আমার দাদা ক্লোড কোকবার্ন ঠিক সময়ে টের পেয়েছিলেন, কখন তাঁর বার্লিন ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। ১৯২০–এর দশকে তিনি বার্লিনে লন্ডন টাইমস–এর সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছিলেন। এরপর সেখান থেকে তিনি নিউইয়র্ক এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে চলে যান। ১৯৩২ সালের জুলাই মাসে আবার তিনি জার্মানিতে ফিরে যান।
কোকবার্ন লিখেছেন, সেখানে গিয়ে তিনি দেখতে পান, ‘কুর্ফুরস্টেন্ডাম শহরের বন্দুকধারী সেনারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন’ এবং যুদ্ধের প্রোপাগান্ডা হিসেবে, ‘যুদ্ধের বিশাল প্রদর্শনী হচ্ছে; প্রমাণ সাইজের একটি পরিখায় ডামি মেশিনগান নিয়ে প্রমাণ সাইজের সেনামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে।’ আমার দাদি হোপ হেল তখন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একজন সাংবাদিক। তিনি ওই সময়টাতে যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। দাদি তখন গর্ভবতী। আমার বাবা তখন তাঁর পেটে। ওই সময় বার্লিন থেকে দাদিকে লেখা একটি চিঠিতে দাদা কোকবার্ন বর্ণনা করেছিলেন, জার্মানির সবখানে তখন ফ্যাসিবাদ কীভাবে অনুভূত হচ্ছিল। তিনি লিখেছিলেন, এখানে যা বাস্তবে ঘটছে, তা কল্পনায় আনা কঠিন।
১৯১০-এর দশকে ফ্যাসিস্ট দেশগুলোতে গণমাধ্যমকে হয় আত্তীকরণ করা হয়েছিল, নয়তো কঠোরভাবে দমন করা হয়েছিল। নাৎসি জার্মানিতে হিটলারের প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলসের কঠোর নজরদারিতে সংবাদমাধ্যমগুলো চলছিল। সেখানে শুধু রাষ্ট্রের অনুমোদিত খবরগুলোই প্রচার হতে পারত। হিটলারের ওই সময়টাতে স্বাধীন সাংবাদিকতাকে শুধু নিরুৎসাহিতই করা হচ্ছিল না, স্বাধীন সাংবাদিকতা ছিল সাংঘাতিক বিপজ্জনক। সে সময় ভিন্নমতাবলম্বী লেখকদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। তাঁদের বইপত্তর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ফুয়েরারের আধিপত্যকে সহজতর করার জন্য থার্ড রাইখ (সে সময়কার জার্মানির নাৎসি সরকারকে থার্ড রাইখ বলা হতো) ভল্কসেম্পফাঙ্গার নামের একধরনের সস্তা রেডিও রিসিভারের উৎপাদনে ভর্তুকি দিয়েছিল। ইতালিতে মুসোলিনিও একই কাজ করেছিলেন। তাঁর সরকার শাসনক্ষমতাকে সংহত করতে এবং ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ প্রচার করতে হিটলারের কায়দায় হাতিয়ার হিসেবে সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করেছিল।
আজকের দিনের ইলন মাস্ক হিটলারের নাৎসি প্রচারমন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলসের মতো নন। তবে সৌরবিদ্যুৎ–চালিত গাড়ির কোম্পানি টেসলা ও ব্যক্তিমালিকানাধীন রকেট ও স্যাটেলাইট কোম্পানি স্পেসএক্স–এর সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (যেটি আগে ছিল টুইটার)–এর মালিক ইলন মাস্ক ধর্মান্ধতা ও ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ এবং কনটেন্টগুলো নিজেদের সুবিধামাফিক সঞ্চালনের মাধ্যমে ইলন মাস্ক তাঁর এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটিকে মাগাপন্থী (ট্রাম্পের নির্বাচনী স্লোগান ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’–এর সংক্ষিপ্ত রূপ ‘মাগা’) প্রচারে ব্যবহার করছেন। মাস্কের এই তৎপরতা ট্রাম্প-ভ্যান্স প্রচারে বিনিয়োগ করতে অন্যান্য প্রযুক্তিবিদ ধনকুবেরকেও উৎসাহ জোগাচ্ছে।
এক্স–এর প্রচারাভিযান সাংবাদিকদের ‘জনগণের শত্রু’ হিসেবে তুলে ধরছে। তারা সাংবাদিকদের এমনভাবে খলনায়ক হিসেবে দেখাতে চাইছে যে এখন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার হচ্ছে, হিটলারও ঠিক এই কাজ করেছিলেন। গোয়েবলস এমন একটি স্বৈরাচারী শাসনের মধ্যে তাঁর প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছিলেন, যেখানে গণমাধ্যম নিজেই বাক্স্বাধীনতাকে দমন করার এবং গণহত্যার চিন্তাকে প্রচার করার লক্ষ্য নিয়ে রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়িয়েছিল।
আমরা এমন একটি কথিত গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে কাজ করছি, যেখানে কোনো সরকারের তথ্যমন্ত্রী সংবাদপত্রগুলোকে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ কভার করার সময় সাংবাদিকদের ‘গণহত্যা’, ‘জাতিগত নির্মূল’, ‘শরণার্থীশিবির’, ‘ফিলিস্তিন’—এই ধরনের শব্দের ব্যবহার সীমিত করতে নির্দেশ দিতে সরাসরি বাধ্য করছেন না। কিন্তু নিউইয়র্ক টাইমস–এর মতো কিছু সংবাদপত্র নিজ থেকেই এসব শব্দের ব্যবহার সীমিত করতে তাদের সাংবাদিকদের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে।
গণমাধ্যমের প্রসারের এই যুগেও আমেরিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী একটি সংবাদমাধ্যম একটি বিতর্কে হোঁচট খাওয়া পারফরম্যান্সের পর জুন মাসজুড়ে একজন বয়স্ক প্রার্থীর শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে অপমানসূচক মন্তব্য করে গেছে। গত আগস্টে সেই একই সংবাদমাধ্যম সংবিধান স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়া এবং ‘প্রথম দিনেই’ স্বৈরশাসক হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্তি করা আরেক বয়স্ক প্রার্থীর বক্তব্যের নানা দিক বিশ্লেষণে মূল্যবান সময় ব্যয় করেছিল।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ উইকিলিকসের মাধ্যমে আফগানিস্তান এবং ইরাকে মার্কিন সরকারের হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ হাজির করে, এমন কিছু গোপন নথি প্রকাশ করেছিলেন। এর জন্য অ্যাসাঞ্জকে গুলি করা হয়নি। তবে তাঁকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল এবং গুপ্তচরবৃত্তি আইনের অধীনে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ১৯১৭ সালে আইনটি পাস হয়েছিল। আইনটি পাসের পর তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যাঁকে সাংবাদিকতার জন্য এই আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছিল।
লন্ডনের বেলমার্শ কারাগারে পাঁচ বছর আটক থাকার পর গত জুনে অ্যাসাঞ্জ নিজেকে দোষী স্বীকার করতে সম্মত হন। বিনিময়ে তাঁকে ছাড়া হয়। অর্থাৎ সাংবাদিকতা বা বাক্স্বাধীনতাকে কোনো ক্ষেত্রে আইনি কাঠামোয় আটকে দেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমকেই পোষ মানিয়ে একান্ত অনুগত করে ফেলা হচ্ছে। অর্থাৎ কোনো না কোনোভাবে সংবাদমাধ্যমকে আপস করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
আজ তথ্য নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলোতে নানা মাত্রা এসেছে। কিন্তু একটি বিষয় একই রয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে: সেটি হলো ভয় দেখানো। পদ্ধতিটি আজও সমানভাবে কার্যকর।
● লরা ফ্ল্যান্ডার্স যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়ভাবে সিন্ডিকেটেড টিভি ও রেডিও অনুষ্ঠান লরা ফ্ল্যান্ডার্স অ্যান্ড ফ্রেন্ডস-এর সঞ্চালক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত