নভেম্বর মাসে নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখে অনেক বিশ্লেষক সন্দেহাতীতভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র যে একটা ব্যর্থ গণতন্ত্র, তার চিহ্ন এরই মধ্যে দেখাতে শুরু করেছে। দেশটির সরকার ও রাজনীতি প্রায়ই অকেজো এবং দুর্নীতিতে জর্জরিত।
ট্রাম্পের বিজয় সম্ভাবনা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন মাত্রার অবক্ষয়ের শঙ্কা জন্ম দিয়েছে। দেশটিতে ফ্যাসিবাদী-কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যাহোক, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এমন কোনো পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন করা হবে না, যা স্বাভাবিক সময়ের মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির চেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক হবে।
একুশ শতকের শুরু থেকে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্র অসংখ্য সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার জন্ম দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনিই হোন, এটিই মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি।
২০০১ সালের ৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করে। আফগানিস্তানে তারা আগ্রাসন চালায় ও দখলে নেয়। এরপর অবৈধভাবে ইরাক আক্রমণ করে ও সেখানে আগ্রাসন শুরু করে।
আমেরিকার এই পদক্ষেপের ২০ বছরে ৪৬ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে যে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়, তার ফলে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে।
বাইডেন এ ক্ষেত্রে আরও কূটনৈতিক কৌশল অনুসরণ করে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। একই সঙ্গে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ আছে এমন দেশগুলোকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে আমেরিকান আধিপত্য গ্রহণ করার চেষ্টা করে চলেছেন। যাই হোক, বাইডেনও অর্থনৈতিক ও সামরিক জবরদস্তির ধারা অনুসরণ করেন।
২০০৭-০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করেছিল। সেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধাক্কার প্রতিধ্বনি এখনো শোনা যায়।
২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোট লিবিয়া আক্রমণ করে। এতে লিবিয়া রাষ্ট্রটি ধসে পড়ে। উত্তর আফ্রিকায় অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়, যা নতুন শরণার্থীর স্রোত জন্ম দেয়।
দশকের পর দশক ধরে রাশিয়ার সতর্কতা উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে ন্যাটো সম্প্রসারণের চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমেরিকানদের এই কৌশল ২০১৪ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ানদের সর্বাত্মক আগ্রাসনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেন যুদ্ধে দুই দিক থেকে প্ররোচনা দিচ্ছে। একদিকে রাশিয়াকে চিরস্থায়ীভাবে দুর্বল করে দেওয়ার আশা তারা করেছে। অন্যদিকে শান্তি আলোচনার সম্ভাবনাও ঠেকিয়ে রেখেছে।
বর্তমানে ইউক্রেন বড় পরাজয় এবং ভূখণ্ড হারানোর প্রান্তে দাঁড়িয়ে। আর যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ইউক্রেনকে পরিত্যাগ করতে চলেছে।
বৈশ্বিক উত্তেজনায় জ্বালানি জোগাচ্ছে
তাইওয়ান রিলেশনস অ্যাক্টের (১৯৭৯) প্রতি আমেরিকানরা তাদের অঙ্গীকার পরিত্যাগ করার মাধ্যমে চীনের সঙ্গে উত্তেজনায় প্ররোচনা দিয়ে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার ছিল, তারা তাইওয়ানের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সম্পর্কে জড়াবে না কিংবা তাইওয়ানের সঙ্গে কোনো জোট করবে না। অথচ দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক ঘাঁটি করে সংঘাতের ইন্ধনও দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
গাজায় ইসরায়েলের হামলাও আংশিকভাবে কয়েক দশক ধরে চলা মার্কিন ভুল নীতির চূড়ান্ত পরিণতি বলা চলে। ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকানদের শর্তহীন সমর্থনের কারণে দেশটি একটা বর্ণবাদী দেশে পরিণত হয়েছে। এর ফলে ফিলিস্তিন ভূমিতে ইসরায়েল অবৈধভাবে বসতি স্থাপন করেছে এবং সহিংস উপায়ে ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
গাজার ২৩ লাখ ফিলিস্তিনির অনাহারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরায়েল। এই অনাহারে থাকা ফিলিস্তিনিদের অর্ধেকের বেশি শিশু। ইসরায়েলের এসব যুদ্ধাপরাধের পুরোপুরি দোসর যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলকে খোলাখুলি সমর্থন দেওয়ায় পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিই মূল কারণ।
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক স্থিতিশীলতাকে বিপদে ফেলে এবং নৃশংসতাকে সমর্থন দেয়।
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাইডেন ও ট্রাম্প সমানে সমান
বাইডেন প্রশাসন তাদের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এমন কিছু উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছে, যার উৎপত্তি ট্রাম্পের সময়ে।
চীনের বিরুদ্ধে নেওয়া ট্রাম্পের অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও রাজনৈতিক যুদ্ধ বাইডেন এসে দ্বিগুণ তীব্র করেছেন। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের নেওয়া সংরক্ষণবাদের পালে বাতাস দিয়েছেন, যা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে স্থবির করে দিয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের নেওয়া ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছেন বাইডেন। এই চুক্তির মূলকথা হলো, ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান না করে ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। ধারণা করা হয় যে সৌদি আরব এই শর্ত বিবেচনা করে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেওয়ায়, হামাস ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে ঢুকে হামলা চালায়।
বাইডেন ও ট্রাম্প—দুজনেই একই দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেন। সেটি হলো বিশ্বে আমেরিকানদের চিরস্থায়ী আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। তাঁদের মধ্যে পার্থক্য কেবল এক জায়গায়। সেটি হলো, কীভাবে এর অর্জন হবে।
ট্রাম্প বিশ্বাস করেন, যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি ব্যবহার করে জবরদস্তি বলে বিশ্বকে আমেরিকান ইচ্ছা মানতে বাধ্য করবে। ট্রাম্প নিজেকে একজন ‘যুদ্ধবিরোধী’ বলে উপস্থাপন করতে চান। কিন্তু হুমকি-ধমকি ও সহিংসতার প্রতি ট্রাম্পের যে ঝোঁক, সেটি আমেরিকান চরিত্রের প্রতিফলন।
বাইডেন এ ক্ষেত্রে আরও কূটনৈতিক কৌশল অনুসরণ করে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। একই সঙ্গে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ আছে এমন দেশগুলোকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে আমেরিকান আধিপত্য গ্রহণ করার চেষ্টা করে চলেছেন। যাই হোক, বাইডেনও অর্থনৈতিক ও সামরিক জবরদস্তির ধারা অনুসরণ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা নিজেদের নিজেরা বুঝ দেন এই বলে যে, বাইডেনের সময়কালটা তাদের জন্য স্বাভাবিক সময়ে ফেরার কাল। কিন্তু মিত্র দেশগুলো এখনো আমেরিকানদের বৈশ্বিক সহিংসতা সমর্থন দিয়ে চলেছে। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে আমেরিকার রাজনৈতিক ক্ষয়কে উপেক্ষা করে চলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অকেজো রাজনীতির উপসর্গ ট্রাম্প, ফলাফল নয়। নভেম্বরের নির্বাচনে ট্রাম্প যদি হেরেও যান, তারপরও রিপাবলিকানরা ফ্যাসিবাদের দিকে ঝুঁকতেই থাকবে। আমেরিকান রাজনীতি বিষাক্তই থেকে যাবে।
শাওন নারাইন, কানাডার সেন্ট থমাস ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনৈতিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত