স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য স্মার্ট নির্বাচনের অপেক্ষায়

আজ ৩০ ডিসেম্বর। এক দিন পরই খ্রিষ্টীয় নতুন বছর শুরু হবে। ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি আলোচিত দিনও। ২০১৮ সালের এই দিনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল এবং তাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট প্রায় ৯৭ শতাংশ আসন লাভ করে। যদিও এই নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। বর্তমানে জাতীয় সংসদে যাঁরা বিরোধী দলের তকমা নিয়ে বসে আছেন, নির্বাচনে তাঁরাও ছিলেন ক্ষমতাসীনদের জোটসঙ্গী। বাংলাদেশে সবই সম্ভব।

ওই নির্বাচনে জাতীয় ফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট পায় মাত্র সাতটি আসন। এর মধ্যে বিএনপি পাঁচটি ও গণফোরাম দুটি। বিএনপির ওই পাঁচজন ও সংরক্ষিত আসনে দলের একজন নারী সংসদ সদস্য সম্প্রতি পদত্যাগ করলেও গণফোরামের দুজন সংসদে আছেন। তাঁরা বিভক্ত গণফোরামের কোন গ্রুপে, সেটা নিশ্চিত জানা না গেলেও একজনকে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে ‘অতিথি’ হিসেবে দেখা গেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় ফ্রন্টের ছায়াতলে আসা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের আবদুল কাদের সিদ্দিকীও সম্মেলনের আগের দিন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে খোশমেজাজে আছেন। তিনি বলেছেন, এটা একান্তই সৌজন্য সাক্ষাৎ।

আগামী নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে আরও অনেক সৌজন্য সাক্ষাতের ঘটনা ঘটবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতি কোন দিকে গড়ায়, কীভাবে, কার অধীনে ও কাকে কাকে নিয়ে ভোট হয়, সেসব প্রশ্নের উত্তর এখনই দেওয়া যাবে না। রাজনীতির নানা হিসাব-নিকাশে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দুই জোটেই ভাঙাগড়া চলছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ১৪-দলীয় জোট ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন ও ‘ষড়যন্ত্র’ মোকাবিলা করার কথা বলছে। যদিও আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তৃণমূলের অনেক নেতা নৌকা ভাড়া না দেওয়ার জন্য দলের নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, নৌকাই জয়ের চাবিকাঠি। তাঁদের এই ধারণা যে ভুল, রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেটা আবারও প্রমাণিত হলো। সেখানে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান রেকর্ডসংখ্যক ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। আর

নৌকা প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগের মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থীর যৌথ ভোটের কাছাকাছি পেয়েছেন ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী।

গাইবান্ধা উপনির্বাচন কিংবা রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ নেয়নি। অর্থাৎ খেলাটি অনেকটা একতরফা ছিল। এরপরও দুই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছে, তা দলের জন্য মোটেই সুখকর নয়। আওয়ামী লীগের নেতারা সারাক্ষণ বিরোধী দলের ‘ষড়যন্ত্র’ মোকাবিলায় ব্যস্ত থাকেন। তঁারা দল গোছাবেন কখন?

২০১৯ সালের শেষে বিশ্বব্যাপী যে করোনা মহামারি শুরু হয়েছিল, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে তা পুরোপুরি বিদায় না নিলেও প্রকোপ অনেকটা কমে যায়। আশা করা গিয়েছিল, অচিরেই মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু করতে পারবে। কিন্তু বছর শেষে দেখা গেল, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারতসহ বেশ কিছু দেশে নতুন করে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়েছে। আবার ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আরেক দুর্যোগের মুখোমুখি হয় বিশ্ব। ইউক্রেনে রাশিয়া হামলা চালানোর পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব যে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তার আঁচ এসে পড়ে বাংলাদেশের ওপরও। খাদ্য ও জ্বালানি তেলের দাম খুব বেড়ে যায়। অনেক দেশ এটি সামাল দিতে পারলেও আমদানিনির্ভর বাংলাদেশকে কঠিন বিপদে ফেলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের রাজনীতিকেরা সেটি আঁচ করতে পারছেন বলে মনে হয় না। তঁাদের নিত্যকার ঝগড়াবিবাদ দেখে জীবনানন্দ দাশের ‘অদ্ভুত আঁধার’ কবিতার কথাই মনে পড়ে।

‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,

যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;

যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই—প্রীতি নেই—

করুণার আলোড়ন নেই

পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,

এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়

মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা

শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।’

আমাদের রাজনীতিকদের কেউ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেন, কেউ রাষ্ট্রের মেরামত করার কথা বলেন, কিন্তু নিজেদের বদলাতে চান না। আমাদের স্বাধীনতার বয়স ৫১ বছর। এই সময়ে আমরা অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক উন্নতি করেছি, মানুষের গড় আয় ও আয়ু বেড়েছে। শিক্ষার হার বেড়েছে, স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বেড়েছে। নারীর ক্ষমতায়নও হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। মানুষ তার মেধা ও শ্রম দিয়ে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করে নিচ্ছে। গ্রামের যে মেয়েরা কখনো ঘরের বাইরে আসেননি, তঁারা তৈরি পোশাকশিল্পে কাজ করছেন। অনেকে বিদেশেও যাচ্ছেন। উচ্চশিক্ষা নিয়ে তরুণেরা চাকরির পেছনে না ঘুরে গ্রামে গিয়ে আধুনিক কৃষি খামার করছেন। দেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু এই রাষ্ট্রের ভাগ্য যাঁদের হাতে ন্যস্ত, যাঁরা ৫১ বছর ধরে আমাদের প্রিয় দেশটি পরিচালনা করে আসছেন, তাঁরা সাফল্য দেখাতে পারেননি। রাজনীতিতে সুস্থ ধারা প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি।

বাংলাদেশে অনেক কিছু বদলে গেছে। অ্যানালগ থেকে বাংলাদেশ ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে। এখন স্মার্ট বাংলাদেশের কথাও জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু রাজনীতিটা পড়ে আছে সেই সেকেলে অবস্থায়। আমাদের অতি বিজ্ঞ রাজনীতিকেরা একে অপরকে শত্রু মনে করেন। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে দেশ বিক্রির অভিযোগ তোলেন। তারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বলেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক উপায়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করে সবকিছু রাজপথে ফয়সালা করতে চান। রাজনীতির যুদ্ধটা হয় রাজায় রাজায়। মাঝখানে উলু খাগড়া জনগণের প্রাণ যায়।

এরই মধ্যে ডিসেম্বরের রাজনৈতিক যুদ্ধের সাফল্য–ব্যর্থতা নিয়ে দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে চলে এসেছে। ২৪ ডিসেম্বর যখন বিএনপি সারা দেশে গণমিছিলের কর্মসূচি নেয়, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সেটি প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কেননা ওই দিন ঢাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন ছিল। বিএনপি ঢাকায় তাদের কর্মসূচির তারিখ ঠিক করে ৩০ ডিসেম্বর। সে অনুযায়ী আজ তাদের কর্মসূচি পালিত হওয়ার কথা। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলে দিয়েছেন, ‘ঢাকায় বিএনপির গণমিছিলকে কেন্দ্র করে ১০ ডিসেম্বরের মতোই সতর্ক পাহারায় থাকবে আওয়ামী লীগ। ঢাকাসহ সারা দেশেই এই সতর্ক পাহারা বসানো হবে। তাঁর ভাষায়, ‘অগ্নিসন্ত্রাস করবে, ভাঙচুর করবে, সেখানে কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকব, ললিপপ খাব?’

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচন হয়। দিনটিকে বিএনপি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে। আওয়ামী লীগ পালন করে গণতন্ত্র রক্ষা দিবস হিসেবে। কিন্তু আমরা এমন একটা নির্বাচন কেন করতে পারছি না, যে নির্বাচনের পর সব দল মিলে গণতন্ত্র রক্ষা দিবস পালন করবে। বিএনপি গণমিছিলের জন্য ডিএমপির কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে, ডিএমপি অনুমতিও দিয়েছে। কোথায় কোথায় মিছিল করতে পারবে, সেটাও তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরও কেন আওয়ামী লীগকে পাহারা দিতে হবে? তাহলে কি সরকারের প্রতি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কোনো আস্থা নেই? প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি তাদের কেন এই অনাস্থা?

আমরা কি নতুন বছরে আশা করতে পারি, ২০২২ সালে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব ঘটনা ঘটেছে, মতপ্রকাশের জন্য যেভাবে মানুষ নিগৃহীত হতে হয়েছে, ২০২৩ সালে তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না? সরকারি বা বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়েও কোনো হানাহানি হবে না? যদি এই আশ্বাস তাঁরা না দিতে পারেন, তাহলে মনে করব, স্মার্ট বাংলাদেশ করা কিংবা রাষ্ট্র মেরামতের কোনো যোগ্যতাই তঁাদের নেই।

স্মার্ট দেশ করার আগে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে স্মার্ট হতে হবে। রাষ্ট্রের মেরামতের আগে রাজনীতিকদের নিজেদের মনোজগৎ মেরামত করা জরুরি। হতে হবে স্মার্ট নির্বাচন।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]