যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাথমিক ধাপের প্রচার (যেটিকে সবাই ‘প্রাইমারি’ বলে থাকে) মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে সম্ভাব্য চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে যে দুজনের কথা মনে করা হচ্ছে, তাঁদের একজন জো বাইডেন এবং অন্যজন হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অর্থাৎ এই দুজন আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মুখোমুখি হবেন।
২০২০ সালের নির্বাচনী নকশা অবলম্বনে বিচার করা হলে বাইডেনই জয়ী হবেন বলে মনে হয়। কিন্তু আমেরিকার রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আগেভাগে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না এবং দুই নেতার স্বাস্থ্যগত, আইনি অথবা অর্থনৈতিক অবস্থা ঘিরে ঘটা যেকোনো চমকে দেওয়া ঘটনা যেকোনো সময় দৃশ্যপট বদলে দিতে পারে। সে কারণে আমার অনেক বিদেশি বন্ধু আমাকে সমানে জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছেন, ট্রাম্প যদি সত্যি সত্যি হোয়াইট হাউসে ফিরে আসেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি কী হবে?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুবই কঠিন। কারণ, ট্রাম্প নিজেই অনিশ্চিত মেজাজের লোক এবং তাঁর মতিগতি নিয়ে আগেভাগে কিছু বলা সম্ভব নয়। তাঁর প্রথম রাজনৈতিক কার্যালয়ই ছিল প্রেসিডেন্টের কার্যালয় এবং তাঁর রাজনৈতিক আচরণও ছিল অত্যন্ত অপ্রচলিত।
টেলিভিশনের রিয়েলিটি শোর তারকা হিসেবে ট্রাম্পের সাফল্য এটিই প্রমাণ করে, তিনি সব সময়ই ক্যামেরার মনোযোগ আকর্ষণে ব্যস্ত ছিলেন; আর সে কারণেই তাঁকে আমরা এমন সব কথাবার্তা বলতে শুনেছি, যা সত্য থেকে অনেক দূরবর্তী। তাঁকে এমন সব আচরণ করতে দেখেছি, যা প্রচলিত রীতিনীতিকে ভেঙে দেয়।
ট্রাম্প এ বিষয়ে অবহিত যে বিশ্ববাণিজ্যের অসম অর্থনৈতিক প্রভাবকে প্রত্যাখ্যান করে এবং অভিবাসন ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের বিষয়ে মার্কিন নাগরিকদের মনে জমে থাকা ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে তিনি জনগণের মধ্যে, বিশেষ করে কলেজের গণ্ডি পার হননি, এমন শ্বেতাঙ্গ বৃদ্ধদের উন্মত্ত করে তুলতে পারেন। ক্রমাগত জনতুষ্টিবাদী, সংরক্ষণবাদী ও জাতীয়তাবাদী ভাষণ দিয়ে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে সংবাদমাধ্যমের আলোচনায় থেকেছেন।
২০১৬ সালের আগে বহু মানুষ মনে করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প তাঁর রাজনৈতিক আবেদনকে প্রসারিত করে সমর্থক ও বিরোধী—সব মহলের প্রেসিডেন্ট হবেন। বেশির ভাগ রাজনীতিকই তা-ই করেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও তিনি সবার হতে পারেননি; তিনি অনুগতদের প্রতি অতিমাত্রায় পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করে যাচ্ছিলেন এবং যাঁরাই তাঁর সমালোচনা করেছেন, এমনকি তাঁরা নিজের দলের কংগ্রেসম্যান হলেও, তাঁদের বিরুদ্ধে সেই অনুগত গোষ্ঠীকে খেপিয়ে তুলেছেন।
রিপাবলিকানদের মধ্যে পর্যন্ত যাঁরা প্রকাশ্যে ট্রাম্পের বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁরা তাঁদের ট্রাম্প-সমর্থিত প্রতিপক্ষদের কাছে হেরে গেছেন। এর ফলে ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টিতে প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। ২০২০ সালের নির্বাচনে তাঁর উগ্র ডানপন্থী আবেদনের কারণে হয়তো তাঁকে প্রধান প্রধান দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যে কিছু উদার রিপাবলিকান ও দলনিরপেক্ষ ভোটারদের সমর্থন হারাতে হয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প যে আচরণ করে গেছেন, সেটি বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, তিনি তাঁর অবস্থান থেকে একটুও সরেননি। তিনি এখনো ২০২০ সালের নিজের পরাজয়কে স্বীকার করেন না এবং এখনো উগ্র রক্ষণশীল অনুগতদের জমায়েত করে হোয়াইট হাউসে ফেরার প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন। ফলে যদি ট্রাম্প ফিরে আসেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি আবার অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প নিজেকে তাঁর পূর্বসূরিদের চেয়ে একেবারে আলাদা প্রকৃতির বলে প্রমাণ করেছেন। তিনি প্রায়ই বড় ধরনের নীতির বিষয় (এমনকি মন্ত্রীদের বরখাস্ত করার কথা) টুইটারে ঘোষণা দিতেন এবং মনে হতো, তিনি কতকটা তাৎক্ষণিক ঝোঁকের বশে এসব ঘোষণা দিতেন। হুটহাট করে যাঁকে–তাঁকে, যখন-তখন বরখাস্ত করার কারণে তাঁর প্রশাসনে শীর্ষ কর্মীদের ঘন ঘন পরিবর্তন এবং পরস্পরবিরোধী নীতির বার্তা ঘোষণার দ্বারা চিহ্নিত হয়ে উঠেছিল।
পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর নিজের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ক্ষমতাও ছেঁটে দিয়েছিলেন। তাঁর কোনো কাজ কারও পক্ষে আগেভাগে বুঝে উঠতে না পারার বিষয়টিকে তিনি তাঁর প্রধান রাজনৈতিক হাতিয়ার বানাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ট্রাম্প ঐতিহ্যগত রিপাবলিকান নীতির বাইরে গিয়ে গভীরভাবে নিজস্ব নীতিতে বিশ্বাসী। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্য খাতে সুরক্ষাবাদী মতামত প্রকাশ করে আসছেন এবং আমেরিকার মিত্ররা বাণিজ্যিক সংহতির নামে আমেরিকার কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা নিচ্ছে দাবি করে জাতীয়তাবাদী বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।
তিনি প্রকাশ্যে ১৯৪৫-পরবর্তী উদারনৈতিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং ন্যাটোকে একটি অসার সংগঠন বলে ঘোষণা করেছেন। এর ফলে তাঁর সাবেক অন্যতম জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ট্রাম্প যদি আবার প্রেসিডেন্ট হন, তাহলে তিনি ন্যাটো থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। ট্রাম্প সম্প্রতি তাঁর দিক থেকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘ন্যাটোর উদ্দেশ্যকে পুনর্মূল্যায়ন করতে আমার প্রশাসন যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিল, আমরা তা অবশ্যই শেষ করব।’
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তিনি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে এনেছিলেন এবং প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার তদবিরে করা আন্তপ্রশান্ত মহাসাগরীয় অংশীদারত্ব থেকেও বেরিয়ে এসেছিলেন। তিনি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে দুর্বল করে দিয়েছিলেন। তিনি মিত্রদেশগুলো থেকে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানিতে বাণিজ্য শুল্ক বসিয়েছিলেন; চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছিলেন; ইরান চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন; জি-৭-এর কড়া সমালোচনা করেছিলেন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করা কুখ্যাত কর্তৃত্ববাদী শাসকদের প্রশংসা করেছিলেন। তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখেছিলেন এবং ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন দেওয়া থেকে দূরে ছিলেন।
জরিপে দেখা গেছে, ট্রাম্পের সময় আমেরিকার প্রাধান্যবিস্তারী ক্ষমতা বা সফট পাওয়ার লক্ষণীয়ভাবে কমে গিয়েছিল। টুইটার বার্তা একটি বৈশ্বিক অ্যাজেন্ডাকে যেমন তৈরি করতে সাহায্য করে, আবার সেই বার্তার বিষয় ও প্রকাশভঙ্গি অন্য দেশকে আহতও করতে পারে। ট্রাম্প বরাবরই মানবাধিকার বিষয়ে খুবই কম মনোনিবেশ করেছেন। বিশ্ব প্রতিষ্ঠানগুলোকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুবাদে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে যে সুবিধা ভোগ করে এসেছে, তিনি তা-ও খর্ব করেছেন।
ট্রাম্প জনমতকে নিজের দিকে টানার যোগ্যতা ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছেন। কিন্তু প্রশাসক হিসেবে তাঁর আবেগনির্ভর বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতার অভাব রয়েছে। তাঁর ব্যক্তিগত হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে আমেরিকার মিত্রদের অবস্থানকেও দুর্বল করেছে। যেমন ২০১৮ সালে রাশিয়ার পুতিন এবং উত্তর কোরিয়ার কিম জং-উনের সঙ্গে বৈঠক করে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিত্রদের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প যে আচরণ করে গেছেন, সেটি বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, তিনি তাঁর অবস্থান থেকে একটুও সরেননি। তিনি এখনো ২০২০ সালের নিজের পরাজয়কে স্বীকার করেন না এবং এখনো উগ্র রক্ষণশীল অনুগতদের জমায়েত করে হোয়াইট হাউসে ফেরার প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন। ফলে যদি ট্রাম্প ফিরে আসেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি আবার অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জোসেফ এস নাই হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানবিষয়ক লেখক