেকে সাধারণ মানুষকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেওয়া। ইউক্রেনীয়রা রাশিয়ার স্থাপনায়, যেমন তেল শোধনাগারে হামলা চালিয়েছে। কারণ এই সব স্থাপনার সহযোগিতা নিয়ে ইউক্রেনে হামলা চালানো হয়। তারা কিন্তু রাশিয়ার শহরগুলোয় বোমা হামলা চালিয়ে ভীতি ছড়াচ্ছে না। অন্যদিকে রাশিয়া ঠিক সেটাই করছে। তারা ইউক্রেন, চেচনিয়া ও সিরিয়ার শহরগুলোয় বোমা মেরেছে।
রাশিয়া এখন অতীত অপরাধের শাস্তি ভোগ করছে। কারণ তারা ইসলামিক স্টেটকে বুঝিয়েছে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে যেমন শত্রু মনে করে, একই রকম শত্রু মনে করে আইএসআইএসকে। ২০২২-এ ফরেইন পলিসির একটি প্রতিবেদনে আইএসআইএস-কের ইংরেজি ম্যাগাজিন থেকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘গত ১০০ বছরের ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্র ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল। রাশিয়াও আলাদা কিছু নয়।’
এক দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক জোট আইএসআইএসবিরোধী অভিযান চালায়। তারপরও ইসলামিক স্টেটের এ ধরনের হামলা চালানোর সক্ষমতা আছে। এ কথা আমাদের মনে করায় যে সন্ত্রাসী সংগঠনকে নিশ্চিহ্ন করা সহজ নয়।
এখন প্রশ্ন হলো, আইএসআইএস-কের অব্যাহত হুমকিকে মোকাবিলায় কোনো কার্যকর আন্তর্জাতিক জোট গঠন সম্ভব হবে কি না। এই জোটের সঙ্গীরা অবশ্য কিছুটা অদ্ভুত ধরনের, যেমন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইরান এবং তালেবান। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য আইএসআইএস-কে র মোকাবিলায় তালেবানদের কাছ থেকে কিছু সহযোগিতা নিয়েছিল। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল অপারেশন বাহিনীকে রসিকতা করে তালেবান এয়ার ফোর্সও বলা হয়। কারণ এই বাহিনীটি মাঠে আইএসআইএস-কের শক্তিশালী ঘাঁটিগুলো ধ্বংসে তালেবানদের সাহায্য করেছিল।
সাম্প্রতিক ইতিহাস মাথায় রাখলে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে বোঝাপড়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। এই জোট গঠন যত জরুরিই হোক না কেন। দুই দেশের সরকারই নিজেদের শাসন টিকিয়ে রাখতে আমেরিকাকে জুজু হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। বোঝাতে চাইছে তাদের পক্ষে ওয়াশিংটনের সঙ্গে কাজ করা সম্ভব না।
প্রকৃত সন্ত্রাসীদের বদলে কল্পিত শত্রুদের বিরুদ্ধ যুদ্ধকে বরং তারা শ্রেয় মনে করে।
যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে তাদের তথ্যসূত্র ও পদ্ধতি এই শত্রুমনোভাবাপন্ন দেশগুলোর কাছ থেকে সামলে রাখা। কারণ এই রাষ্ট্রগুলো এত বেশি বিভক্ত যে আইএসএস-কে সুযোগ পেলেই হামলা চালাতে পারে। এই হামলার নিশানা হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র অথবা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের মিত্ররাষ্ট্রগুলো।
ম্যাক্স বুট কলাম লেখক
নিবন্ধটি দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত।