কয়েক দিন ধরেই একটি সংবাদ ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় চোখে পড়ছে। এইচএসসি পরীক্ষা পেছানোসহ চার দফা দাবিতে কিছু শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমেছে। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হলো: ৫০ নম্বরে পরীক্ষা গ্রহণ করা, পরীক্ষা কমপক্ষে দুই মাস পিছিয়ে দেওয়া, ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে পরীক্ষা স্থগিত করা এবং আইসিটি পরীক্ষা বাদ দেওয়া।
এই আন্দোলনের বিপরীতে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, ‘দেশের ১৪ লাখ এইচএসসি পরীক্ষার্থী তাদের প্রস্তুতি শেষ করেছে শুধু নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য। তাই যথাসময়ে এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।’ (প্রথম আলো, ১২ আগস্ট ২০২৩)
শিক্ষামন্ত্রীর অনেক সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হলেও এই সিদ্ধান্তকে আমি স্বাগত জানাই।
প্রথমত, পরীক্ষা কবে অনুষ্ঠিত হবে, সিলেবাস কী হবে, প্রশ্ন কেমন হবে, কত নম্বরে পরীক্ষা হবে—এগুলো নির্ধারণ করা ছাত্রদের দায়িত্ব নয়। ছাত্রদের দায়িত্ব পড়াশোনা করা।
২০২২ সালে যারা শিক্ষার্থী ছিল, তারা একটি ভয়াবহ মহামারি প্রত্যক্ষ করেছে। প্রতিমুহূর্তে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের জীবনের আশঙ্কা নিয়ে দিন যাপন করেছে। অনেকে ঘরে বন্দী থাকতে থাকতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। সুতরাং, তাদের ক্ষেত্রে পরীক্ষার ধরন মানবিক কারণে পরিবর্তন করা হয়েছিল। সেই পরিবর্তনে অনেকেই হয়তো পরীক্ষায় উতরে গেছে, শিখনঘাটতি রয়ে গেছে অনেক গুণ।
এইচএসসির সিলেবাস উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে অনেক সহায়ক ভূমিকা রাখে। এইচএসসির পাঠ ঠিকমতো আত্মস্থ না করলে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। কারণ, কোনো ভবনের ভিত্তি যদি মজবুত না হয়, তার ওপর বহুতল ভবন নির্মাণ করা নিরাপদ নয়। সামান্য দুর্যোগেই সেই ইমারত ধসে পড়ে। তেমনি পড়াশোনার ক্ষেত্রে আমাদের জীবনের প্রতিটি ধাপ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার ভিত্তি মজবুত হওয়া। সুতরাং সিলেবাস কমিয়ে ৫০ নম্বরে পরীক্ষা নেওয়া কোনো বিশেষ দুর্যোগের সময় গ্রহণযোগ্য হলেও স্বাভাবিক সময়ে গ্রহণযোগ্য নয়।
ছাত্রদের এই আন্দোলন একেবারে উপেক্ষা করা যায় না। পত্রপত্রিকা পড়ে যত দূর জেনেছি, তাদের এই আন্দোলন ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। আমার কাছে মনে হয় আজকের দিনে ডেঙ্গু মহামারির চেয়েও ভয়াবহ মহামারি হলো শিক্ষার্থীদের অনলাইনে আসক্তি। মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে প্রায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতে আছে স্মার্টফোন, আছে সোশ্যাল মিডিয়ায় আইডি। ফলে সামাজিক যোগাযোগের নাম করে, স্মার্ট প্রজন্ম গড়ার নামে আমরা একটা প্রজন্মকে হারাতে যাচ্ছি।
দ্বিতীয়ত, প্রতিটি বিষয়ের কিছু অলিখিত বা লিখিত নিয়ম আছে। দেশ, সমাজ, পরিবার, কিংবা প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবেও আমাদের কিছু কর্তব্য আছে। জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের মতে, আমাদের কর্তব্য দুই প্রকার। আবশ্যিক কর্তব্য এবং আপেক্ষিক কর্তব্য। আমরা আমাদের আবশ্যিক কর্তব্যকে কখনো অগ্রাহ্য করতে পারি না, অস্বীকার করতে পারি না। আবশ্যিক কর্তব্য আমরা কেবল কর্তব্যের খাতিরে করে থাকি। এর পেছনে লাভ–লোকসানের হিসাব অর্থাৎ ফলাফল কী হবে, সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। অন্যদিকে আপেক্ষিক কর্তব্য ব্যক্তি চাইলেই অগ্রাহ্য করতে পারে, অস্বীকার করতে পারে।
যেমন কোনো ব্যক্তি যদি কোনো ক্লাবের সদস্য হন, তবে তাঁকে সেই ক্লাবের সব নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। সেই ক্লাবের সব সিদ্ধান্তে তার সম্মতি থাকুক বা না থাকুক, সেই সিদ্ধান্ত ক্লাবের সদস্য হিসেবে মেনে চলা তাঁর জন্য কর্তব্য। তবে এই কর্তব্য তাঁর জন্য আপেক্ষিক। কারণ, ক্লাবের সদস্যপদ ধরে রাখার জন্য এটা জরুরি। তবে সে চাইলে যেকোনো সময় সদস্যপদ প্রত্যাখ্যান করতে পারে। অন্যদিকে, কারও জীবন বাঁচানো, সত্য কথা বলা আমাদের জন্য আবশ্যিক কর্তব্য। ফলাফল যা–ই হোক না কেন, কোর্টে গিয়ে সত্য সাক্ষ্য দেওয়া আমাদের আবশ্যিক কর্তব্য।
আমার কাছে মনে হয়, একজন শিক্ষার্থী যতক্ষণ পর্যন্ত সে শিক্ষার্থী, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব নিয়ম, শিক্ষা বোর্ডের নিয়ম মেনে চলাও তার জন্য কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা তাদের জন্য আপেক্ষিক এবং আবশ্যিক কর্তব্য উভয়ই। এটি আপেক্ষিক কর্তব্য এই কারণে যে কোনো ছাত্র চাইলে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না–ও করতে পারে, পরের বছর পরীক্ষা দিতে পারে। অন্যদিকে, এটি আবশ্যিক কর্তব্য এই অর্থে যে পরীক্ষায় বিশৃঙ্খলা তৈরি না করা তার কর্তব্য। যখন পরীক্ষা অনুষ্ঠানের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন, ঠিক সেই সময়ে রাস্তায় নেমে পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন অন্য শিক্ষার্থীদের জন্য অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে, মানসিক দুশ্চিন্তায় তাদের প্রস্তুতির অসুবিধা হয়েছে। পরীক্ষা পেছালে অনেকেই প্রস্তুতি ধরে রাখতে পারবে না। সুতরাং, নিজের সুবিধার জন্য অন্যের অসুবিধা না করা ব্যক্তিমাত্রেই আবশ্যিক কর্তব্য।
তৃতীয়ত, কোনো ডিগ্রি অর্জন কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে দুটি পক্ষ থাকে। এক পক্ষ প্রতিষ্ঠান এবং অন্য পক্ষ যারা শিক্ষা অর্জন করছে। এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় শিক্ষার্থীর জ্ঞানের মাত্রা যাচাই করার জন্য। কত নম্বরে পরীক্ষা নেওয়া হবে এটি যদি শিক্ষার্থীরা নির্ধারণ করে, তবে ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি একটি খারাপ উদাহরণ হিসেবে রয়ে যাবে। ভবিষ্যতেও শিক্ষার্থীরা এই ধরনের আন্দোলনে উৎসাহিত হবে। অতএব, কোনো অবস্থাতেই কতিপয় ছাত্রের জন্য সব শিক্ষার্থীর ক্ষতি করা বাঞ্ছনীয় নয়। বরং ছাত্রদের উচিত ঘরে ফিরে ভালো করে প্রস্তুতি নেওয়া।
তবে ছাত্রদের এই আন্দোলন একেবারে উপেক্ষা করা যায় না। পত্রপত্রিকা পড়ে যত দূর জেনেছি, তাদের এই আন্দোলন ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। আমার কাছে মনে হয় আজকের দিনে ডেঙ্গু মহামারির চেয়েও ভয়াবহ মহামারি হলো শিক্ষার্থীদের অনলাইনে আসক্তি। মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে প্রায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতে আছে স্মার্টফোন, আছে সোশ্যাল মিডিয়ায় আইডি। ফলে সামাজিক যোগাযোগের নাম করে, স্মার্ট প্রজন্ম গড়ার নামে আমরা একটা প্রজন্মকে হারাতে যাচ্ছি। অনলাইন আসক্তি শিক্ষার্থীদের পাঠবিমুখ করে তুলেছে। ফলে যত দ্রুত সম্ভব অভিভাবকদের উচিত নিজের সন্তানকে ডেঙ্গু জ্বর এবং অনলাইন আসক্তি উভয়সংকট থেকে সুরক্ষা দেওয়া।
প্রতিটি আসক্তির মতো অনলাইন আসক্তি থেকে সন্তানদের মুক্ত করতে হলে সরকারের উচিত একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা। ফেসবুক কিংবা ইনস্টাগ্রামে অপ্রাপ্তবয়স্ক কেউ যাতে আইডি খোলা এবং পরিচালনা করতে না পারে, সে বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিশেষ চুক্তির মাধ্যমে দেশে আইডি খোলার ক্ষেত্রে এনআইডি কার্ড বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এতে করে একদিকে ভুয়া আইডির সংখ্যা কমে আসবে, অন্যদিকে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরা এই ফেসবুক আসক্তির হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে।
এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন ভলান্টারি সমাজসেবামূলক কাজ বাধ্যতামূলক করতে পারে, এতে করে শিক্ষার্থীরা অবসর সময়ে গঠনমূলক কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে নিয়মিত বিরতিতে আয়োজন করতে হবে ইনডোর গেমের। প্রতিষ্ঠান এবং জাতীয় পর্যায়ে আয়োজন করা যেতে পারে বুক রিভিউ প্রতিযোগিতা। মোটকথা, শিক্ষার্থীকে অবসরের বিনোদন হিসেবে ফেসবুকের বিকল্প কোনো পজিটিভ উপকারী নেশায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সেটি হতে পারে বই পড়ার, সমাজসেবা কিংবা কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত থাকা।
নাসরীন সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও, কানাডা
ই-মেইল: [email protected]