দেশে দিনে ক্যানসারে মৃত্যু ২৭৩ জন: চিকিৎসায় কেন পিছিয়ে আমরা
আজ ৪ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ক্যানসার দিবস। ইউনিয়ন ফর ইন্টারন্যাশনাল ক্যানসার কন্ট্রোল (ইউআইসিসি) আহ্বানে দুনিয়াব্যাপী এক যোগে দিবসটি পালিত হবে। এটি ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর এই দিনে পালিত হচ্ছে। ইউআইসিসি হলো ১৭০টি দেশের ১ হাজার ২০০ নেতৃস্থানীয় সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম। এর মধ্যে রয়েছে সব ক্যানসার সোসাইটি, সরকারের মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন রোগীদের গ্রুপ, প্রভাবশালী নীতিপ্রণেতারা, বোদ্ধা গবেষকেরা ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের রয়েছে বিশ্বব্যাপী ৫০টিরও বেশি কৌশলগত পার্টনার। এককথায় এই দুনিয়ায় ক্যানসারের সবচেয়ে বড় অভিভাবক।
বিশ্ব ক্যানসার দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য হলো ক্যানসারের সেবায় সবার সমতা (ক্লোজ দ্য গ্যাপ)। ছোট-বড়, নারী–পুরুষ, কালো–সাদা, বন্ধু–শত্রু, গ্রাম–শহর, উন্নত–অনুন্নত সবার জন্য ক্যানসারের সেবার (চিকিৎসা ও অন্যান্য) সমতা নিশ্চিত করা। এটা কেন প্রয়োজন? দেখা গেছে, আমেরিকায় জরায়ু মুখের ক্যানসারে পাঁচ বছর বাঁচে কৃষ্ণাঙ্গরা ৫৮ শতাংশ অথচ শ্বেতাঙ্গরা বাঁচে ৭১ শতাংশ। আবার ক্যানসার আক্রান্ত শিশুরা উন্নত দেশে বাঁচে ৮০ শতাংশ আবার উন্নয়নশীল দেশে বাঁচে মাত্র ২০ শতাংশ। অর্থাৎ, আপনি কে এবং আপনি কোথায়—সেটাই জীবন ও মৃত্যুর পার্থক্য নির্ধারক হিসেবে কাজ করছে। আর এ জন্যই সমতার খুব প্রয়োজন। এ সমতার জন্য প্রত্যেককেই যার যার অবস্থান থেকে অবদান রাখতে হবে।
ক্যানসারের ব্যাপকতা
ক্যানসার এমন একটা রোগ, যাতে প্রত্যেকেই আক্রান্ত হতে পারেন। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই মৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো ক্যানসার।
এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০২০ সালে প্রতি ছয়জনের মৃত্যুর মধ্যে একজনের মৃত্যু ক্যানসারের কারণে হয়েছে এবং বিশ্বে ক্যানসারে কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
প্রতি দুইজনে একজন তাদের জীবদ্দশায় ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং এতে পুরুষের সংখ্যা নারীদের দ্বিগুণ।
গত দশকে এ সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী এক দশকে এ সংখ্যা দেড় কোটিতে পৌঁছাবে, যার আনুমানিক দুই-তৃতীয়াংশ হবে উন্নয়নশীল দেশে।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। বাংলাদেশে ক্যানসারের ব্যাপকতা ঠিক কতটা, তার যথাযথ পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই। আনুমানিক ২০ লাখ ক্যানসার আক্রান্ত রোগী বাংলাদেশে রয়েছে। প্রতিবছর আনুমানিক ২ লাখ মানুষ ক্যানসার আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রতিবছর আনুমানিক ১ লাখ ক্যানসার আক্রান্ত রোগী মারা যাচ্ছেন। সে হিসেবে আমার দেশে প্রতিদিন এ মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে ২৭৩ জন মানুষ (ডেইলি স্টার, ১০ জানুয়ারি ২০২২)।
সরকারি ও বেসরকারি পরিষেবা: কষ্ট ও ভোগান্তি
ক্যানসারে আক্রান্তের কারণে মানুষের কী নিদারুন কষ্ট এবং তার চিকিৎসা নিতে গিয়ে মানুষের কী পরিমাণ ভোগান্তি, তা আমরা সবাই পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারি না। একমাত্র ভুক্তভোগীরাই তা কেবল উপলব্ধি করতে পারে।
দেশে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের যথাযথ চিকিৎসার সুযোগ খুবই অপ্রতুল। রোগাক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসাসেবা পাওয়া অনেকটা দুঃসাধ্য।
অধিকাংশ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এ রোগের চিকিৎসাসুবিধা অপ্রতুল। সরকারিতে খুবই চাপ এবং অত্যধিক ভিড়। প্রয়োজনীয় জনবল এবং অবকাঠামোর বিভিন্ন কারণে রোগীরা আসেন দেরিতে গভীরতর রোগ নিয়ে। চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের সারিয়ে তোলা অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
বেসরকারি হাসপাতালে একদিকে হাতে গোনা কয়েকটি হাসপাতালে মাত্র এ ধরনের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা হয়। খরচ অতিমাত্রায় বেশি।
অপারেশন পরবর্তী রেডিওথেরাপির অবস্থাও খুবই ভয়াবহ। রোগীর তুলনায় সেন্টারের সংখ্যা অনেক কম। রেডিওথেরাপি শুরু করতে অনেক দেরি হয়ই। এতে করে হয়তো রোগ আবার ফিরে আসে, নয়তো কেমোথেরাপির যন্ত্রণায় পড়ে।
অপর দিকে একটু সতর্ক থাকলে এ রোগ একেবারে প্রথমেই ধরা পড়ে। প্রাথমিক পর্যায়ের হেড-নেক ক্যানসারের চিকিৎসা খুবই সহজ। খরচ কম। ফলাফল অত্যন্ত ভালো। এসব কারণে দ্রুত তার চিকিৎসা নেওয়া দরকার।
আশার কথা
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চ অ্যান্ড হসপিটাল ৫০ শয্যা থেকে ধাপে ধাপে উন্নীত হতে হতে ৫০০–তে পৌঁছেছে। সরকারি উদ্যোগে দেশের আটটি বিভাগে বড় মাপের ক্যানসার হাসপাতাল নির্মাণের কাজ চলমান, যার শয্যাসংখ্যা হবে ১ হাজার ৪০০। কীভাবে এসব হাসপাতালের মাধ্যমে উপায়হীন রোগীদের আধুনিক সেবা নিশ্চিত করা যায়, তার জন্য আরও বেশি চিন্তা-চেষ্টা করতে হবে। কাজ করতে হবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামতকে ধারন করে।
বেসরকারিতেও উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন। নতুন সেন্টার হচ্ছে। রেডিওথেরাপি মেশিন বসছে, কিন্তু খরচ অনেক বেশি। তা সহনীয় মাত্রায় আনতে হবে। এগিয়েছি বটে, কিন্তু যেতে হবে আরও অনেক দূর।
প্রতিরোধে কী করণীয়
আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতিবছর বিশ্বে এক কোটির বেশি মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। প্রতি পাঁচজনের মধ্যে তিনজন প্রাথমিক উপসর্গগুলো উপেক্ষা করছেন, যা না করলে তাদের সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা ছিল। যতই চিকিৎসাসুবিধা থাকুক, ক্যানসার একবার হলে এর অনেক কষ্ট। এ জন্য প্রতিরোধই হলো সর্বোত্তম।
সাধারণ খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনুন। চর্বি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার কম খাবেন। ফলমূল ও সবজির পরিমাণ বাড়ান। ধূমপান সম্পূর্ণ ত্যাগ করুন। মদপান পরিহার করুন। মাত্রাতিরিক্ত পরিবেশ দূষণ পরিহার করুন। পান-তামাক বর্জন করুন। যৌনজীবন হতে হবে পরিশীলিত।
পরিপূর্ণ ক্যানসার রেজিস্ট্রি চালু করা সময়ের দাবি। নিয়মিতভাবে পরিবর্তনশীল চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষিত করতে হবে।
ক্যান্সারের উপসর্গের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। ভালো থাকুন।
ডা. মোহাম্মদ আবদুস সাত্তার অধ্যাপক, হেড-নেক সার্জারি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]