যেসব স্কুল এসএসসিতে ছাত্রছাত্রীদের ভালো ফল চায়, তারা তাদের ছাত্রছাত্রীদের বোর্ডের পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার যোগ্য কি না, তা বাছাইয়ের জন্য টেস্ট এবং কোথাও কোথাও প্রি-টেস্ট নিয়ে থাকে। আমাদের স্কুলে সে রকমই ছিল। আমাদের আউয়াল কমিশন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নামক প্রি-টেস্টে একজন দাপুটে এমপির দাপটের কাছে চুপসে গিয়ে যে যাত্রা শুরু করেছে, তা থেকে কোনো শিক্ষা তারা নিয়েছে বলে মনে হয় না। প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র হলে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) যে কতটা বিপজ্জনক, তারও প্রমাণ মিলেছে সেখানে।। দুজন প্রার্থীর তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ওই নির্বাচনে ১০৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০১টি কেন্দ্রের ফলাফলে ৬২৯ ভোটে এগিয়ে থাকা প্রার্থী শেষ চারটি কেন্দ্রের ভোটে যে নাটকীয়তায় ৩৪৩ ভোটে হেরে গেছেন, তাতে ইভিএমের গ্রহণযোগ্যতা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে ভালোই উঠে এসেছে।
কিন্তু প্রি–টেস্টের মতো টেস্টেও নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন দলের চাপের মুখে আত্মসমর্পণ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএমে ভোট নেবে। এমনকি কমিশন সচিব অশোক কুমারের ভাষ্য অনুযায়ী, ইসির হাতে থাকা দেড় লাখ ইভিএম দিয়ে ৭০-৭৫টি আসনে ভোট নেওয়া সম্ভব হলেও তাঁরা বেশি আসনে ভোট করতে আরও ইভিএম কিনবেন। সে জন্য নতুন প্রকল্পও নেওয়া হবে।
ইসির বর্জনপীড়িত সংলাপে যেসব দল অংশ নিয়েছিল, তাদের বেশির ভাগ দলই ইভিএম নিয়ে সংশয় ও সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। এই পটভূমিতে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজেও সংলাপে বলেছিলেন, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিশ্বাস করছে না। তবে আওয়ামী লীগ সংলাপে এবং দলীয় সভায় খুব জোরের সঙ্গেই বলেছে, তারা আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই ইভিএমে ভোট চায়। ইভিএমবিষয়ক মতবিনিময় সভার পর দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘আমরা ৩০০ আসনেই ইভিএম চাই। মন থেকে চাই, চেতনা থেকে চাই।’ তিনি জানিয়েছিলেন তাঁরা কমিশনে বলেছেন, ‘আমাদের দলের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আমাদের পার্টির স্ট্যান্ড হচ্ছে—দিস ইজ লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার—আমরা ইভিএমপদ্ধতির পক্ষে, রাখঢাক করে কোনো লাভ নেই।’ ফাইনাল পরীক্ষা সংসদ নির্বাচনের আগে টেস্টেও কমিশন যে আওয়ামী লীগ ও সরকারের ইচ্ছাপূরণে উদ্যোগী হয়েছে, তাতে কি আর সন্দেহের অবকাশ থাকে?
সোমবার প্রকাশিত পর্যবেক্ষণে বলা হলো, ‘কমিশন এখনো স্থির কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি।’ তাঁরা জানালেন, ‘রাজনৈতিক সংলাপ ছাড়াও ইভিএম নিয়ে আরও যেসব কর্মশালা, মতবিনিময় ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে’ সেগুলোর মতামত ও ফলাফল পর্যালোচনা করে কমিশন ভিন্নভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে ও যথাসময়ে তা সবাইকে জানাবে। কী আশ্চর্য! ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই তাঁরা জানিয়ে দিলেন যে ইভিএম ব্যবহার করা হবে এবং আরও ইভিএম কেনার প্রকল্পের কথাও তাঁদের ভাবনায় স্থান করে নিয়েছে। একটি দল অ্যাপের মাধ্যমে ভোট নেওয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছে, সে প্রসঙ্গে কমিশন বলছে অ্যাপের মাধ্যমে ভোট নেওয়ার ‘বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগে রাজনৈতিক সমঝোতা/সিদ্ধান্ত প্রয়োজন’। তাঁদের এই যুক্তির আলোকে আমরা নিশ্চয়ই জানতে চাইতে পারি ইভিএমের বিষয়ে কবে, কোথায়, কাদের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে? অধিকাংশ দল ইভিএমে বিশ্বাস করছে না কথাটা তো সিইসিই বলেছেন। তাহলে কেন এমন একটি যন্ত্র চাপিয়ে দেওয়া হবে, যার ভোট পুনর্গণনা ও যাচাইয়ের সুযোগ নেই?
ইভিএমের সিদ্ধান্তটি ঘোষণার একদিন আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে আসা প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনার ভিত্তিতে কমিশন ১০টি পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে। নির্বাচনকালীন সরকার, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে আনা, নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন, রাজনৈতিক মামলা, ইসির ক্ষমতা প্রয়োগের মতো বিষয়গুলোয় কমিশন যেসব পর্যবেক্ষণ দিয়েছে, তাতেও তাঁদের পক্ষপাত বোঝা যায়। সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর বেশির ভাগই নির্বাচনকালীন সরকারে কোনো না কোনো ধরনের পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দিয়েছে। সংলাপে যে ২৮টি দল অংশ নিয়েছে, তার মধ্যে ১০টি দল নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ বা সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব করেছে, আর ১২টি দল নির্বাচনকালে সরকারের ক্ষমতা সীমিত করে কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলেছে। যারা কমিশনের ক্ষমতা বাড়াতে বলেছে, তারা নির্বাচনের সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে কমিশনের অধীনে ন্যস্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে। আর যেসব দল কমিশনের সংলাপ বর্জন করেছে, তারা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। কমিশন তার পর্যবেক্ষণে বলছে, নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, তা পুরোপুরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় এবং সাংবিধানিক বিষয়ে তাঁদের কিছু করণীয় নেই।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল শপথ নেওয়ার পর ‘আগামী নির্বাচনে আইনের মধ্যে থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার’ অঙ্গীকার করে বলেছিলেন, তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘সমঝোতা সৃষ্টির’ অনুরোধ করবেন। সুন্দরভাবে নির্বাচনটা করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চুক্তির কথাও তিনি বলেছেন। কিন্তু কমিশনের পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, তিনি ক্ষমতাসীন দলকে সরাসরি আলোচনার অনুরোধও জানাতে পারেননি।
কমিশনের প্রকাশিত পর্যবেক্ষণের বিষয়ক্রমে দ্বিতীয় স্থানে আছে ‘কারচুপির সুযোগ প্রতিরোধ করে সঠিক ও নিরপেক্ষ ফলাফল নিশ্চিত করা’র বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি বা সুপারিশ সম্পর্কে। কমিশন এ বিষয়ে বলছে, ‘সংবিধান, আইন ও বিধিবিধানের অধীনে প্রদত্ত ক্ষমতা যথাযথভাবে প্রয়োগ করে ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগে সৃষ্ট সব বাধা অপসারণ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রতিষ্ঠায় কমিশন উদ্যোগ নেবে। ওই একই পর্যবেক্ষণে কমিশন ‘রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতার মাধ্যমে কতিপয় মৌলিক প্রশ্নে মতৈক্যে’ পৌঁছানোর আহ্বান জানিয়েছে। তবে কতিপয় মৌলিক প্রশ্ন কী কী, তা তারা স্পষ্ট করে বলার দায়িত্ব নেয়নি, এড়িয়ে গেছে।
বিস্ময়ের বিষয় হলো, পর্যবেক্ষণ তালিকার ৮ নম্বরে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী ও সমর্থকদের বাধার কারণে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অবাধে সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং ও নির্বাচনী প্রচারণা করতে পারে না; তদুপরি নির্বাচন ঘনিয়ে এলে সরকারি দলের মদদে গায়েবি মামলা ও গণগ্রেপ্তার শুরু করা হয় বলে অভিযোগের বিষয়ে কমিশন বলছে, সাধারণ্যে এমন একটি ধারণা বিদ্যমান বলে তাঁরা মনে করেন। কিন্তু এরপরই কমিশন হাস্যকরভাবে বলছে, তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে চায়, সরকারি দল এ ধরনের আচরণবিধি ভঙ্গজনিত কাজ থেকে বিরত থাকবে। মনে হয়, নির্বাচন কমিশনে নিয়োগলাভের আগে তারা যেন মঙ্গলগ্রহে ছিল বলে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের এ ধরনের আচরণের ইতিহাসের কিছুই তাদের জানা নেই।
কমিশনের পুরো পর্যবেক্ষণ একটু মন দিয়ে পড়লেই বোঝা যায়, কমিশন কী ধরনের সুবিধাবাদী অবস্থান গ্রহণ করেছে, যার একটির সঙ্গে আরেকটির সামঞ্জস্য নেই। এমনকি তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী। সে জন্যেই তারা বলতে পারে, অ্যাপ ব্যবহার করা সম্ভব কি না, তার সম্ভাব্যতা পরীক্ষার আগে বিষয়টিতে রাজনৈতিক সমঝোতা লাগবে, কিন্তু ইভিএম নিয়ে মতানৈক্য প্রবল হলেও তা তারা ব্যবহার করবে। তারা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য সব দলকে মতৈক্যে পৌঁছানোর আহ্বান জানাতে বলতে পারে, কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে সংলাপের কথা বলতে পারে না। ভোটারদের স্বাধীনভাবে ও নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা বিধানের সাংবিধানিক দায়িত্বের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করলেও আউয়াল কমিশন ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসনের ওপর তাদের যে ‘বিশ্বাস’ তাকেই ভরসা মেনেছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল শপথ নেওয়ার পর ‘আগামী নির্বাচনে আইনের মধ্যে থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার’ অঙ্গীকার করে বলেছিলেন, তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘সমঝোতা সৃষ্টির’ অনুরোধ করবেন। সুন্দরভাবে নির্বাচনটা করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চুক্তির কথাও তিনি বলেছেন। কিন্তু কমিশনের পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, তিনি ক্ষমতাসীন দলকে সরাসরি আলোচনার অনুরোধও জানাতে পারেননি। বরং কমিশন কোনো দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করতে পারে না এবং সে ধরনের কোনো প্রয়াসও নেবে না বলে দায়িত্বটা সংলাপ বর্জনকারী দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। সব মিলিয়ে বলতেই হয়, ক্ষমতাসীন দল ও সরকারকে স্বস্তি দেওয়ার সব উপাদানই কমিশনের পর্যবেক্ষণে আছে। তাদের স্বস্তি দেওয়ার জন্য কমিশনের নিশ্চয়ই প্রভূত ধন্যবাদ প্রাপ্য।
কামাল আহমেদ সাংবাদিক