ইউক্রেনের সেনাপ্রধানের দায়িত্ব থেকে ভ্যালেরি জালুঝনিকে সরিয়ে দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। এর মধ্য দিয়ে ইউক্রেনের অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘লৌহ’-জেনারেলের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের যে মনোমালিন্য বেড়েই চলেছিল, সেই সমস্যার হয়তো সাময়িক সমাধান হয়েছে।
যুদ্ধ যখন তৃতীয় বছরে প্রবেশ করতে চলেছে, তখন প্রেসিডেন্টের এই পদক্ষেপ রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে কীভাবে ইউক্রেন জিতবে অথবা যুদ্ধে দেশটি কীভাবে টিকে থাকবে, সেই মৌলিক প্রশ্নের সমাধান দিচ্ছে না।
ইউক্রেন নিয়ে এখন বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে, যেগুলো একত্র করলে সেখানকার সংকট সামরিক নেতৃত্বে অদল-বদল করার চেয়েও গভীর ও জটিল। আমরা যদি একটা বড় প্রেক্ষাপট থেকে দেখি, তাহলে যুদ্ধটা কোন দিকে যাচ্ছে, সেটা চারটি প্রধান বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাব্যবস্থাও নির্ভর করছে এ চার প্রশ্নের ওপর। ইউক্রেনের বর্তমান বাস্তবতা এবং ভবিষ্যতের টিকে থাকা ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তাদের সম্পর্কও এ চারটি বিষয় বিশ্লেষণের ওপর নির্ভর করছে।
প্রথমত, ২০২৩ সালের ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ অভিযানের ব্যর্থতা এবং ইউক্রেনের সম্মুখভাগ এবং পশ্চাদ্ভূমিতে রুশ বাহিনীর ক্রমাগত চাপ গুরুতর যে প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসছে, সেটি হলো এই যুদ্ধে জেতার সামর্থ্য কিয়েভের কি আছে? ইউক্রেনের দিক থেকে চূড়ান্ত বিজয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে (২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের যতটা ভূখণ্ড রাশিয়া দখল তার সবটা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া), সেটি বিবেচনায় নিলে এটি অত্যন্ত গুরুতর প্রশ্ন।
ইউক্রেনের আভদিবকা শহরের আসন্ন পতন এ প্রশ্নই সামনে নিয়ে এসেছে যে একটা নিষ্ঠুর প্রতিপক্ষ, যারা অস্ত্র ও লোকবলে শ্রেষ্ঠ, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কিয়েভের সক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্কের ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে আভদিবকা শহরটির অবস্থান।
২০২৩ সালের মে মাসে বাখমুত পতন অথবা ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সোলেদর পতনের মতোই আভদিবকার পতন ইউক্রেনের জন্য কৌশলগত নয়, বরং প্রতীকী পরাজয়। কিন্তু সব পরাজয়কে একত্র করলে এবং ২০২৩ সালের পাল্টা আক্রমণ অভিযান ব্যর্থ হওয়ার ঘটনা বিবেচনায় নিলে ইউক্রেনের এ পরাজয় শুধু প্রতীকী পরাজয় নয়। বাখমুত, সোলেদর, আভদিবকার মতো এসব যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অর্থ, জনবল ও সামরিক সরঞ্জাম হারিয়েছে ইউক্রেন।
সংকট সমাধানের জন্য সাংবিধানিক আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে। কিন্তু জেলেনস্কির বিরোধিতাকারীরা একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য চাপ দিয়ে আসছে। ইউক্রেনে যখন রাজনৈতিক ঐক্যের দরকার, সে সময় সেখানে আরও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হতে চলেছে।
জালুঝনিকে বরখাস্ত করার পেছনে ইউক্রেনের গত বছরের হতাশাজনক অবস্থার প্রতিফলন। এই বরখাস্তের ঘটনা আরেকটি বিষয়কে পরিষ্কারভাবে সামনে নিয়ে এসেছে। সেটা হলো, এসব বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নেননি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট।
প্রকৃতপক্ষে, নতুন সেনাপ্রধান আলেকসান্দ্রা সিরিক্সি এসব খরুচে পরাজয়ের বেশ কয়েকটির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সিরস্কিকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া সে কারণেই ইউক্রেনের কৌশলগত জায়গায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন নয়।
তবে ২০২২ সালে যুদ্ধের প্রথম দিকে কিয়েভের প্রতিরক্ষার মূল কৌশলপ্রণেতা ছিলেন সিরিক্সি। এরপর সে বছরের গ্রীষ্মকালে পাল্টা আক্রমণ অভিযানে খারকিভ ও খেরসনের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভূখণ্ড পুনর্নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ক্ষেত্রেও সিরিস্কির ভূমিকা ছিল।
কিন্তু ইউক্রেনের এসব বিজয় ছিল রুশ সেনাবাহিনীতে একবারে বিশালসংখ্যক লোকবল নিয়োগ এবং রুশ অর্থনীতিকে যুদ্ধ-অর্থনীতিতে রূপান্তর করার আগের ঘটনা।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে, ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে সফল হতে পেরেছিল, তার কারণ হলো পশ্চিমারা ইউক্রেনকে পুরোদমে সহায়তা দিয়ে চলেছিল। কিন্তু সেই বাস্তবতা অনেক দিন আগেই চলে গেছে।
এ ব্যাপারে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ আছে যে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস ইউক্রেনে আরও সামরিক সহায়তা পাঠিয়ে যুদ্ধ প্রলম্বিত করতে চায়। কিন্তু ২০২৪ সালের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রিপাবলিকানদের মনোনীত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। ন্যাটোর প্রতি ট্রাম্পের যে প্রতিশ্রুতির ঘাটতি, তাতে আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে ট্রাম্প নির্বাচিত হলে সেটা ইউক্রেনের জন্য আরও বড় দুশ্চিন্তার কারণ হবে।
কিছু ক্ষেত্রে ওজর-আপত্তি থাকা সত্ত্বেও ইউক্রেনের প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনো প্রতিশ্রুতিশীল। সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২৭ সাল পর্যন্ত ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়ার জন্য নতুন ৫০ বিলিয়ন ডলার ইউরো প্যাকেজ অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু ইউক্রেনের বাজেট-ঘাটতি মেটাতে এই অর্থ খুব বেশি কাজে আসবে না। বাইরের সহযোগিতা ছাড়া ইউক্রেনের নিজেদের কিছু করার যে অক্ষমতা, তাতে যুদ্ধের তৃতীয় বছরে এসে তারা আরও কঠিন অবস্থায় পড়বে।
তৃতীয়ত, যত দিন গড়াচ্ছে, ততই ইউক্রেনীয় সমাজে যুদ্ধক্লান্তি বাড়ছে। সেনাবাহিনীর বিপর্যয়, অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি, জীবনযাপনের মান কমে যাওয়া, দুর্নীতি এবং সামরিক ও বেসামরিক দুই জায়গাতেই অসংখ্য প্রাণহানি—এসব কারণে ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধ টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
চতুর্থত, জেলেনস্কির প্রেসিডেন্টের মেয়াদ ২০২৪ সালের মে মাসে শেষ হচ্ছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী সামনের শরতে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা; যদিও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু সে ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ও আইনসভার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন সেখানে চলে আসবে।
সংকট সমাধানের জন্য সাংবিধানিক আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে। কিন্তু জেলেনস্কির বিরোধিতাকারীরা একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য চাপ দিয়ে আসছে। ইউক্রেনে যখন রাজনৈতিক ঐক্যের দরকার, সে সময় সেখানে আরও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হতে চলেছে।
এটা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয় যে জালুঝনির বরখাস্ত ইউক্রেনের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর শক্তি বৃদ্ধি করবে কি না। কিন্তু জালুঝনির জায়গায় সিরস্কিকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে বসানোর ঘটনা ইঙ্গিত দিচ্ছে, সামরিক কৌশলে ইউক্রেন মৌলিক কোনো কৌশলগত পরিবর্তন আনেনি।
ইউক্রেন এখন যে পথে এগোচ্ছে, তাতে ইউক্রেনীয়দের অনেক বেশি আত্মত্যাগ করতে হবে।
• স্টেফান উলফ বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ে অধ্যাপক
• জেন মানেত, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ওদেসা ল একাডেমির ইউরোপীয় নিরাপত্তা বিষয়ের অধ্যাপক