অধ্যাপক পদে পদোন্নতি কি এভাবেই হতে থাকবে

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকরাজনীতি বন্ধ করা প্রয়োজন, এ নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞের মতামত ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে তরুণ শিক্ষকদের আশা দেখাচ্ছে। এসব দলাদলির বা রাজনীতির পেছনে যেসব কারণ, তার মধ্যে একটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লিখিত নিয়মের বাইরেও ‘প্রচলিত নিয়মের কথা বলে রাজনৈতিক বিবেচনা’ নামক বৈষম্যমূলক প্রথার অস্তিত্ব।

নিয়োগপ্রক্রিয়ার সংস্কার নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে, তবে আমরা এই লেখায় একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগপ্রাপ্তির পর থেকে তাঁকে কীভাবে ‘প্রচলিত নিয়মের’ সঙ্গে টিকে থাকার জন্য লড়াই করতে হয়, তা কিছু উদাহরণ দিয়ে তুলে ধরতে চাই।

কিংস কলেজ লন্ডন নতুন প্রফেসর পদে পদোন্নতি পেলে আয়োজন করে উদ্বোধনী বক্তৃতার। সেরকম এক আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন শিক্ষক তাঁর বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ছাড়াই যোগদান এবং শিক্ষকতার বর্ণনা দিয়েছিলেন এভাবে, ‘এটা প্রত্যাশা করা হয় যে বাংলাদেশে একজন শিক্ষক তাঁর যোগদানের পর একটি মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি উচ্চতর ডিগ্রি করবেন এবং সে অনুযায়ী তাঁর পরবর্তী শিক্ষা ও গবেষণায় উৎকর্ষ বজায় রাখবেন।’

এই অবস্থাকে যদি মানদণ্ড ধরে এগোনো হয়, তাহলে একজন নবনিযুক্ত শিক্ষককে শিক্ষা ও গবেষণায় একটি ভালো ভিত্তি তৈরি করতে হবে, যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বাইরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তিসহ উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবেন। এমতাবস্থায়, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের যোগদানকৃত বিভাগ থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সহযোগিতায় শিক্ষা ও গবেষণার কাঠামোগত প্রারম্ভিক প্রশিক্ষণ এবং উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাওয়া উচিত।

উন্নত বিশ্বে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একজন নবাগত শিক্ষককে শুরুতেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ একজন মেন্টর ঠিক করে দেওয়া হয়, সঙ্গে থাকে বিভাগীয় প্রশিক্ষণ এবং সহযোগিতার অবারিত সুযোগ। কিন্তু আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম কাঠামোগত প্রবেশনের প্রচলন নেই; বরং আছে ‘প্রচলিত নিয়মের’ আড়ালে সক্রিয় রাজনৈতিক বিবেচনা।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই রূঢ় বাস্তবতা মেনে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নবাগত শিক্ষকের জন্য অপর্যাপ্ত ব্যবহারযোগ্য রিসোর্স। ক্যারিয়ারের শুরুতে, সীমিত বেতনে শুধু একটি চেয়ার আর টেবিল ছাড়া আর কিছু না পাওয়া শিক্ষকদের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা-গবেষণা চালানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অথচ প্রত্যাশা অনুযায়ী একটি আধুনিক ক্লাসের প্রস্তুতিতে নিদেনপক্ষে একটি কম্পিউটার অপরিহার্য! বাস্তবতা হচ্ছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রফেসর আছেন, যাঁরা এখনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি কম্পিউটার পাননি!

এত কিছুর পর যখন একজন শিক্ষক প্রয়োজনীয় গবেষণাকর্ম প্রকাশ করার পর পদোন্নতির জন্য আবেদন করেন, তখন আবার লড়তে হয় ‘প্রচলিত নিয়ম’–এর বিরুদ্ধে। লিপিবদ্ধ নিয়ম অনুসারে পদোন্নতি পেতে তিনটি ধাপ পেরোতে হয়: প্রথমে বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটি, তারপর সুপারিশপ্রাপ্ত হলে নির্বাচনী বোর্ড কর্তৃক মূল্যায়ন, এবং সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট কর্তৃক অনুমোদন। এই তিন স্তরের মধ্যে শুধু প্রথম ধাপ কত কার্যদিবসের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে, তা লিখিত নিয়মে বলা আছে। বাকি দুই স্তরে চলছে ‘প্রচলিত নিয়ম’।

