রাজা হিসেবে তৃতীয় চার্লসের অভিষেক হলো। চার্লসের পুরো জীবন কেটেছে তাঁর মা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছায়ায়। কীভাবে রাজ্য পরিচালনা করতে হবে, প্রতিনিয়ত সেই আদব-কায়দার শিক্ষা তাঁকে দেওয়া হয়েছে। তিনি ভালো করেই জানেন, দেশবাসী তাঁর মাকে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের একজন মহিমান্বিত রানি বলেই বিবেচনা করতেন।
অনেকে মনে করেন, রাজকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে চার্লস ও এলিজাবেথের মধ্যে সাদৃশ্য থাকাটাই ভালো। এর কারণ খুব সোজা। আজকের দিনে রাজ্য পরিচালনা একেবারে ছকবাঁধা। সত্যি বলতে রাজকার্যের আনুষ্ঠানিকতা পালন আর রোবটের কাজের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। চার্লস হয়তো তাঁর ওপর অর্পিত আনুষ্ঠানিকতা খুব নিখুঁতভাবে সম্পাদন করে যাবেন।
তাঁর মা এসব রীতি পালনের ক্ষেত্রে একটা কৌতুককর মেজাজ রপ্ত করে নিয়েছিলেন। অভিজ্ঞতার কারণে চার্লসের পা ফসকানোর ঝুঁকি কম। কিন্তু এরপরও মা ও ছেলের ব্যক্তিত্বের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
সংবিধানের সীমানার মধ্যে এই পার্থক্যটা একটা ক্ষেত্রে বড় বিষয় হয়ে উঠতে পারে। ব্রিটিশ সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী ও আইনসভার কার্যাবলি পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজার সাংবিধানিক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। রেওয়াজ অনুযায়ী রাজপ্রাসাদকে নির্দলীয় অবস্থান বজায় রাখতে হয়। এ অবস্থানের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বাধ্যবাধকতা থাকবে রাজা চার্লসেরও। সাংবিধানিক এই বাধ্যবাধকতা সংকট ডেকে আনতে পারে। এ ধরনের সংকট শেষবার দেখা দিয়েছিল ১৯৬৩ সালে। কনজারভেটিভ পার্টির হ্যারল্ড ম্যাকমিলান পদত্যাগ করায় একটা সাংবিধানিক জটিলতা তৈরি হয়েছিল। রাজনৈতিক বিতর্ক থেকে রক্ষা পাননি রানি এলিজাবেথ।
রানি এলিজাবেথের সময়ে রাজতন্ত্র ঘিরে যে ছদ্ম আড়ম্বরের দেয়াল উঠেছে, সেটা কি ভেঙে ফেলতে পারবেন রাজা চার্লস? সিংহাসনে একজন উত্তরাধিকার বসার প্রয়োজন আছে। কিন্তু পুরো পরিবারকে রাজতন্ত্র উপভোগ কিংবা সেটার নিয়মকানুন সহ্য করার প্রয়োজন কি আছে?
এরপর ১৯৭৪ সালে এডওয়ার্ড হিথ এবং ২০১০ সালে গর্ডন ব্রাউনের সময়ে ঝুলন্ত আইনসভার কারণে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। দুটি ক্ষেত্রেই প্রথা ও রেওয়াজ অনুযায়ী রাজপ্রাসাদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান এসেছিল। ২০১৯ সালে ভিন্ন আরেকটি সংকট সৃষ্টি হয়েছিল।
বরিস জনসন অবৈধভাবে আইনসভা মুলতবি করতে রাজপ্রাসাদকে যুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে বরিসের এই প্রচেষ্টা সুপ্রিম কোর্ট নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। সব কটি ঘটনার ক্ষেত্রে প্রচলিত রীতিনীতি রাজপ্রাসাদকে বিতর্ক থেকে রক্ষা করেছিল। কিন্তু চার্লস সেই রেওয়াজ ভঙ্গ করে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে চাইতে পারেন।
ভিন্ন আরেকটি বিষয় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। চার্লস একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব এবং প্রায় সব বিষয়েই তিনি শক্তভাবেই তাঁর মতামত দেন। জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষি, সনাতনী চিকিৎসা, বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার এবং আধুনিক স্থাপত্য—এসব বিষয়ে কোনো রাখঢাক না করেই নিজের অবস্থান ব্যক্ত করেন। তিনি সব সময় বলে এসেছেন, এসব মতামত তাঁর ব্যক্তিগত, রাজপ্রাসাদের নয়। কিন্তু সেগুলো তো মতামতই।
রাজতন্ত্রের যে ভাবমূর্তি দাঁড়িয়ে গেছে, সেটা সংস্কারের ক্ষেত্রে নতুন রাজার ভূমিকা কী হতে পারে? রানি এলিজাবেথ ঐতিহ্য রক্ষার প্রতি চরম নিয়মনিষ্ঠ ছিলেন, চার্লস সেখানে সেই ঐতিহ্য শিথিল ও প্রথামুক্ত করতে পারেন। গুঞ্জন আছে, চার্লস বার্মিংহাম প্রাসাদ ছেড়ে দিতে পারেন এবং সেটিকে রাজকীয় কর্মসম্পাদনের কার্যালয় ও জাদুঘরে রূপান্তর করবেন।
রানি এলিজাবেথের সময়ে রাজতন্ত্র ঘিরে যে ছদ্ম আড়ম্বরের দেয়াল উঠেছে, সেটা কি ভেঙে ফেলতে পারবেন রাজা চার্লস? সিংহাসনে একজন উত্তরাধিকার বসার প্রয়োজন আছে। কিন্তু পুরো পরিবারকে রাজতন্ত্র উপভোগ কিংবা সেটার নিয়মকানুন সহ্য করার প্রয়োজন কি আছে?
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
সাইমন জেনকিন্স দ্য গার্ডিয়ান–এর কলাম লেখক