বাড়তি ১১২ কিলোমিটার ট্রেনের ভাড়া রংপুরবাসী কেন দেবে

কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসে কুড়িগ্রামের জন্য আসন বরাদ্দ ১২৫টি। যাত্রী উঠতে পারে শুধু কুড়িগ্রাম স্টেশন থেকেছবি: প্রথম আলো

২ মে রংপুর এক্সপ্রেসে কথা হচ্ছিল রঞ্জন দের সঙ্গে। পেশায় সাংবাদিক। সান্তাহার স্টেশন থেকে উঠেছেন। ট্রেনের ক্যানটিনে আলাপ। সংবাদ সংগ্রহের কাজে উঠেছেন। তিনি বললেন, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ—দুই জেলার মধ্যে দূরত্ব মাত্র ৭২ কিলোমিটার। অথচ রেলপথে সান্তাহার, নাটোর ও ঈশ্বরদী ঘুরে আসতে হয় ১২০ কিলোমিটার। বাড়তি পথের সঙ্গে, বাড়তি সময়ের সঙ্গে এখন গুনতে হবে বাড়তি ভাড়া। এমনিতেই বগুড়ার লোক ট্রেনে চড়ে না, এখন আরও চড়বে না।

৩ মে, শুক্রবার। কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস। ক্যানটিনে কথায় কথা বাড়ে। ঢাকা থেকে কুড়িগ্রাম যাচ্ছি। নাটোর আসতেই কুড়িগ্রাম সমিতির মহাসচিব সাইদুল আবেদীন বলে উঠলেন, ‘এই যে নাটোর, ঈশ্বরদী, সান্তাহার, পার্বতীপুর হয়ে কুড়িগ্রাম যাওয়া লাগে, কেন? কেন বাড়তি ১২০ কিলোমিটার আমরা ঘুরব? কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট ও রংপুর সবচেয়ে গরিব জেলা। আমরা কেন বাড়তি ভাড়া দেব? এমনে আমাদের দুই ঘণ্টা বেশি লাগে!’

১৯৯০ সালের আগে চিলমারী থেকে চারটি লোকাল ট্রেন চলত। এখন সেই সকালে এক বেলা কেবল যাত্রী ভর্তি হয়ে চিলমারী কমিউটার রংপুর যায়। কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসে সবচেয়ে গরিব জেলার বাসিন্দাদের জন্য সুলভের বগি নেই। কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস চালুর পর সুলভ বগির দাবি করলে রেল কর্মকর্তা বলেছিলেন, বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ। সুলভের বগির দরকার নেই।

পাশে বসা শামীম (৪৫) নামের এক যাত্রী বললেন, ‘এই গাড়ির নাম কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস। কুড়িগ্রামে থামে শুধু একটি স্টেশনে আর সিট বরাদ্দ মাত্র ১২৫টি। রংপুরে তিনটি স্টেশনে সিট বরাদ্দ আড়াই শর বেশি। হামাক সবাই মফিজ বানে থুইছে। এমপিগুলেও কোনো আও (আওয়াজ) করে না। চিলমারী পর্যন্ত ট্রেন যে কুন দিন যাইবে, আল্লায় জানে।’

উল্লেখ্য, এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ রেলওয়েতে দূরত্বভিত্তিক ও সেকশনভিত্তিক রেয়াতি দেওয়া হয়। গত ১৬ মার্চ বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার শাহাদাৎ আলী রেলের ভাড়া বাড়ছে বলে জানিয়েছিলেন। সে সময় ভাড়া বৃদ্ধির গুঞ্জন ওঠার পর রেলমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, রেলের ভাড়া বৃদ্ধির কোনো পরিকল্পনা নেই।

এ ছাড়া রেলমন্ত্রী বলেন, যখন রেয়াতি দেওয়া হয়েছিল, তখন তো রেলে প্যাসেঞ্জার চড়ত না। তখন রেয়াতি দিয়ে যাত্রীদের আকর্ষণ করা হতো। এখন তো ট্রেনে প্যাসেঞ্জার ওঠে, পর্যাপ্ত যাত্রী ওঠে ট্রেনে।

কথার মানে হলো, যত দোষ রেলযাত্রীদের। তারা ট্রেনে না উঠলে রেলমন্ত্রী রেয়াত তুলে দিতেন না। বাহ!

আরও পড়ুন

দুই.

সম্প্রতি বাংলাদেশ রেলওয়েতে যাত্রীবাহী ট্রেনগুলোয় ভাড়া বৃদ্ধি না করে শুধু বিদ্যমান দূরত্বভিত্তিক রেয়াত প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে সব ধরনের যাত্রীবাহী ট্রেনে বিদ্যমান দূরত্বভিত্তিক রেয়াত প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তটি ৪ মে থেকে কার্যকর করা হয়েছে।

অর্থাৎ এখন রেয়াতি ব্যবস্থার কারণে দূরপাল্লার ট্রেনে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে ছাড় পেয়ে থাকে যাত্রীরা। এ ব্যবস্থায় ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ছাড়ের সুবিধা নেই। তবে ১০১ থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরত্বের ভ্রমণে ভাড়ার ওপর রেয়াতের হার ২০ শতাংশ। এতে রংপুর বিভাগের যাত্রীরা যে নাটোর-চাটমোহর ঘুরে বাড়ির কাছের সিরাজগঞ্জে ফিরে বঙ্গবন্ধু সেতুতে ওঠে, সে কারণে বাড়তি সময় গেলেও সঙ্গে বাড়তি ভাড়াও দিতে হয় না।

এখন বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেললাইন চালু না করে, রেলওয়েসৃষ্ট ঘোরা পথের ১১২ কিলোমিটারের ভাড়ার দায় মেটাতে হবে রংপুর বিভাগের যাত্রীদের। রাষ্ট্রের চোখে ভাড়া বৃদ্ধির কথা অস্বীকার করা হচ্ছে।

অথচ ১৯৯০ সালের আগে চিলমারী থেকে চারটি লোকাল ট্রেন চলত। এখন সেই সকালে এক বেলা কেবল যাত্রী ভর্তি হয়ে চিলমারী কমিউটার রংপুর যায়। কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসে সবচেয়ে গরিব জেলার বাসিন্দাদের জন্য সুলভের বগি নেই। কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস চালুর পর সুলভ বগির দাবি করলে রেল কর্মকর্তা বলেছিলেন, বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ। সুলভের বগির দরকার নেই।

খানা জরিপগুলোয় বারবার গরিব জেলার উপাধি পেয়েছে কুড়িগ্রাম। রাষ্ট্রের গরিবতম জেলার বাসিন্দারা রাষ্ট্রের সবচেয়ে কম সুবিধা পায়। কুড়িগ্রাম জেলায় দলীয় ভাগবাঁটোয়ারায় সংসদ সদস্য হন বাস মালিক সমিতির নেতা। কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা এসে কাউন্সিল ছাড়াই ঠিক করে দিয়ে যান সভাপতি ও সেক্রেটারির নাম। ফলে এই নেতারা কেমন করে লালু প্রসাদ যাদবের মতো জানবেন, রাজারহাটের সুপারি ও লটকন, দুর্গাপুরের চাটাই, চিলমারীর জোড়গাছ হাটের মসলা ও কালাই রংপুর ও ঢাকায় না গেলে কর্মসংস্থান ও বৈচিত্র্যময় ফসলের আবাদ বন্ধ হয়ে যাবে। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে মঙ্গা বারবার ফিরবে।

কেবল খানা জরিপগুলোয় যখন প্রকাশিত হয় কুড়িগ্রামের দারিদ্র্যের শীর্ষে ওঠার খবর, তখন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে তাগিদ আসে। কর্তারা হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন কারণ। অন্যদিকে রেলের কর্তারা কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসে সুলভ বগি রাখার দাবি বাতিল করে দেন মধ্য আয়ের দেশের দোহাই পেড়ে।

বৈষম্যকে জিইয়ে রেখে কীভাবে রেখে মধ্য আয়ের দেশ হবো আমরা?

  • নাহিদ হাসান রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সাবেক সভাপতি
    [email protected]