ভিন্ন মতাদর্শের হলে আবেদনকারীকে পাড়ি দিতে হয় চরম অসহযোগিতার স্তর, রাজনৈতিক সহযোগীদের ক্ষেত্রে সেটা আবার পুরোপুরি ভিন্ন; রাজনৈতিক ভিন্নমত হলেই শুরু হয় বঞ্চনা। রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে উপাচার্য বা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সহযোগী হলে প্রার্থীর অযোগ্যতাও সময়ে সময়ে যোগ্যতায় পরিণত হয়, আর প্রায়ই সাধারণ কিন্তু যোগ্য প্রার্থী হয়রানির শিকার হন।

আমাদের এক সহকর্মী সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য আবেদন করেছিলেন, তখন মাসের পর মাস নির্বাচনী বোর্ডের সভার তারিখ পাওয়া যাচ্ছিল না। স্বভাবতই ক্ষুব্ধ ও হতাশ সহকর্মী রেজিস্ট্রার অফিসের আরেক সহকর্মীকে কারণ জানতে চাইলে এর উত্তরে তিনি ‘প্রচলিত নিয়ম’–এর কথা অবগত হন।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার বনিয়াদি প্রশিক্ষণে শিখেছিলাম, প্রতিটি ক্লাস এক একটি ‘পারফরম্যান্স’। আর ভালো পারফর্ম করার জন্য দরকার দীর্ঘ মানসিক প্রস্তুতি। যেখানে একজন শিক্ষককে যখন ‘এত দিনেও প্রমোশন হয় না কেন?’ এই প্রশ্ন আর গ্লানি নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে দৌড়াতে হয় শুধু ‘প্রচলিত নিয়ম’–এর বেড়াজাল ডিঙাতে, সেখানে পারফর্ম করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যায়।

বিস্তারিত জানতে চাইলে উত্তর পেয়েছিলেনে, ‘এটা কারও জন্য কয়েক দিন, আবার কারও জন্য বছর!’ এই ‘প্রচলিত নিয়ম’ বাস্তবে একটি ফাঁদ, যেখানে আমরা কেউ জানি না কে কত দিন আটকে থাকব।

এর দ্বারা তরুণ শিক্ষকেরা হয়ে পড়েন অরক্ষিত। আর বাংলাদেশে অরক্ষিত কাউকে নিয়ে রাজনীতি করা সবচেয়ে সহজ! যদিও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু সহকারী অধ্যাপক পদে আবেদনের তারিখ থেকে পদোন্নতি বিবেচনা করা হয় এবং বকেয়া বেতন মেলে, কিন্তু এই ‘প্রচলিত নিয়ম’ অনুসারে যখন আমাদের যেখানে থাকার কথা ছিল সেখানে না থাকতে পারার গ্লানির কি কোনো প্রতিকার আছে?

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার বনিয়াদি প্রশিক্ষণে শিখেছিলাম, প্রতিটি ক্লাস এক একটি ‘পারফরম্যান্স’। আর ভালো পারফর্ম করার জন্য দরকার দীর্ঘ মানসিক প্রস্তুতি। যেখানে একজন শিক্ষককে যখন ‘এত দিনেও প্রমোশন হয় না কেন?’ এই প্রশ্ন আর গ্লানি নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে দৌড়াতে হয় শুধু ‘প্রচলিত নিয়ম’–এর বেড়াজাল ডিঙাতে, সেখানে পারফর্ম করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যায়।

কোনো কিছুর জন্য নিয়মমাফিক আবেদন করলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তার একটা জবাব প্রত্যাশা করা কি এই আধুনিক যুগে খুব বড় চাওয়া? ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত রাজনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে ‘প্রচলিত নিয়ম’–এর দীর্ঘসূত্রতা কমানো বা বাড়ানোর যে খেলা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান, সেখান থেকে আমরা মুক্তি চাই।

পরিশেষে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রচলিত প্রথার সমস্যাগুলো সমাধানে লিখিত নিয়ম ও নির্দেশিকা প্রণয়ন করা, নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, নতুন শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা, পদোন্নতির প্রক্রিয়া সময়মতো সম্পন্ন করা, গবেষণা ও শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ বরাদ্দ করা এবং শিক্ষকদের মধ্যে উন্মুক্ত যোগাযোগ ও দায়িত্ববোধের সংস্কৃতি গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। এসব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই একটি ন্যায়সংগত ও সহায়ক একাডেমিক পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘একটি জাতির মহত্ত্ব এবং নৈতিক অগ্রগতি নির্ধারিত হয় তার সবচেয়ে দুর্বল সদস্যদের প্রতি আচরণ দ্বারা।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি এই নীতির প্রয়োগ আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য জরুরি।

  • ড. মো. মাহবুব হাসান মোহাম্মদ শাহজাহান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি এবং পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক