‘বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ’ একটি বার্ষিক উদ্যাপন, যা প্রতিবছর পৃথিবীর ১৭০টিরও বেশি দেশে ১ থেকে ৭ আগস্ট পালন করা হয়। শিশুকে বুকের দুধ পান করাতে উৎসাহ দিতে এবং শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে ১৯৯২ সাল থেকে এই কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
কাজটি ‘ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স অব ব্রেস্ট ফিডিং অ্যাকশন’ নামের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের সহযোগিতায় পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশেও প্রতিবছর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের সহযোগিতায় ‘বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশন’ কর্তৃক ‘বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ’ পালিত হয়ে থাকে।
এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘ক্লোসিং দ্য গ্যাপ: ব্রেস্ট ফিডিং সাপোর্ট ফর অল’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বব্যাপী প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজন শিশু প্রয়োজনীয় পরিমাণে মায়ের দুধ পায় না, যা তাদের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মৃত্যুহারেও প্রভাব ফেলে।
শিশুর জন্য মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নেই। মায়ের দুধ প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ খাবার। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি স্তরেই রয়েছে দুধের প্রয়োজনীয়তা। খাদ্যের ছয়টি উপাদান সুষম আকারে দুধে বিদ্যমান, যা প্রকৃতির আর কোনো খাদ্যে পাওয়া যায় না।
শিশুর জন্য মায়ের দুধ একটি আশীর্বাদ। জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত মানবশিশু শুধু দুধ পান করেই জীবন ধারণ করতে পারে। দুই বছর পর্যন্ত মায়ের দুধ পান করানো হলে শিশু সুস্থ ও সবল হিসেবে গড়ে ওঠে। মায়ের দুধে রয়েছে প্রায় ৮৭% পানি, ৬.৫-৭.২% ল্যাকটোজ (শর্করা), ৩-৪% চর্বি, ১-১.৫% প্রোটিন, ০.২% মিনারেল (খনিজ) এবং প্রচুর পরিমাণে চর্বি এবং পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন। তা ছাড়া বিভিন্ন ধরনের বিপাকীয় কর্মে অংশ নেওয়ার জন্য দুধে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে এনজাইম।
দুধের প্রোটিন প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ প্রোটিন। মায়ের দুধের প্রোটিন বিভিন্ন ধরনের বায়ো-অ্যাকটিভ পেপটাইডের একটি সমৃদ্ধ উৎস, যা মডুলেটর হিসেবে সাহায্য করতে পারে। পেপটাইডগুলো অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, ইমিউনোমডুলেটরি, অ্যান্টি-অক্সিডেটিভ, মিনারেল-বাইন্ডিং হিসেবে বিভিন্ন ধরনের কার্যাদি সম্পাদন করে থাকে। তা ছাড়া মায়ের দুধের চর্বিতে বিভিন্ন ধরনের সম্পৃক্ত ও অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডসহ অনেক প্রয়োজনীয় লিপিড রয়েছে, এগুলো নবজাতকের শক্তির জোগান, মস্তিষ্ক ও অন্ত্রের বর্ধনসহ বিভিন্ন ধরনের কার্যাদি সম্পাদন করে থাকে।
দুধের ল্যাকটোজ প্রকৃতিতে আর কোনো খাদ্যে পাওয়া যায় না। এটি একটি ডাই-স্যাকারাইড, যা ভেঙে গ্লুকোজ ও গ্যালাকটোজ তৈরি হয়। গ্লুকোজ মস্তিষ্কে শক্তি জোগায় ও গ্যালাকটোজ মস্তিষ্কের কোষ সতেজ রাখে ও বর্ধনে সাহায্য করে। তাই যেসব শিশু পর্যাপ্ত পরিমাণ মায়ের দুধ খেয়ে থাকে, তারা বেশি মেধাবী হয়। তা ছাড়া মায়ের দুধে প্রচুর পরিমাণে খনিজ পদার্থ, যেমন ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম ইত্যাদির উপস্থিতি শিশুর হাড়ের গঠন মজবুত করে থাকে।
নবজাতকের প্রথম খাবার হলো মায়ের বুকের নিঃসৃত প্রথম ঘন আঠালোজাতীয় দুধ, যা কলস্ট্রাম বা শালদুধ নামে পরিচিত। শালদুধে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবডি, প্রোটিন (কেসিন, আলফা ল্যাকটালবুমিন, বিটা ল্যাকটোগ্লোবিউলিন), পর্যাপ্ত পরিমাণে চর্বি, যা ভিটামিন এ, বি, ডি ও পলিআনস্যাচুরটেড ফ্যাটি অ্যাসিডের বাহক; তা ছাড়া প্রচুর পরিমাণে ল্যাকটোফেরিন, লাইসোজাইম, ও ল্যাকটোপার-অক্সিডেজ এনজাইম ও খনিজজাতীয় পদার্থ শালদুধে বিদ্যমান।
এসব খাদ্যোপাদান নবজাতককে বিভিন্ন ধরনের রোগ থেকে রক্ষা করে। এই ঘন শালদুধ নবজাতকের পাকস্থলী এবং অন্ত্রের ওপরে পাতলা শক্ত আবরণের সৃষ্টি করে।
ফলে রোগজীবাণু এই আবরণ ভেদ করে সহজে রক্তে মিশে যেতে পারে না, তাই নবজাতক বিভিন্ন প্রকার রোগ থেকে মুক্তি পেয়ে থাকে। নবজাতকের পেট পরিষ্কার করতে ও জন্ডিস প্রতিরোধে শালদুধ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।
দুই বছর পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধ পান করালে শিশুর বিভিন্ন উপকার হয়ে থাকে, যেমন শিশুর শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেড়ে যাবে। যার ফলে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, হুপিংকাশি, কানের প্রদাহ, ব্যাকটেরিয়াল মেনেনজাইটিস, হাঁপানি, শিশুমৃত্যু, স্থূলতা, টাইপ-২ ডায়াবেটিস ইত্যাদিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বহুলাংশে হ্রাস পেয়ে যায়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মায়ের দুধ পান করলে শিশুমৃত্যুর হার প্রায় ২০-২২% কমে যায়।
পরিশেষে, মায়ের দুধ হলো একটি গতিশীল, বহুমুখী তরল, যাতে শিশুর স্বাস্থ্য ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও জৈব-অ্যাকটিভ উপাদান রয়েছে। যদিও মায়ের দুধের গঠন নিয়ে অনেক গবেষণা পরিচালিত হয়েছে, তথাপি মায়ের দুধের উপাদানগুলো এখনো চিহ্নিত করা হচ্ছে।
দিন দিন পুষ্টি ও জৈব-অ্যাকটিভ ফ্যাক্টর-সমৃদ্ধ মায়ের দুধের গঠন সম্পর্কে জ্ঞান বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা শিশুর স্বাস্থ্য ও বিকাশে মায়ের দুধের ভূমিকা সম্পর্কে বোঝাতে ব্যাপকভাবে সহায়তা করবে। তাই স্তন্যদানকারী মায়েদের উচিত দুই বছর পর্যন্ত শিশুকে পর্যাপ্ত দুগ্ধপান নিশ্চিত করা, যা তাদের সুস্থ জীবনের বুনিয়াদ হিসেবে কাজ করবে এবং শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ও বুদ্ধির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ড. এ কে এম হুমায়ুন কবির অধ্যাপক (দুগ্ধবিজ্ঞান) ও বিভাগীয় প্রধান, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। ই-মেইল: [email protected]