একটা ছবি কল্পনা করুন। যুক্তরাষ্ট্র যেসব সরকার, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাদের একটি বৈশ্বিক সম্মেলন চলছে। এই ছবিতে আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের নেতারা আছেন। বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি দল এটি। এই ছবি জি-সেভেন বা অন্যান্য প্রায় নিয়মিত যেকোনো বৈঠকে তোলা ছবির মতোই। এর কেন্দ্রে থাকবে চীন। যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশের সরকারকে অবৈধ বলে ঘোষণা দিয়ে থাকে, তাদের প্রত্যেকেরই নৈতিক ও কূটনৈতিক—বলাই বাহুল্য বাণিজ্যিক ও আর্থিক মিত্র হলো চীন।
গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতির প্রিয় কৌশল হলো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া। ইউক্রেনে সাম্প্রতিক আক্রমণের পর রাশিয়ার ওপর কিংবা জাতীয় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর অর্থ এই, দুই দেশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের চোখে ‘দুষ্টু ছেলেদের’ দলে যোগ দিয়েছে। এই দলে আছে মিয়ানমার, কিউবা, ইরান, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া ও ভেনেজুয়েলা।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেটাবেজ অনুযায়ী, কিউবা, ইরান, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া, সিরিয়া ও ভেনেজুয়েলা যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিস্তৃত নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছে। এর অর্থ হলো যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী বেশির ভাগ বাণিজ্যিক ও আর্থিক খাতে এই দেশগুলোর সঙ্গে লেনদেন করা যাবে না। আফগানিস্তান, বেলারুশ, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, ইথিওপিয়া, ইরাক, লেবানন, লিবিয়া, মালি, নিকারাগুয়া, সুদান এবং ইয়েমেনের মতো অতিরিক্ত আরও ১৭টি দেশের সুনির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার ওপরও নিষেধাজ্ঞা আছে। এর অর্থ ওই সব প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি এবং ক্ষেত্রবিশেষে সরকারের সঙ্গে আর্থিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ যুক্তরাষ্ট্রের আইনে নিষেধ।
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ডেটাবেজ অনুযায়ী, চীন, ইরিত্রিয়া, হাইতি ও শ্রীলঙ্কার মতো আরও সাতটি দেশ সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছিল। এই লম্বা তালিকায় এল সালভাদর, গুয়াতেমালা অথবা প্যারাগুয়ের ব্যক্তিবিশেষ এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, হংকং, বলকান অঞ্চল, ইউক্রেনের ক্রিমিয়া, দোনেৎস্ক অথবা লুহানস্কের মতো অঞ্চলগুলোকে যুক্ত করা হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ৯ হাজার ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং কিছু খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ওই বছরই বাইডেন প্রশাসন বিশ্বব্যাপী আরও ৭৬৫টি নতুন নিষেধাজ্ঞা দেয়। এর ১৭৩টি ছিল মানবাধিকার ইস্যুতে। কোনো না কোনোভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় পড়েছে যে দেশগুলো, বৈশ্বিক উৎপাদনে তাদের অবদান প্রায় এক–পঞ্চমাংশ। এই উৎপাদনের ৮০ ভাগের দাবিদার আবার চীন।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা অঞ্চলগুলোর মধ্যে বেইজিংয়ের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত বৈরিতা একটি বড় সমস্যা। কারণ, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি নিজেদের গ্লোবাল সাউথের (দক্ষিণ বিশ্ব) অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং নৈতিক মিত্র হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে।
ফরেন পলিসির নিয়মিত প্রদায়ক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল ডব্লিউ ড্রেজনার এবং কলাম লেখক ও অর্থনীতিবিদ আইগাথ ডেমারি সম্প্রতি একটি লেখায় দেখিয়েছেন কীভাবে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা সরকারগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এই ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করে। নিষেধাজ্ঞার কারণে যে ব্যথা পাওয়ার কথা, তা এড়িয়ে যায়। পাশাপাশি ডলার এবং পশ্চিমা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে কখনো কখনো অবৈধ উপায়ের আশ্রয় নেয়।
চীনের অর্থনৈতিক ভার, ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক প্রভাব, মুদ্রার মানের স্থিতিশীলতা এবং তারল্য অন্তত এখন পর্যন্ত চীনের সরকারি মুদ্রা রেনমিনবি এবং চীনা আর্থিক ব্যবস্থার দিকে টানতে পারে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা অন্য দেশগুলোকে।
তা ছাড়া চীন বড় ও লাভজনক বাণিজ্যের সুযোগও দিচ্ছে ভেনেজুয়েলা, রাশিয়া অথবা ইরানের তেল-গ্যাসকে। যদিও বাণিজ্যের নতুন এই পথ ব্যয়বহুল এবং অদক্ষ, তারা এখনো নিষেধাজ্ঞায় পড়া দেশগুলোর টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট সহযোগিতা করছে।
ফরেন পলিসি থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ
● ক্রিস্টোফার সাবাতিনি চ্যাটাম হাউসের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো