২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কি এ বছর থামবে?

ঝটিকা কিয়েভ সফরে এসে ভলোদিমির জেলেনস্কিকে আলিঙ্গন করছেন জো বাইডেনছবি : এএফপি

ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক সামরিক হামলার প্রায় এক বছর পূর্ণ হয়েছে। গোটা দেশে প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ এখনো চলছে। ইতিমধ্যে ইউক্রেনের হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষের প্রণহানি হয়েছে। উভয় পক্ষের লক্ষাধিক সেনা নিহত হয়েছেন। লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে উদ্বাস্তু ও শরণার্থীর জীবন কাটাচ্ছে। ইউক্রেনের অনেক শহর ও গ্রাম রকেট ও গোলার আঘাতে মাটিতে মিশে গেছে।

এই যুদ্ধ যখন দ্বিতীয় বছরে পা দিচ্ছে, তখন আমরা উভয় শিবিরকে নতুন করে আরও শক্তি নিয়ে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হতে দেখছি। উভয় শিবিরে হাজার হাজার নতুন সেনা নিয়োগ করা হচ্ছে এবং আরও উন্নত ও আধুনিক অস্ত্র লড়াইরত শিবিরে যুক্ত হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আসছে বছর গত বছরের চেয়ে বেশি বড় ও বেশি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হতে যাচ্ছে।

রাশিয়া ও ইউক্রেনের নেতারা জনসমক্ষে দেওয়া বাগাড়ম্বর ভাষণে যেসব কথা বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে, জয়ের বিষয়ে উভয় পক্ষই বেশ আত্মবিশ্বাসী। তবে তাঁদের বিজয়ের সংজ্ঞা ভিন্ন বলে ঠেকছে।

কিয়েভের সরকার পরিষ্কার করে বলেছে, ক্রিমিয়া উপদ্বীপসহ ইউক্রেনের যেসব এলাকা রাশিয়া এ পর্যন্ত দখল করেছে, তার সব কটি দখলমুক্ত করাই তাদের লক্ষ্য। গত নভেম্বরে চেক প্রজাতন্ত্রের একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছিলেন, ইউক্রেনের সেনাবাহিনী চূড়ান্ত জয় পাওয়ার পর তিনি ক্রিমিয়াতে অবকাশ কাটাতে যাবেন। তাঁর কয়েকজন কর্মকর্তা আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, তাঁদের লক্ষ্য হলো, রাশিয়ান ফেডারেশনকে ভেঙে টুকরা টুকরা করে ফেলা এবং সেটিকেই তাঁরা চূড়ান্ত জয় বলে মনে করেন।

এই যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সামাজিক স্তরের প্রত্যাশার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে এবং সেই সামাজিক প্রত্যাশার ব্যবধানটি বেশ গুরুত্ব বহন করে। রাশিয়ার সমাজ পুতিনের সামরিক অভিযান ও সীমানা বিস্তারের চেষ্টাকে বেশ উষ্ণভাবেই গ্রহণ করেছে। তবে অধিকসংখ্যক লোকক্ষয় ও অর্থক্ষয় এড়িয়ে রাশিয়া সমঝোতায় গেলও তারা সেটিকে ইতিবাচকভাবে দেখবে।

এ মাসের শুরুতে ইউক্রেনের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান ওলেক্সি দানিলভ ইউক্রনের সংবাদপত্র ইউরেইনস্কা প্রাভদাতে একটি কলামে লিখেছেন, রাশিয়াকে ‘উপনিবেশমুক্ত’ করতে হবে এবং রাশিয়ার অভ্যন্তরে যেসব স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী পুতিনবিরোধিতায় সক্রিয় রয়েছে, তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে হবে।

ইউক্রেনের সেনারা ইতিমধ্যে যদিও রাশিয়ার বাহিনীর দখল করা কিছু এলাকা পুনর্দখল করতে সক্ষম হয়েছেন, কিন্তু গত ১২ মাসে রুশ সেনারা ইউক্রেনের যে বিশাল এলাকা ছিনিয়ে নিয়েছে, তার বেশির ভাগ অংশ এখনো রুশ সেনাদের কবজাতেই রয়ে গেছে। এখন তাঁদের মোকাবিলা করতে ইউক্রেন সারা দেশে সেনা সংগ্রহের কার্যক্রম চালাচ্ছে; নতুন নতুন সেনা নিয়োগ করা হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে তারা আধুনিক অস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ সহায়তা পাচ্ছে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন প্রাথমিকভাবে ইউক্রনের দনবাস এলাকাকে ‘মুক্ত করা’ এবং ইউক্রেনকে ‘নাৎসিমুক্ত’ এবং ‘সামরিকীকরণমুক্ত’ করাকে তাঁর লক্ষ্য বলে উল্লেখ করেছিলেন।

রাশিয়ার সেনাবাহিনী এখন পর্যন্ত দনবাসের দুটি এলাকা দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের পূর্ণ দখল নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে দক্ষিণ ইউক্রেনের জাপোরিয়াহ ও খেরসন প্রদেশের বিশাল বিশাল এলাকা তারা দখল করে নিয়েছে, যার ফলে ক্রিমিয়ার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী স্থলভাগের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার হাতে রয়েছে। অক্টোবরে পুতিন ওই দুই অঞ্চলকে রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত করার একটি বিলে সই করেছেন।

গত বছরের শেষ ভাগে রাশিয়ার কর্তৃপক্ষ দেশজুড়ে নতুন সেনা সংগ্রহের অভিযান চালিয়ে আরও তিন লাখ সেনাকে নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করেছে। তাদের একটি অংশকে ইতিমধ্যেই সম্মুখসমরে পাঠানো হয়েছে এবং বাকিরা রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে ব্যারাকে রয়েছেন।

জয়–পরাজয়ের এই মিশ্র পরিস্থিতিতে ইউক্রেনে তাদের ‘বিজয়’–এর সংজ্ঞাকে ইচ্ছা করেই একটি ধোঁয়াশাপূর্ণ জায়গায় রেখে দিয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়া পশ্চিমা দেশগুলোও যুদ্ধ কোন উপায়ে শেষ হবে, সে বিষয়ে দ্যর্থক অবস্থানে রয়েছে।

আরও পড়ুন

ওয়াশিংটনের আনুষ্ঠানিক ভাষ্যমতে, রাশিয়ায় ইউক্রেনের পূর্ণ বিজয় না হওয়া পর্যন্ত তারা ইউক্রনের সরকারকে ‘যত দিন সময় লাগবে, তত দিন’ সমর্থন দিয়ে যাবে। তবে ইউরোপের কেউ কেউ এখন সাবধানতার সঙ্গে মন্তব্য করছেন। যেমন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, রাশিয়াকে পরাজিত করা উচিত হবে, ভাঙা উচিত হবে না।

ইউক্রেন এ পর্যন্ত পশ্চিমের কাছ থেকে প্রায় চার হাজার কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা পেয়েছে, যার মধ্যে তিন হাজার কোটি ডলার একাই দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জানুয়ারি মাসে জার্মান এবং মার্কিন ট্যাংক ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে সরবরাহের মাধ্যমে ন্যাটো দেশগুলো তাদের স্বঘোষিত ‘লাল ফিতা’ টানা সীমানা অতিক্রম করেছে।
সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টের একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, ইউক্রেন সরকারের জন্য এটি হুঁশিয়ারির বিষয় যে পশ্চিমা সহায়তায় সজ্জিত ইউক্রেনের সামনে এখন কোনো ধরনের শান্তি আলোচনায় বসার আগেই সমরদৃশ্যপট বদলে ফেলার শেষ সুযোগ। এই সুযোগ যদি তারা কাজে না লাগাতে পারে, তাহলে যুদ্ধ আরও দীর্ঘ হবে।

ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স সম্প্রতি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নীতিনির্ধারকদের ওপর সম্প্রতি একটি জরিপ চালিয়ে বলেছে, ইউরোপের নেতাদের মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতির বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। জরিপে দেখা গেছে, গুটিকয় নেতা মনে করেন, এই যুদ্ধের ফল হিসেবে কিয়েভ ‘পূর্ণ মুক্তি’ পাবে। তবে বেশির ভাগের মত হলো, যুদ্ধ শেষ হলেও ইউক্রেনের একটা অংশ রাশিয়ার হাতে থেকেই যাবে।

ইউক্রেন এই যুদ্ধে জিতে গেলে কিয়েভ অবরুদ্ধা অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে এবং ন্যায়বিচারের জয় হবে ঠিকই; কিন্তু এর অর্থ দাঁড়াবে, পুতিনের পরাজয় ও চূড়ান্ত অপমান। বিশেষ করে ক্রিমিয়া রাশিয়ার হাতছাড়া হয়ে গেলে পুতিন প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হতে পারেন এবং সেটি তাঁকে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগ করতে প্ররোচিত করতে পারে। তখন মানবতার ভাগ্য এমন এক বিকারগ্রস্ত লোকের হাতে পড়ে যেতে পারে, যিনি ইতিমধ্যেই অচিন্তনীয় খামখেয়ালিপূর্ণ যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে গোটা ইউরোপকে অস্থির করে তুলেছেন।

অন্যদিকে রাশিয়া যদি জয়লাভ করে, তাহলে সেটি হবে পশ্চিমের পরাজয়। তবে রাশিয়ার সে ধরনের জয় পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

রাশিয়া ইউক্রেনের কিছু অঞ্চল দখলে নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, তবে তারা কতটুকু নিতে পারবে বা দখল করা জায়গায় কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবে, তা শুধু সময়ই বলতে পারে।

এই যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সামাজিক স্তরের প্রত্যাশার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে এবং সেই সামাজিক প্রত্যাশার ব্যবধানটি বেশ গুরুত্ব বহন করে।
রাশিয়ার সমাজ পুতিনের সামরিক অভিযান ও সীমানা বিস্তারের চেষ্টাকে বেশ উষ্ণভাবেই গ্রহণ করেছে। তবে অধিকসংখ্যক লোকক্ষয় ও অর্থক্ষয় এড়িয়ে রাশিয়া সমঝোতায় গেলও তারা সেটিকে ইতিবাচকভাবে দেখবে।

আরও পড়ুন

অন্যদিকে, ইউক্রেনীয়দের প্রত্যাশা এখন অতি স্ফীত অবস্থায় আছে। অপমানজনক সমঝোতা চুক্তির প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে এবং পুতিনের আল্টিমেটামের তোয়াক্কা না করে জীবন বাজি রেখে লড়াই করার পর প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি কোনো ধরনের আপস করতে গেলে তাঁর সরকার হুমকিতে পড়ে যাবে।

এই মুহূর্তে যেকোনো ধরনের আয়োজিত আপস–মীমাংসায় বসতে যাওয়া ইউক্রেনের জন্য মিনস্ক চুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখান করার চেয়ে খারাপ হবে এবং এটি এই প্রশ্ন তুলবে যে তাহলে এত ত্যাগ–তিতিক্ষার অর্থ কী দাঁড়াল? ঠিক এই কারণেই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য জেলেনস্কিকে জোরালো আনুষঙ্গিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

এ কারণে চলতি বছরের সামনের সময়টা ইউক্রেনের জন্য বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে অনূদিত
লিওনিদ রাগোজিন রিগাভিত্তিক একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক