১১ জুলাই থেকে প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনে যান বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলের এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা। ১৬ জুলাই থেকে স্কুল বন্ধ করে ক্লাস নেওয়া থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। তাঁদের দাবি মাধ্যমিক শিক্ষার জাতীয়করণ, যাতে এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের সমান বেতন-ভাতা, পেনশন সুবিধাদি পান এবং শালীন জীবন যাপন করতে পারেন। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকেরা যদি টিকে থাকতে না পারেন, তাহলে তাঁরা কীভাবে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করবেন।
শিক্ষকদের আন্দোলনের মূলে
শিক্ষকদের দাবির পটভূমি মূলত তিনটি বিষয়ে বৈষম্য: সরকারি শিক্ষকদের বাড়িভাড়া বেতনের ৪৫ শতাংশ, যেখানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা পান মাত্র ১০০০ টাকা; বেতনের ১০০ শতাংশ উৎসব ভাতা পান সরকারি শিক্ষকেরা, এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা পান মাত্র ২৫ শতাংশ; চিকিৎসা ভাতা এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা পান মাত্র ৫০০ টাকা, যেখানে সরকারি শিক্ষকেরা পান ১ হাজার ৫০০ টাকা। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পেনশন সুবিধা নেই।
শিক্ষকদের এই দাবি যৌক্তিক এবং সাধারণভাবে এর পক্ষে নাগরিক সহানুভূতিও আছে। প্রথাগতভাবে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু আশ্বাস, কিছু ষড়যন্ত্রতত্ত্ব, কিছু কমিটি গঠন ইত্যাদি করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু শিক্ষকেরা তাতে সাড়া দেননি। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ না পেলে আমরণ অনশনের হুমকি দেন তাঁরা।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ অবশ্য হয়নি। তবে ২ আগস্ট বৈষম্য দূর করার নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং সরকার গঠিত কমিটিতে শিক্ষক প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করার আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনের ইতি টেনে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যান শিক্ষকেরা।
পাকিস্তানের অবস্থানও আমাদের চেয়ে ভালো। শিক্ষা খাতে জিডিপির ৪ দশমিক ১ শতাংশ ব্যয় করে ভিয়েতনাম, আর নেপাল ব্যয় করে ৪ দশমিক ২ শতাংশ। ২০৪১ নিয়ে আমরা অনেক স্বপ্নের কথা শুনি। সেখানে যদি এমনকি আরও দেরিতেও পৌঁছাতে হয়, আমরা ন্যূনতম যা করতে পারি তা হচ্ছে, শিক্ষা খাতে ব্যয়ে ভিয়েতনামকে অনুসরণ করা, আর শিক্ষকদের একটু যত্ন নেওয়া। মনে রাখতে হবে, ‘মানবসম্পদ’ ছাড়া আর তেমন কিছু নেই আমাদের।
মাধ্যমিক শিক্ষা শিশুর অধিকার
প্রাথমিকের মতোই মাধ্যমিক শিক্ষাও একটি শিশুর অধিকার, আর তার সেই অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিঃসন্দেহে সরকারের। এ বিবেচনায় অন্তত গ্রাম-মফস্সলের সব স্কুল, যার ছাত্রদের প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসে, সে স্কুলগুলোর অর্থায়ন সরকারকেই করতে হবে। অথচ দেখা যাচ্ছে ১৯ হাজার ৬৬২টি বেসরকারি স্কুলের বিপরীতে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা মাত্রই ৬৯১টি।
মাধ্যমিক শিক্ষায় শিশুর যে অধিকার, তা দেখভালের দায়িত্ব প্রায় পুরোটাই বর্তাচ্ছে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর ওপর। মাধ্যমিক পর্যায়ের এক কোটি ছাত্রের শতকরা ৬ ভাগের কম শিক্ষা পাচ্ছে সরকারি বিদ্যালয়সমূহে। যেসব শহুরে স্কুলে ২০০০ থেকে ৫০০০ টাকা বেতন দিয়ে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত পরিবারের বাচ্চারা পড়ে, তাদের কথা বাদ দিলে অবশিষ্ট মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে ছাত্র বেতন দিয়ে শিক্ষকদের বেতন মেটানো অসম্ভব। তাই এ রকম সব স্কুল শেষ পর্যন্ত সরকারীকরণ করতেই হবে। এমপিওভুক্তিকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ হিসেবেই গণ্য করতে হবে।
‘অনাহারে’ ৩৩,০০০ শিক্ষক
প্রথম আলোয় সোহরাব হাসান যথার্থই লিখেছেন, ‘আধপেটা খেয়ে শিক্ষকেরা কী ছাত্র পড়াবেন’। এ নিয়ে আমি কথা বলেছি একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে, যিনি নিজে এমপিওভুক্ত ছিলেন। এমপিওভুক্ত যে শিক্ষকেরা ১১ নম্বর স্কেলে ১২ হাজার ৫০০ টাকা বেতন পান, তাঁরা সদ্য বিএ পাস করা নবীন যুবা, বয়স ২০-এর ঘরে। তাঁরা বিএড পাস করলেই বেতন দশম স্কেলে ১৬ হাজার থেকে শুরু। (বিএড পাস করা এখন খুবই সহজ, ভর্তি আর পরীক্ষা দিলেই হয়, প্রকৃত কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই ডিগ্রি অর্জন করা সম্ভব)। এরপর টাইম স্কেলে নবম গ্রেডে উঠলে ২২ হাজার টাকা। বার্ষিক ৫ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি আছে।
এর কোনোটাই খুব আকর্ষণীয় কিছু নয়, শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়ানো প্রয়োজন, এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তবে গ্রামীণ অর্থনীতির বিচারে এটাকে ঠিক ‘আধপেটা’ বলা যাবে না। তাই শব্দটি রূপক অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে বলে ধরে নিচ্ছি। প্রধান শিক্ষক আরও বলেছেন, আদায় করা ছাত্র-বেতন, ভর্তি ফি, পরীক্ষার ফি ইত্যাদি থেকেও তাঁরা কিছু সুবিধা নেন। আর প্রাইভেট পড়ানো তো আছেই।
১৭ হাজার ৬১৪টি এমপিওভুক্ত বেসরকারি বিদ্যালয়ের ১ লাখ ৯৯ হাজার ৮২১ জন শিক্ষক এমপিওর সুবিধা পান। স্কুলগুলোর ৭২ হাজার ৫৬৮ জন কর্মচারীও নিম্নতর গ্রেডে এই সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু এমপিওভুক্ত নয়, এমন অবশিষ্ট স্কুলগুলোতে যে ৩৩ হাজার ৪০৪ জন শিক্ষক ছাত্রদের পড়াচ্ছেন, তাঁদের কী অবস্থা?
সাধারণভাবে এরূপ শিক্ষকদের মাসিক বেতন সাকল্যে ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা। ইংরেজি বা অঙ্ক শিক্ষক পেতে পারেন সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। এবং এটুকু বেতন দিতে গিয়েই স্কুলগুলোর নাভিশ্বাস। সরকার থেকে এ বাবদ একটি টাকাও দেওয়া হয় না। ছাত্র-বেতন থেকে এর আংশিক নির্বাহ করা যায়। কোনো কোনো স্কুল বিত্তশালীরা প্রতিষ্ঠা করেন এবং চালিয়েও নেন। বাকিগুলোর অনেকটাই দিন আনি দিন খাই অবস্থা।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা যদি ‘আধপেটা’ অবস্থায় থেকে থাকেন, এই শিক্ষকেরা আছেন ‘অনাহারে’। তাঁরা আছেন, কারণ আর কোনো সুযোগ নেই তাঁদের। একটু ভালো শিক্ষক যাঁরা আছেন, তাঁদের ধরে রাখা যাচ্ছে না। রেলের নিম্নমান কেরানির চাকরি পেয়ে চলে যাচ্ছেন কেউ, কেউ আবার এমপিওভুক্তির পরীক্ষায় উতরে গিয়ে অন্য স্কুলে পদায়িত হচ্ছেন। প্রাইমারি স্কুলে সরকারি চাকরি পেয়েও প্রস্থান করছেন কেউ কেউ।
কী করা যায়?
১. এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দাবির মধ্যে অবিলম্বে চিকিৎসা ভাতা ১ হাজার ৫০০ টাকা করে দেওয়া যেতে পারে। তাঁদের দেওয়া বর্তমান ভাতা দৃশ্যমানভাবে বৈষম্যমূলক। উৎসব ভাতা অন্তত বেতনের ৫০ শতাংশ করা যায়, ভবিষ্যতে ১০০ শতাংশ করার পরিকল্পনাসহ।
২. পেনশনের বিষয়টি সমাধানে হয়তো সময় লাগতে পারে। তবে অবিলম্বে একটি থোক পেনশন বিবেচনা করা যায় (যেমন মাসে ৫ হাজার টাকা)। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া চলাকালে যাঁরা অবসরে যাবেন, তাঁরা এতে উপকৃত হবেন।
৩. গ্রামাঞ্চলের সব মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। বাস্তবায়নে কিছু সময় লাগবে, এটা মেনে নিতে হবে। নন-পারফর্মিং বিদ্যালয়গুলো এর আওতায় আসবে না। পর্যায়ক্রমে সেগুলোকে নিকটস্থ বিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত করা যেতে পারে। শহরের সচ্ছল স্কুলগুলোকে বিবেচনার বাইরে রাখা যায়।
৪. ন্যূনতম সুবিধা দিয়ে এমপিওবহির্ভূত এই ৩৩ হাজার শিক্ষককে এমপিওর আওতায় নিয়ে আসতে হবে অবিলম্বে। তবে তা করতে হবে কিছু সেফগার্ড রেখে:
ক. যে স্কুলগুলোর আউটপুট নগণ্য (কেউ পাস করেনি বা পাঁচজন পাস করেছে), সেগুলোকে প্রাথমিক তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। পরে তাদের বিগত পাঁচ বছরের সাফল্য–ব্যর্থতা বিবেচনা করে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
খ. দেখতে হবে যেন এ নিয়ে কেউ নিয়োগ-বাণিজ্য করার সুযোগ না পান।
আপাতত ৩৩ হাজার শিক্ষককে ন্যূনতম এমপিওর আওতায় নিয়ে আসতে বার্ষিক আনুমানিক ব্যয় হবে ৫০০ কোটি টাকা। ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার বাজেটের খুবই নগণ্য অংশ লাগবে এর বাস্তবায়নে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী জিডিপির অংশ হিসেবে শিক্ষা খাতে ব্যয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে অন্যতম পেছনে (২ দশমিক ১ শতাংশ)। (এর একটা বড় অংশ আবার ভৌত অবকাঠামোতে ব্যয় হয়।) এমনকি পাকিস্তানের অবস্থানও আমাদের চেয়ে ভালো (২ দশমিক ৪ শতাংশ)। শিক্ষা খাতে জিডিপির ৪ দশমিক ১ শতাংশ ব্যয় করে ভিয়েতনাম, আর নেপাল ব্যয় করে ৪ দশমিক ২ শতাংশ।
২০৪১ নিয়ে আমরা অনেক স্বপ্নের কথা শুনি। সেখানে যদি এমনকি আরও দেরিতেও পৌঁছাতে হয়, আমরা ন্যূনতম যা করতে পারি তা হচ্ছে, শিক্ষা খাতে ব্যয়ে ভিয়েতনামকে অনুসরণ করা, আর শিক্ষকদের একটু যত্ন নেওয়া। মনে রাখতে হবে, ‘মানবসম্পদ’ ছাড়া আর তেমন কিছু নেই আমাদের।
● মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব