জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্দেশনা মেনে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাব শুরু করেছে। বহুদিন ধরে এ ব্যাপারে আইএমএফ বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছিল, কিন্তু রহস্যজনকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক সেই নির্দেশনা মানছিল না।
২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, কিন্তু আইএমএফ ওই ঘোষণা মেনে নেয়নি। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ওই ঘোষিত রিজার্ভ থেকে রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ডের মাধ্যমে প্রদত্ত সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার বাদ দিতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ নিজেদের রিজার্ভ থেকে শ্রীলঙ্কাকে যে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে, তা-ও বাদ দিতে হবে। আরও বাদ দিতে হবে রিজার্ভ থেকে পায়রা বন্দরের বামনাবাদ চ্যানেল খননের জন্য এবং বাংলাদেশ বিমানকে বিমান কেনার জন্য যে ঋণ দেওয়া হয়েছে, সে অর্থও।
এটা খুবই দুঃখজনক যে দীর্ঘ প্রায় দুই বছর বাংলাদেশ ব্যাংক এবং দেশের সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব আইএমএফের এসব আপত্তির ধার ধারেনি। এখন যখন বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে, তখন বাধ্য হয়ে ওই ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার শর্ত পূরণের উদ্দেশ্যে রিজার্ভ হিসাব করার সর্বশেষ পদ্ধতি বিপিএম-৬ মেনে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এমন বিলম্বের ফলে অর্থনীতির যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে, তার দায়ভার কে নেবে?
পুরোনো বিপিএম-৫ পদ্ধতি অনুসরণ করে ‘ইনফ্লেটেড বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ’ দেখানোর কারণে গত দুই বছরে বেশ কয়েকটি অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সবচেয়ে ক্ষতিকর সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল গঠন করে ব্যবসায়ীদের বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা বাস্তবায়নসংক্রান্ত খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত। ইতিমধ্যেই এসব ঋণের সিংহভাগই ফোর্সড লোনে পরিণত হয়েছে। এর মানে এসব ঋণ আর কখনোই বৈদেশিক মুদ্রায় বাংলাদেশ ব্যাংকে ফেরত আসবে না। আরও দুঃখজনক হলো, এসব ঋণের বেশির ভাগ ‘খেলাপি ঋণে’ পরিণত হয়ে গেছে। এর মানে হলো এই বৈদেশিক মুদ্রায় প্রদত্ত রিজার্ভের বিরাট অংশটি পুরোপুরি লুণ্ঠিত হয়ে গেছে।
দেশের ‘গ্রস রিজার্ভ’ কমতে কমতে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ২৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে। আরও দুঃসংবাদ হলো দেশের ‘নিট রিজার্ভ’ এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের সামান্য বেশি। ‘নিট রিজার্ভ’ হলো প্রকৃত প্রস্তাবে দেশের আমদানিসক্ষমতার সঠিক মাপকাঠি! আইএমএফ তাদের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করার শর্ত দিয়েছে যে ২০২৩ সালের জুন মাসের শেষে দেশের নিট রিজার্ভকে ২৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হবে। আমরা এই লক্ষ্যমাত্রা থেকে চার বিলিয়ন ডলার পিছিয়ে আছি।
রিজার্ভের আসল হিসাব যে অনেক কম, তা উপলব্ধি করতে পারলে হয়তো এই অপ্রয়োজনীয় কর্মসূচি নেওয়া হতো না। প্রশংসা পাওয়ার জন্য শ্রীলঙ্কাকে বাংলাদেশ নিজেদের রিজার্ভ থেকে যে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিল, সেটাও পরিশোধের সময়সীমা বহু আগেই পার হয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কা ইতিমধ্যেই দুই-দুইবার ঋণ পরিশোধে তাদের অপারগতা জানিয়ে দিয়েছে। প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ করলে পায়রা বন্দরের চ্যানেলের খননকাজ এবং বাংলাদেশ বিমানের বিমান কেনার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সরকারের ঋণ দেওয়ার কোনো যুক্তি থাকার কথা নয়।
কিন্তু ২০২০ এবং ২০২১ সালের পত্রপত্রিকার খবরগুলো পড়লে বোঝা যাবে, ওই সময় সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ খামোখা এত বড় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখছে। যুক্তি দেওয়া হয়েছিল, মার্কিন রিজার্ভ–ব্যবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখলে সেখান থেকে অতি সামান্য সুদ পাওয়া যায়, তাই ওই রিজার্ভের অর্থ দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয় বিনিয়োগ করলে সুদও বেশি পাওয়া যাবে এবং উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের সক্ষমতাও বাড়বে সরকারের।
২০২০ সালে যখন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমেই বেড়ে ৩৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল, তখন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমি, এ ধারণা যে অযৌক্তিক, তা ব্যাখ্যা করে পত্র-পত্রিকায় কলাম লিখেছিলাম। কিন্তু কে শোনে ওসব কথা? ২০২০ সালের ১৬ জুলাই দৈনিক বণিক বার্তা ও দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত আমার কলাম থেকে নিচের উদ্ধৃতিগুলো তুলে ধরছি, ‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্ফীতির আসল গুরুত্ব হলো, এটি একটি দেশের অর্থনীতির গতিশীলতা ও শক্তির প্রতীক। কোনো দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যখন ক্রমবর্ধমান থাকে, তখন ওই অর্থনীতির নীতিপ্রণেতাদের কারও ব্ল্যাকমেলের তোয়াক্কা করতে হয় না। নীতি গ্রহণের এই সার্বভৌমত্বের মূল্য অপরিসীম, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য—যেকোনো দেশের অর্থনীতির দুর্বলতা এবং শক্তির “অ্যাসিড টেস্ট” হলো লেনদেন ভারসাম্যের কারেন্ট অ্যাকাউন্টের ঘাটতি বনাম উদ্বৃত্তের অবস্থান।
‘বাংলাদেশের দৃশ্যমান রপ্তানি ও আমদানির প্রবাহের “ব্যালেন্স অব ট্রেডে” এখনো প্রায় বছর পনেরো থেকে কুড়ি বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যখন থেকে আমরা প্রধানত ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স প্রবাহের সহায়তায় ওই ঘাটতি মেটাতে সক্ষম হচ্ছি, তখন থেকে বৈদেশিক ঋণ অনুদানের জন্য আমাদের আর বিদেশি রাষ্ট্র কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থার দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর অতিনির্ভরশীল হতে হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ কিংবা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এখনো “সফট লোন” পাওয়া গেলে আমরা নিতে আগ্রহী হই, কিন্তু আমাদের বৈদেশিক ঋণের সিংহভাগই এখন “সাপ্লায়ারস ক্রেডিট”।
‘সাপ্লায়ারস ক্রেডিটের অসুবিধা হলো, জোগানদাতারা প্রকল্পের প্ল্যান্ট, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ঋণ হিসেবে দেওয়ার সময় প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজারদামের চেয়ে অনেক বেশি দাম ধরে ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। উপরন্তু সাপ্লায়ারস ক্রেডিটের সুদের হারও সফট লোনের সুদের হারের চেয়ে বেশি, ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও কম থাকে। আরও গুরুতর হলো সাপ্লায়ারস ক্রেডিটে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার ব্যবসায়ী ও আমলাদের “মার্জিনের হার” অনেক বেশি হয়ে থাকে—এখন উন্নয়ন ব্যয় নিয়ে মাতামাতি করার কোনো প্রয়োজন আছে কি?’
আমার এই সাবধান বাণীকে আমলে না নেওয়ার ফলে এখন যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত পতনের ধারা আমাদের অর্থনীতিকে টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে, তা সামাল দিতে সরকারকে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। দুই বছরে দেশের ‘গ্রস রিজার্ভ’ কমে এখন ২৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। এই পতনের ধারাকে অত্যন্ত বিপজ্জনক বলতেই হবে। অর্থমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে এর দায়ভার নিতে হবে। তাঁরা যদি আইএমএফের নির্দেশনা অনুসরণ না করার বিপদ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে যথাসময়ে সাবধান করে দিতেন, তাহলে ‘কৃত্রিমভাবে ইনফ্লেটেড রিজার্ভ’ সম্পর্কে তাঁর মনে যে অতি আস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা হয়তো হতো না।
গত দুই বছরের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও সরকার এখনো রিজার্ভের পতনের ধারাকে থামাতে পারেনি। কঠোরভাবে আমদানি হ্রাস করেও রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। কারণ, আনুষ্ঠানিক পথে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স গত দুই বছরে তেমন বাড়ানো যায়নি। দেশের অনুমিত দেড় কোটি মানুষ বিদেশে কর্মরত থাকলেও তাঁদের অধিকাংশ হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন।
দেশের ‘গ্রস রিজার্ভ’ কমতে কমতে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ২৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে। আরও দুঃসংবাদ হলো দেশের ‘নিট রিজার্ভ’ এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের সামান্য বেশি। ‘নিট রিজার্ভ’ হলো প্রকৃত প্রস্তাবে দেশের আমদানিসক্ষমতার সঠিক মাপকাঠি! আইএমএফ তাদের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করার শর্ত দিয়েছে যে ২০২৩ সালের জুন মাসের শেষে দেশের নিট রিজার্ভকে ২৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হবে। আমরা এই লক্ষ্যমাত্রা থেকে চার বিলিয়ন ডলার পিছিয়ে আছি।
● ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক