হিংসা ও প্রতিহিংসার রাজনীতি: ‘নগর পুড়িলে’ দেবালয় এড়াবে না

শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিকেরা, বিশেষত ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অনেকে কর্মীদের প্রতিপক্ষের লোকজনের ‘হাত ভেঙে দেওয়ার’ মতো নির্দেশনাও দিচ্ছেন।
ছবি: প্রথম আলো

প্রতি সন্ধ্যায় ভিড়ের রাস্তায় এক-দেড় ঘণ্টা হাঁটাহাঁটি করি। একেক দিন একেক রাস্তায়। স্বাস্থ্যরক্ষায় যতটা-না হাঁটতে বের হই, তার চেয়ে বেশি বের হই ‘মানুষ পাঠের’ জন্য। রাস্তার পাশের তিন-চারটি টংদোকানে থামি। দুধ-চিনিছাড়া লিকার চা নিই। উদ্দেশ্য, সময় নিয়ে চা পানের অসিলায় সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে কান পেতে কথা শোনা।

সমসাময়িক সময় ও সমাজ বিষয়ে আমমানুষ কী ভাবছে, শুনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের চারণ-সমাজপাঠের একটি ব্যবহারিক চর্চাও করাই। তাতে ১০টি নম্বরের পাস-ফেলও থাকে। শিক্ষার্থীরা তাদের চারণ–সমাজপাঠ তুলে আনে। প্রয়াত চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দীন এই অনুপ্রেরণা বিলিয়ে গিয়েছিলেন। যাঁরা ক্ষমতার রাজনীতি করেন, তাঁদের একাংশ এ চর্চা শুরু করতে পারেন। কথাটি বলার কারণ, ক্ষমতার রাজনীতি চোখে ঠুলি পরিয়ে দেয়। চারপাশে শুধুই নিজেদের কর্মী-সমর্থক-চাটুকার দেখতে দেখতে রাজনীতিকেরা আমমানুষের ভাবগতিক নির্মোহভাবে দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।

ইদানীং রাজনীতিকদের মুখে শুনতে পাচ্ছি, ‘খেলা হবে’। এই কথায় প্রচ্ছন্ন হিংসা ও আক্রমণের দ্যোতনা আছে। এসব কথাকে মামুলি রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর হিসেবে ধরে নিয়ে হাল্কাভাবে নেওয়ার সুযোগ কম। ফুটপাতে হাঁটাহাঁটির সময় কান খাড়া করে পথচলতিদের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম, হুমকিমূলক বক্তব্য মানুষ পছন্দ করছে না।

কয়েক সপ্তাহ আগে ফেসুবকে কারও পোস্টে বা মন্তব্যের ঘরে এক অচেনা ভদ্রলোকের একটি লেখা পড়েছিলাম। সেখানে ভদ্রলোক লিখেছেন, তাঁরা বংশপরম্পরায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। তাঁর ছোট ভাইটি বয়সে তরুণ, মাত্র কলেজে ঢুকেছে এবং মাথাগরম। স্থানীয় নেতার যেকোনো কথা বা আদেশ-নির্দেশকে সে অবশ্যপালনীয় মনে করে। শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশ হলে তো কথাই নেই। নিজের জান দিয়ে হলেও সে সেই নির্দেশ পালন করবে।

আরও পড়ুন

ওই ভদ্রলোক লিখেছেন, কোনো দলই চিরদিন ক্ষমতায় থাকে না। বাংলাদেশের বাস্তবতায় ক্ষমতা থেকে যে দল সরে যায়, সেই দলের নেতা–কর্মীদের ওপর নতুন ক্ষমতা পাওয়া শক্তি অত্যাচার নির্যাতন চালায়। বড় নেতানেত্রীদের সাধারণত এই নির্যাতন খুব কমই ভোগ করতে হয়; কারণ ক্ষমতা হারানোর পর তাদের বিদেশে যাওয়ার সুব্যবস্থা করাই আছে। ভদ্রলোক লিখেছেন, তাঁর তিনটি সন্তান। তাদের বয়স কোলের শিশু থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে। তিনি সামান্য চাকরি করেন। তাঁকে দেশেই থাকতে হবে। কে কোন দল করেন, সে ভাবনা বাদ দিয়ে প্রতিবেশীদের নিয়েই তাঁকে শান্তিতে থাকতে হবে। কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় ভাইটি ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকার সুবাদে যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলে, তাহলে সময় পাল্টে যাওয়ার পর তাদের সবংশ ভয়াবহ প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার শিকার হতে হবে।

ভদ্রলোকের লেখাটি পড়ে মনে হলো, সেই মাথাগরম ছোট ভাইটির মতো নিশ্চয়ই আরও কয়েক লাখ মাথাগরম ‘ছোট ভাই’ আছে। শীর্ষ রাজনীতিকদের আদেশ অবশ্যপালনীয় ভেবে তাঁরা যদি ‘হাত ভাঙা’ ও ‘হাত পোড়ানোয়’ নামে, তাহলে দেশ কি সাধারণ মানুষের বসবাসযোগ্য থাকবে? ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?’

আরও পড়ুন

দুই.

আমজনতার ভাবনা-বিশ্লেষণ থেকে ক্ষমতাসীনেরা যে কত যোজন দূরে থাকেন, পথচারীদের আলাপ শুনে প্রায়ই বুঝতে পারি। দিনকয়েক আগে জাতীয় পার্টির সভানেত্রী বিদেশ থেকে ফিরলেন। সে সময় এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল। তাঁকে অভিনন্দন জানানোর জন্য ফুল-ডালা-মালা হাতে একদল লোক রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। সেদিন সেই এলাকাতেই জ্যামে আটকে থেকে একজন সিএনজি ড্রাইভারের ভাষ্য শোনার সুযোগ হয়েছিল। বিরক্তি কাটাতে রাস্তার পাশের টংঘরে চা পান করতে নেমে সাধারণ পথচারীদের টীকা-টিপ্পনীও শুনলাম। একজন পথচারীকেও দেখলাম না যিনি বিশ্বাস করছেন, স্বাগত জানাতে আসা লোকগুলো জাতীয় পার্টির সদস্য।

তাঁদের অভিমত, অনুমান বা বিশ্বাস-সরকারি সহায়তায় এই আয়োজন করা হয়েছে। কারণ, সরকারের সবচেয়ে বড় তুরুপের তাস এই ‘সরকারবিরোধী দল’। তাকে খাইয়েদাইয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এখন যত বড় করা যাবে, ক্ষমতাসীনদের ততই লাভ। আরও ছোটখাটো নতুন দল এবং পুরোনো সহযোগীদের সঙ্গে সংসদের দু-চারটি আসন ভাগাভাগি হবে। সেই ছক-কষাকষি হবে পর্দার আড়ালে, গোপনে। আরেকটি ‘পাতানো’ নির্বাচন হলে বিদেশি পর্যবেক্ষক বা দুনিয়াবাসীকে ছবি তুলে দেখানো দরকার হবে জনপ্রিয় বিরোধী দলটিকে নিয়েই নির্বাচন হয়েছে।

ক্যামেরাসহ মিডিয়াকর্মীদের দৌড়ঝাঁপ দেখে সিএনজি ড্রাইভার মন্তব্য করলেন, ‘সাম্বাদিকগোও ট্যাকা খাওয়াইছে। নাইলে জ্যামে মাইনসের যে কষ্ট অইতাছে, তা না দ্যাখায়া ফালতু জিনিস টিভিতে দেখায় কেমনে?’ তিনি বলছিলেন, ‘তেইল্যাচোরাও একটা পাখি, আর এইটাও একটা বিরোধী দল!’ জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘ভাই, আপনারা কি আর কাউকেই বিশ্বাস করেন না?’ তাঁর উত্তর ছিল, ‘না! আমরা সব বুঝি। তবে কিছু করতে পারি না।’ তাঁর উপলব্ধি, আসন জোটানোর জন্যও সরকারকে কোনোই কসরত করতে হবে না। আগের দুটি নির্বাচনের মতো আরেকটি ভোটারবিহীন আত্মসাৎযজ্ঞ চালানোর জন্য রাজনীতিক কেনাবেচা চলবে। তারপর দেখানো হবে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণেই সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে।

ক্ষমতাসীন দল যদি আমজনতাকে আশ্বস্ত করতে চায়, দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে, তাহলে হার্ডলাইনের বদলে সফটলাইন নেওয়ার কথা। জনগণের মধ্যে বিশ্বাস নির্মাণের চেষ্টা করার কথা। সহায়তা ও সহযোগিতা করার কথা।

তিন.

সম্প্রতি ফেসবুকে একজনকে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও যৌক্তিক প্রশ্ন তুলতে দেখলাম। প্রশ্নটি ছিল ‘দলীয় সরকারের অধীনে সভা-সমাবেশটুকুই করতে পারা যাচ্ছে না, সেখানে দলীয় সরকারের অধীনে একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক নির্বাচন কীভাবে সম্ভব?’ আসলেই তো! সভা-সমাবেশের অধিকার সংবিধানসম্মত গণতান্ত্রিক অধিকার।

ক্ষমতাসীন দল যদি আমজনতাকে আশ্বস্ত করতে চায়, দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে, তাহলে হার্ডলাইনের বদলে সফটলাইন নেওয়ার কথা। জনগণের মধ্যে বিশ্বাস নির্মাণের চেষ্টা করার কথা। সহায়তা ও সহযোগিতা করার কথা। বিরোধী দলের দাবিদাওয়াগুলো যেমন হওয়া স্বাভাবিক, সে রকমই! আগ্রাসী, ধ্বংসাত্মক বা আক্রমণাত্মক কোনো কিছু নয়। আগের সব বিভাগীয় সমাবেশও শান্তিপূর্ণ ছিল।

চার.

ধরে নিলাম ক্ষমতাসীন দলের অধীনেই নির্বাচন হবে। তাহলে দেশের জন্য দলের ভবিষ্যৎ–করণীয় কী হবে না হবে আলোচনাই আসল কাজ হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলটির বক্তৃতা, বিবৃতি ভাষণে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে আদৌ কোনো কথা আছে কি? আবার ক্ষমতায় এলে কীভাবে লুটের টাকা, পাচারের টাকা ফিরিয়ে আনা হবে, কোনো দিকনির্দেশনা নেই। বলা হচ্ছে না ব্যাংক কেলেঙ্কারির, অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কীভাবে শায়েস্তা করা হবে। ভবিষ্যতে যেন এ রকম কিছু না ঘটে সেসবের প্রতিবিধানে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, বিষয়েও কোনো আলাপ নেই।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিষয়ে মহা ভীতি ও গণ-অনাস্থা তৈরি হয়েছে। ব্যাংক এটিএম মেশিনগুলোর সামনে দীর্ঘ লাইনগুলো প্রতিদিনই দীর্ঘতর হচ্ছে। আমানতকারীদের আস্থা তলানির দিকে। জনগণের অনাস্থা রোগটি সারাতে, এবং আস্থা ফিরিয়ে আনতে কী কী উদ্যোগ নেওয়া হবে বিষয়ক আলোচনাও একবারেই নেই; বরং অন্ধ আত্মপক্ষ সমর্থনের আপ্রাণ চেষ্টা আছে। ভুলভালগুলো স্বীকার না করার বদলে যৌক্তিকতা দেওয়ার চেষ্টা আছে।

ভবিষ্যতের বদলে অতীতের রাজনৈতিক দুঃশাসনের ফিরিস্তি এবং একই ঘৃণা ও বিদ্বেষের শত-সহস্রবার উদ্‌গিরণ যে আমজনতার মধ্যে সীমাহীন বিরক্তি তৈরি করে চলেছে, সেই উপলব্ধিটুকুও অনুপস্থিত। আমজনতার সঙ্গে আলাপে নামলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথাই শোনা যায়, ‘যারা যারাই খারাপ কাজ করেছে, আমরা মনে রেখেছি। বারবার মনে করিয়ে দিতে চান, দেন। আগে আমাদের ভোটটি তো দিতে দেবেন। যাঁরা যাঁরা খুব খারাপ কাজ করেছেন বলছেন, আমরা ভোটের মাধ্যমেই তাঁদের খারাপ কাজের বিরুদ্ধে জবাব দিয়ে দেব।’ কথায় কথায় অতীতের উদাহরণ টানা প্রসঙ্গে সম্প্রতি একজন মূল্যবান একটি উদাহরণ দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমরা গাড়ির ব্যাক গিয়ার কখন দিই? তখনই দিই, যখন সামনে যাওয়ার কোনো উপায় থাকে না। ডেড এন্ডে গেলে ব্যাক গিয়ার দিই। ব্যাক গিয়ার কখনো সামনে নেয় না।’ এবার সুমতি হোক সবার। নগরে যেন আগুন না লাগে। নগর পুড়লে দেবালয়ও পুড়বে।

  • হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।