নোবেলজয়ীদের ‘বিচারের’ উদাহরণ কেন তোলা হচ্ছে

মারিয়া রেসা ও এলেস বিলিয়াতস্কি

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচারাধীন মামলা নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা আলোচনা চলছে। নোবেল লরিয়েট, মানবাধিকারকর্মী, বিশ্বনেতারা ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি দিচ্ছেন। তো তাঁর বিচারের আলোচনা প্রসঙ্গে ফিলিপাইনের নোবেল বিজয়ী মারিয়া রেসার প্রসঙ্গও উচ্চারিত হচ্ছে এখানে।

মারিয়া রেসার বিরুদ্ধেও কর ফাঁকি দেওয়ার মামলা হয়েছে, দিনের পর দিন তাঁকে সেই মামলা নিয়েই চলতে হয়েছে। এ রকম বহু নোবেল লরিয়েট আছেন, যাঁরা কারাগারে বন্দীও আছেন পরবর্তী সময়ে অনেক কাজের জন্য।

একটা কথা স্পষ্টভাবে বলে রাখা ভালো যে, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী (এমনকি শান্তিতে নোবেল) অপরাধ করতে পারেন না এবং তাঁর বিচার হতে পারে না—এমন কোনো অবস্থান থেকে এই লেখা নয়। বরং এমন একটা উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের কাছে প্রত্যাশিত, যেখানে একজন মানুষের কোনো রকম পরিচয় বিবেচনা না করে ন্যায্যতার সঙ্গে তাঁর ওপর আইন প্রযুক্ত হবে এবং অপরাধী সাব্যস্ত হলে তিনি শাস্তি পাবেন।

কিন্তু একটি কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিচারের নামে কী হতে পারে, সেটুকু বোঝা যায় বলেই ড. ইউনূসকে নিয়ে বাংলাদেশ তো বটেই, বৈশ্বিক উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। যা-ই হোক, ড. ইউনূসের বিচারের বিস্তারিত বলা এই কলামের উদ্দেশ্য নয়।

মারিয়া রেসা ছাড়াও বেলারুশের একজন নোবেলজয়ীর জেলে যাওয়ার কথাও এখানে আলোচনায় এসেছে। তিনি হলেন এলেস বিলিয়াতস্কি, ২০২২ সালে শান্তিতে নোবেলজয়ী। এ বছরের মার্চ মাসে এই ভদ্রলোককে আরও কয়েকজনের সঙ্গে আন্দোলনের লোকজনকে টাকা দেওয়া এবং টাকা পাচারের অভিযোগে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি ‘ভিয়াসনা মানবাধিকার কেন্দ্র’ নামের একটি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানের প্রধান। দীর্ঘকাল থেকে তিনি বেলারুশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন।

ক্ষমতাসীন সরকার ও তার চিন্তাচেতনা লালন ও প্রচারকারীরা এ দুই নোবেলজয়ীর কথা সামনে আনছেন নোবেল বিজয়ীদের ওপরে বিচারের উদাহরণ হিসেবে। এগুলোকে খুবই দুর্বল ধরনের রাজনৈতিক রেটরিক হিসেবে উড়িয়ে দেওয়াই যায়। কিন্তু একটা টিভি টক শোতে যখন দেখলাম, আমার একজন সহ-আলোচক (যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক) ফিলিপাইন আর বেলারুশের নোবেল বিজয়ীর বিচার নিয়ে উদাহরণ দিচ্ছেন, তখন মনে হলো, বিষয়টিকে আর খুব হালকা রাজনৈতিক রেটরিক ভেবে এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না, এটা নিয়ে কিছু কথা বলা জরুরি।

ফিরে আসা যাক ফিলিপাইনের মারিয়া রেসার কথায়। রেসা একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক। একসময় তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা সিএনএনের হয়ে কাজ করেছেন। পরে প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজের সংবাদ পোর্টাল ‘র‍্যাপলার’।

রেসা বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন ফিলিপাইনের সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের সময়। যাঁরা আন্তর্জাতিক বিষয়ের ন্যূনতম খবর রাখেন, তাঁরা জানেন, আর সব পরিচয় ছাপিয়ে তাঁর কর্তৃত্বপরায়ণতাই ছিল তাঁর বৈশ্বিক পরিচয়ের প্রধান কারণ। এমনকি প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগেও যখন তিনি দাভাও শহরের মেয়র ছিলেন, তখনো মাদক এবং অন্যান্য অপরাধ দমনে তাঁর বিরুদ্ধে নানা রকম মানবাধিকার পরিপন্থী পদক্ষেপের অভিযোগ ছিল। তবে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে তিনি অসংখ্য মাদক ব্যবসায়ী এবং মাদকাসক্তকে খুন করেছিলেন বিচারবহির্ভূতভাবে।

২০২২ সালের ২৪ জুন র‍্যাপলারের প্রতিবেদন জানায়, রদ্রিগো দুতার্তের সময় সরকারি হিসাবেই মাদকের অভিযোগে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। আর মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাবে এটা ২৭ থেকে ৩০ হাজার। আছে অত্যন্ত ভয়ংকর একটি বিষয়, ২০১৮ সালের জুন মাসে দুতার্তে প্রকাশ্যে তাঁর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন। তখন পৃথিবীর সব শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় তাঁর এই বক্তব্য শিরোনাম হয়েছিল। ‘মাই অনলি সিন ইস দ্য একস্ট্রা জুডিশিয়াল কিলিং’ বাক্যটি লিখে গুগল করলেই যে-কেউ দেখতে পাবেন, কেমন সাড়া ফেলেছিল তখন তাঁর এই উক্তিটি।

শুধু মাদকের সঙ্গে জড়িত লোকজন নয়, দুতার্তে তাঁর ছয় বছরের শাসনামলে মানবাধিকারকর্মী খুন করেছেন প্রায় সাড়ে চার শ, খুন হয়েছেন দেড় শর বেশি ভূমি এবং পরিবেশ অধিকারকর্মী এবং বিচারক, আইনজীবী ৭০ জনের মতো। শুধু সেটাই নয়, মানবাধিকারের অন্য সব দিক এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতারও চরম ক্ষতি করেছিলেন দুতার্তে।

দুতার্তের অপশাসনের বিরুদ্ধে শক্তভাবে দাঁড়িয়েছিলেন মারিয়া রেসা তাঁর নিউজ পোর্টাল র‍্যাপলার নিয়ে। এটাই তাঁর বিরুদ্ধে দুতার্তের ক্ষোভের কারণ। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম মামলা দেওয়া হয় এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালে দেওয়া হয়েছিল আয়কর ফাঁকির মামলা। মামলাটির কথাই আমাদের এখানে আলোচনায় এনেছেন ক্ষমতাসীনেরা।

ওদিকে বেলারুশের এলেস বিলিয়াতস্কি তাঁর শাস্তি পেয়েছেন এমন একজন শাসকের অধীনে, যাঁকে সাম্প্রতিক কালে আমরা চিনেছি রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের কারণে। তিনি আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কো। পুতিনের পাপেট এই ভদ্রলোক পরিচিত ইউরোপের শেষ স্বৈরশাসক হিসেবে, যে পরিচয়ে তাঁর ন্যূনতম কোনো আপত্তি নেই। সর্বশেষ ২০২০ সালের নির্বাচনেও ভয়ংকর রকম কারচুপি করে ক্ষমতায় থেকে গেলেন তিনি। লাখ লাখ মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, চাপে পড়া লুকাশেঙ্কো তখন তড়িঘড়ি করে যান রাশিয়া ভ্রমণে এবং ফেরেন ভ্লাদিমির পুতিনের আশীর্বাদ নিয়ে। পুতিনের সাহায্যে ক্ষমতায় টিকে যান তিনি।

মারিয়া রেসার মামলার কী হয়েছে, সেটা সরকারের লোকজন হয়তো জানে না, কিংবা জানলেও এড়িয়ে গেছেন। ফিলিপাইনের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এই বছরের জানুয়ারিতে আয়কর নিয়ে দায়ের হওয়া মিথ্যা মামলা থেকে মুক্তি পেয়েছেন মারিয়া রেসা। সরকারের লোকজনের উচিত ছিল, এই তথ্যটিও আমাদের সামনে হাজির করা।

দীর্ঘ ২৯ বছর ক্ষমতায় আছেন আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কো। দেশকে চরম স্বৈরাচারী দেশে পরিণত করেছেন তিনি এবং সর্বজনীন মানবাধিকার তো বটেই, সিভিল ও পলিটিক্যাল রাইটসের ছিটেফোঁটাও আর অবশিষ্ট নেই সেই দেশে। গণতন্ত্রের সূচক তৈরি করা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সূচকে দেশটির অবস্থান একেবারে তলানিতে। এলেস বালিয়াটস্কি এবং তাঁর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানটি লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামীদের লড়াইয়ের সময় তাঁদের পাশে থেকেছে। বিশেষ করে ২০২০-এর পরের ঘটনাপ্রবাহ তাঁকে লুকাশেঙ্কোর কাছে এক ভয়ংকর শত্রুতে পরিণত করেছে।

বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলটি বুঝতে পারে না, আলোচিত দুজন নোবেল বিজয়ীর ওপর ঘটা তথাকথিত বিচারিক প্রক্রিয়া সামনে এনে প্রকারান্তরে তারা নিজেদের সরকারকে ওই দুই স্বৈরাচারী সরকারের কাতারে ফেলে দিয়েছে। তারা বুঝতে পারছে না, ভবিষ্যতে স্বৈরাচারী সরকারগুলোর অত্যাচার এবং নিপীড়নের শিকার ওই দুই শান্তিতে নোবেলজয়ীর সঙ্গে আমাদের শান্তিতে নোবেলজয়ীর নামও একই সঙ্গে উচ্চারিত হবে।

ফিলিপাইন ও বেলারুশের দুই নোবেলজয়ীর তথাকথিত বিচারের প্রসঙ্গ দিয়ে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচারিক তৎপরতার যৌক্তিকতা দেওয়ার প্রচেষ্টাটি বর্তমান সরকারের এক চরম বোকামির স্বাক্ষর হয়ে থাকবে।

ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের আমরা যত সমালোচনাই করি না কেন, একটা ব্যাপারে তাঁর প্রশংসা করতেই হবে, সেটা হচ্ছে, যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থেকে যেতে চাননি তিনি।

ফিলিপাইনের সংবিধান অনুসারে, একজন প্রেসিডেন্ট একবার মাত্রই ছয় বছরের জন্য ক্ষমতায় থাকতে পারেন। কিন্তু তিনি তো চাইলে নানা কারসাজি করে সংবিধান পরিবর্তনের চেষ্টা করতে পারতেন। কিংবা পারতেন ভোট ডাকাতির মাধ্যমে তাঁর পরিবারের কাউকে ক্ষমতায় বসিয়ে যাওয়া। তাঁর কন্যা, সারা দুতার্তেও রাজনীতিবিদ, যিনি বর্তমানে ফিলিপাইনের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তাঁর বাবা তাঁকে গায়ের জোরে প্রেসিডেন্ট বানিয়ে যেতে চাননি। ফিলিপাইনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বংবং মার্কোস, যিনি সাবেক অতি বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোসের ছেলে।

মারিয়া রেসার মামলার কী হয়েছে, সেটা সরকারের লোকজন হয়তো জানে না, কিংবা জানলেও এড়িয়ে গেছেন। ফিলিপাইনের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এই বছরের জানুয়ারিতে আয়কর নিয়ে দায়ের হওয়া মিথ্যা মামলা থেকে মুক্তি পেয়েছেন মারিয়া রেসা। সরকারের লোকজনের উচিত ছিল, এই তথ্যটিও আমাদের সামনে হাজির করা।

ওদিকে এলেস বিলিয়াতস্কি এতটা সৌভাগ্যবান নন, তাঁর ভবিষ্যৎ অনেকটাই অনিশ্চিত, যেহেতু ক্ষমতায় আছেন লুকাশেঙ্কো এবং নিকট ভবিষ্যতে তাঁর পতনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

মারিয়া রেসা তাঁর ‘হাউ টু স্ট্যান্ড আপ টু আ ডিক্টেটর: দ্য ফাইট ফর আওয়ার ফিউচার’ বইটি লিখেছেন দুতার্তের মতো স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করার অভিজ্ঞতা নিয়ে। বইটি পড়লে বোঝা যায়, একজন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লড়াই কতটা কঠিন হতে পারে। সেই লড়াইয়ের জন্য কতটা ভুক্তভোগী হতে হয়।

  • জাহেদ উর রহমান লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক