রেল খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের পরও সংকট কাটছে না। অপর্যাপ্ত ও মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন ও কোচ, পুরোনো ও জীর্ণ রেললাইন এবং ঝুঁকিপূর্ণ সেতু, ধীরগতি আর চাহিদা অনুযায়ী টিকিট না পাওয়ার অভিযোগের মধ্যেই লোকসান গুনে চলেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। গত অর্থবছরে রেলের পরিচালন ব্যয় ৩ হাজার ৭৬২ কোটি, বিপরীতে আয় ১ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। লোকসান ২ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। ২০১২ ও ২০১৬ সালে দুই দফায় রেলের ভাড়া বাড়ানো হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। কারণ, আয় বাড়ানোর জন্য ভাড়া বাড়ানোই একমাত্র বা সঠিক উপায় নয়। এর জন্য ট্রেনপ্রতি আয় বাড়াতে হবে ও ব্যয় হ্রাস করতে হবে।
ভাড়া ছাড়াও ট্রেনপ্রতি যাত্রীবাহী কোচের সংখ্যা, বিভিন্ন ধরনের যাত্রীবাহী কোচের কম্বিনেশন, কোচের যাত্রী ধারণক্ষমতা এবং কোচের সিটের কত শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে (অকুপেন্সি রেট) তার হার ইত্যাদির ওপর ট্রেনপ্রতি আয় নির্ভর করে। ফলে যেসব রুটের ট্রেন জনপ্রিয় এবং কোচগুলো সব সময় যাত্রীবোঝাই হয়ে চলে, সেসব রুটের ট্রেনে কোচসংখ্যা বাড়ানো হলে আয় বৃদ্ধি পায়।
একসময় লোকসানে থাকা ভারতীয় রেলওয়ে এভাবে কোচপ্রতি ও ট্রেনপ্রতি আয় বাড়িয়েছে। ভারতীয় রেলওয়ের এ ঘুরে দাঁড়ানোর বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় সুধীর কুমার ও শাগুন মেহরোত্রা লিখিত ব্যাংকরাপ্টসি টু বিলিয়নস: হাউ ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ট্রান্সফরমড শীর্ষক বইয়ে। উদাহরণস্বরূপ ‘গরিব রথ’ ট্রেনটির কথা বলা যায়। এটি কম খরচে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যাত্রীসেবা দিয়ে থাকে। অন্য সাধারণ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ট্রেনের তুলনায় অর্ধেক ভাড়ায় এই ট্রেনে চড়া যায়। ট্রেনটির কোচের সংখ্যা এবং যাত্রী ধারণক্ষমতা বাড়িয়ে প্রতি একক খরচ হ্রাস করা হয়। একটি স্ট্যান্ডার্ড ট্রেন যেখানে ৮১৬ যাত্রী বহন করে, গরিব রথের ক্ষেত্রে তা দ্বিগুণের বেশি।
রাষ্ট্রের সেবা খাত হিসেবে এবং জনগণের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ, সস্তা ও পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবে রেলওয়েকে সব সময় লাভজনক হতেই হবে, এমন হয়তো কোনো কথা নেই। কিন্তু জনগণকে সেবা দিয়েও যে রেলওয়ে লাভজনক হতে পারে, সে দৃষ্টান্ত প্রতিবেশী দেশ ভারতেই দেখা যায়। বাংলাদেশেও তা সম্ভব, যদি রেলওয়ে খাতের অপচয়, দুর্নীতি ও লোপাট বন্ধ করা হয়, যদি রেলওয়ের মালিকানাধীন জমি ও সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হয়, যদি রেলওয়ের অবকাঠামো উন্নয়নে ধারাবাহিক, পরিকল্পিত ও সমন্বিত বিনিয়োগ করা হয়।
কিন্তু বাংলাদেশে চাহিদা ও জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও সে অনুসারে রেলের আয় বাড়ছে না। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের সুবর্ণ এক্সপ্রেস, মহানগর এক্সপ্রেস, সোনার বাংলা, তূর্ণা-নিশিথাসহ ট্রেনগুলোর ২২টি বগি নিয়ে চলাচল করার ক্ষমতা থাকলেও চালানো হয় ১২–১৬ বগি নিয়ে। একসময় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে দুটি ট্রেন দিনে ৩২ বার যাতায়াত করলেও ইঞ্জিন ও কোচের সংকটে একটি ট্রেন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা দিনে ১৬ বার যাতায়াত করে। অথচ এই পথে ট্রেনের চাহিদা এত বেশি যে দিনে শতবার যাতায়াত করলেও যাত্রীর অভাব হবে না। এই চিত্র সারা দেশের।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, রেলের সব কটি ট্রেন নিরবচ্ছিন্নভাবে চালাতে হলে দরকার ৩ হাজারের বেশি কোচ আর প্রায় ৫০০ ইঞ্জিন। কিন্তু রেলে বর্তমানে কোচ আছে ১ হাজার ৬৮৪ যার ৪৭ শতাংশেরই মেয়াদকাল (৩৫ বছর) শেষ। আর ইঞ্জিনের সংখ্যা মাত্র ২৬৩, যার ৬৭ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ (২০ বছর)। এই জীর্ণ–পুরোনো ইঞ্জিন ও কোচগুলো প্রায়ই নষ্ট থাকায় সব সময় কাজে লাগানো যায় না। ইঞ্জিন ও কোচের এই তীব্র সংকটের কারণে খাতা–কলমে ৩৬৮টি ট্রেন থাকলেও বাস্তবে চলছে মাত্র ২৭৬টি।
এভাবে অনেক রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ করা বা কমিয়ে দেওয়া এবং চলমান ট্রেনগুলোও সক্ষমতার চেয়ে কম কোচ নিয়ে চলাচলের কারণে রেলপথপ্রতি ও রেলপ্রতি আয় কম হচ্ছে। ফলে বর্তমানে ট্রেন পরিচালনায় প্রত্যেক যাত্রীর পেছনে কিলোমিটারপ্রতি প্রায় আড়াই টাকা ব্যয়ের বিপরীতে আয় হয় তার অর্ধেক।
২.
শুধু যাত্রী পরিবহনে রেলকে লাভজনক করা যায় না, মালামাল পরিবহনে গুরুত্ব দিতে হবে। মালবাহী ট্রেন যাত্রীবাহী ট্রেনের তুলনায় বেশি ভার বহন করলেও উভয়ে একই ড্রাইভার, রেললাইন, সিগন্যাল ব্যবস্থা ইত্যাদি ব্যবহার করে। ফলে একটি মালবাহী ট্রেন পাঁচ গুণ ভার বহন করলেও খরচ যাত্রীবাহী ট্রেনের তুলনায় দ্বিগুণের কম হয়। তা ছাড়া ভারী পণ্য বিপুল পরিমাণে একত্রে পরিবহনের সক্ষমতা থাকলেও সেই সুবিধানজনক অবস্থানকে কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ রেলওয়ে। ভারতীয় রেলের মোট আয়ের ৭০ শতাংশের বেশি আসে পণ্য পরিবহন থেকে এবং যাত্রী পরিবহনে যে খরচ হয়, গড়ে তার ৪৩ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হয় পণ্য পরিবহনের আয় থেকে। অন্যদিকে বাংলাদেশ রেলওয়ের আয়ের মাত্র ২১ শতাংশ আসে পণ্য পরিবহন থেকে। সড়কের চেয়ে খরচ কম হলেও রেলে সময় লাগে বেশি। ফলে দেশের মোট কনটেইনারের মাত্র ৩ শতাংশ পরিবহন হয় রেলওয়ের মাধ্যমে।
তুলনামূলকভাবে বেশি প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে থাকা ক্ষেত্রগুলোতে ভাড়া কিছুটা বাড়িয়ে এবং যেসব ক্ষেত্র দুর্বল অবস্থানে রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে পণ্যের ভাড়া কিছুটা কমিয়ে হারানো বাজার পুনরুদ্ধার করে মালামাল পরিবহন অধিক লাভজনক করেছে ভারতীয় রেলওয়ে। আবার যেসব রুটে মালবাহী বগিগুলোকে খালি ফিরতে হয়, সেগুলোতে মালামাল পরিবহনে আকর্ষণ করতে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়েছে। সরবরাহব্যবস্থায়ও নানা পদক্ষেপ নিয়ে দ্রুততর, দীর্ঘতর ও অপেক্ষাকৃত ভারী ট্রেন চালানোর মাধ্যমে প্রতি একক খরচ কমানো হয়েছে।
৩.
২০০৯ সাল থেকে রেলের উন্নয়নের পেছনে ৭২ হাজার কোটি টাকা খরচের কথা বলা হলেও তার কতটুকু মৌলিক কাঠাগোমগত সমস্যা সমাধানে কাজে লেগেছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এই খরচের বড় অংশই গেছে নতুন রেললাইন ও স্টেশন ভবন নির্মাণের পেছনে। পুরোনোগুলো মেরামতের চেয়ে নতুন লাইন নির্মাণে বেশি ব্যয় করা হয়েছে। হাজার কোটি টাকার নতুন রেললাইন দিয়ে নামেমাত্র ট্রেন চালানো হচ্ছে। পর্যাপ্ত ইঞ্জিন ও কোচের ব্যবস্থা না করেই একের পর এক নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। স্টেশন ভবন নির্মাণের পর লোকবলের অভাবে সেগুলো চালানো যাচ্ছে না। এ সময় ৮৪টি ইঞ্জিন ও ৫২০টি কোচ কেনা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যেগুলো কেনা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে নানান অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আছে।
রাষ্ট্রের সেবা খাত হিসেবে এবং জনগণের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ, সস্তা ও পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবে রেলওয়েকে সব সময় লাভজনক হতেই হবে, এমন হয়তো কোনো কথা নেই। কিন্তু জনগণকে সেবা দিয়েও যে রেলওয়ে লাভজনক হতে পারে, সে দৃষ্টান্ত প্রতিবেশী দেশ ভারতেই দেখা যায়। বাংলাদেশেও তা সম্ভব, যদি রেলওয়ে খাতের অপচয়, দুর্নীতি ও লোপাট বন্ধ করা হয়, যদি রেলওয়ের মালিকানাধীন জমি ও সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হয়, যদি রেলওয়ের অবকাঠামো উন্নয়নে ধারাবাহিক, পরিকল্পিত ও সমন্বিত বিনিয়োগ করা হয়।
● কল্লোল মোস্তফা লেখক ও প্রকৌশলী, সর্বজনকথা সাময়িকীর নির্বাহী সম্পাদক