গাজায় ইসরায়েলের চলমান অভিযান নিয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) গত শুক্রবার যে রুলিং বা আদেশ দিয়েছেন, তা ইসরায়েলপন্থী পশ্চিমাদের অবস্থানের বিরুদ্ধে ডি–৯ বুলডোজারের (সাধারণত ভবন কিংবা ভারী স্থাপনা উচ্ছেদের কাজে এই বুলডোজার ব্যবহৃত হয়ে থাকে) চেয়ে শক্তিশালী আঘাত।
এই আদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, গাজায় যা চলছে তা কোনো শত্রুপক্ষের অস্ত্রধারী গ্রুপকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী বা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে এই হামলা চালানো হচ্ছে। এই শতকের সংঘাতের ইতিহাসে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রায় আর হতে পারে না।
এই আদেশ আন্তর্জাতিক আইনের নৈতিকতা, নিরপেক্ষতা ও অবস্থানকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে। ইসরায়েলকে তার প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী ও সমর্থকেরা যে দায়মুক্তি দিচ্ছে, সেটিও এই আদেশের মাধ্যমে দেখা যাবে।
অস্ত্রনীতির বদলে কূটনীতি ফিরে এসেছে বলে মিথ্যা দাবি করার পর সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বর গণহত্যাকে সর্বাত্মক সমর্থন দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের নৈতিক চিত্র সবার সামনে প্রকাশিত হয়েছে।
ইসরায়েল এখন গণহত্যার অভিযোগে আদালতের কাঠগড়ায় আছে। গণহত্যা চালানো ও গণহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া ঠেকাতে ইসরায়েল কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা ইসরায়েল এক মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন পেশ করতে বাধ্য থাকবে। সেই প্রতিবেদন এই মামলার বাদী দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যালোচনা করবে।
হ্যাঁ, এটি ঠিক যে হতাশাজনকভাবে আইসিজে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি চাননি। এই যুদ্ধে শুধু একটি পক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত—এই বিষয়টিকে কারণ দেখিয়ে আইসিজে এমন রায় দিয়েছেন।
ফিলিস্তিনিদের তাদের অবর্ণনীয় দুর্দশার স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আদালতের রায়ের প্রয়োজন নেই। তারা এমন একটি ব্যবস্থা আশা করছিল, যা এই গণহত্যার অবসান ঘটাবে। কিন্তু ইসরায়েল ইতিমধ্যে আইসিজের যেকোনো রায়কে উড়িয়ে দেবে—এমন ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে। তাই ইসরায়েল আইসিজের আদেশ মেনে নিজের অবস্থান থেকে সরবে বলে এখনো মনে হচ্ছে না।
গাজায় ইসরায়েলের প্রতিদিনকার হত্যা বন্ধে ওয়াশিংটন অপারগ—এমন একটি ভাষ্য দাঁড় করানোর জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গাজা হত্যাকাণ্ড থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখছেন। পশ্চিমা শক্তিগুলো ব্লিঙ্কেনের এই মনোভঙ্গিকে সমর্থনও দিয়ে যাচ্ছে। আইসিজের আদেশ পশ্চিমাদের সেই নীতির পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
গাজার চেয়ে কম মাত্রার; কিন্তু বিষয়ের দিক থেকে সমান গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য যুদ্ধাপরাধের বিচার করা বিশ্বের অন্যান্য আদালতকে অধিকতর শক্তি জোগাতে আইসিজের এই আদেশ বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
যদি বর্ণবৈষম্য ইসরায়েলের স্বাভাবিক ও পশ্চিমা ধারার গণতন্ত্রের দেশ হয়ে ওঠার পথে একটি বড় ধাক্কা হয়ে থাকে, তাহলে গণহত্যার তকমা সেই চেষ্টার কফিনে অবশ্যই পেরেক হিসেবে কাজ করবে।
স্পষ্টতই আইসিজের আদালত ইসরায়েলের আত্মরক্ষার যুক্তিকে বিশ্বাস করেননি। আইসিজের বিচারক প্যানেলের প্রেসিডেন্ট জোয়ান ডানেহিউ আদেশ দেওয়ার সময় দক্ষিণ আফ্রিকার পেশ করা অসংখ্য তথ্যপ্রমাণ ব্যবহার করেছেন। সেই দিক থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার আইনি দলের বিজয় দাবি করাটা যথার্থ।
আইসিজের এই আদেশের জরুরত সবারই দেখার বিষয়। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গাজার সাড়ে সাত লাখ মানুষ এখন ‘বিপর্যয়কর ক্ষুধার’ মুখে পড়েছে। খাবারযোগ্য পানি না থাকায় দূষিত ও ময়লা পানি পান করে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। ডায়রিয়ার মতো রোগে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে। খাবারের সংকটের পাশাপাশি চিকিৎসা না পাওয়ার সংকটও রয়েছে। গম, যব শেষ হয়ে যাওয়া গাজার মানুষ পাখি ও পশুর খাবার মিশিয়ে তাই রান্না করে খাচ্ছে। ইসরায়েলের সেনাবাহিনী বুলডোজার দিয়ে গাজার কৃষিজমির সব শস্য নষ্ট করে দিচ্ছে।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন যখন যুক্তরাজ্য থেকে দোহা হয়ে মিসরের উদ্দেশে যাত্রা করা বিমানে গাজাবাসীর জন্য ত্রাণ সহায়তার পুঁটলিগুলো তুলে দেওয়ার ছবি প্রকাশ করছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে সরবরাহ শৃঙ্খলের অপর প্রান্তে থাকা ইসরায়েলিরা ত্রাণ সহায়তার প্রবাহকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে সবকিছু করে যাচ্ছে।
গাজায় ত্রাণের ট্রাক প্রবেশের জন্য কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। গাজা পর্যন্ত মাল ঢুকতে ট্রাকগুলো একাধিকবার আনলোড ও লোড করা হয়। যদি ট্রাকবোঝাই মালের মধ্যে নিষিদ্ধ কিছু পাওয়া যায়, তাহলে সেই ট্রাকটিকে একেবারে পেছনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পুরো প্রক্রিয়াটি শুরু থেকে শুরু হয়।
যেখানে জরুরি সহায়তা পাঠানো দরকার, সেখানে তা না পাঠিয়ে উল্টো ক্ষুধার্ত মানুষদের ট্যাংক এবং স্নাইপারের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। এখন এটির অনেকগুলো নথিভুক্ত উদাহরণ রয়েছে। এটিকে এখন আর দুর্ঘটনাজনিত বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে না।
ইসরায়েল প্রথম থেকে গাজাবাসীকে মিসরের সিনাই অঞ্চলে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে আসছে। কিন্তু মিসর গণহারে গাজার অধিবাসীদের সিনাইয়ে ঢুকতে দিতে না চাওয়ায় এখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর কৌশলগত বিষয়াদিসংক্রান্ত মন্ত্রী রন ডারমারকে বলেছেন, তিনি যেন গাজার বাসিন্দাদের নৌপথে ইউরোপ ও আফ্রিকায় তাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
ইসরায়েল হায়োম নামের একটি পত্রিকা বলেছে, ইসরায়েলের নেতারা যুক্তি দিচ্ছেন, সিরিয়া, লিবিয়া, তিউনিসিয়ার লোকেরা গৃহযুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচতে যেভাবে নৌকায় করে ইউরোপে পাড়ি জমায়, একইভাবে গাজার লোকেরা নৌকায় করে এলাকা ছেড়ে যেতে পারবে না কেন?
কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও গাজাবাসীর মধ্যে সেই ধরনের পলায়নের ইচ্ছা ইসরায়েলের বাহিনী জাগিয়ে তুলতে পারেনি। ফলে নেতানিয়াহু আরও আগ্রাসী হয়ে উঠেছেন। এর কারণ ইসরায়েলের ডানপন্থীরা চান, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের যত দ্রুত সম্ভব সরিয়ে দেওয়া হোক। নেতানিয়াহু তাতে ব্যর্থ হলে সেটি তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য ক্ষতিকর হবে।
তবে যদি আইসিজের আদেশ না মেনে ইসরায়েল হামলা করতেই থাকে, তাহলে আমার মনে হয় যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ বাড়বে এবং তারা প্রয়োজনে বিমান থেকে গাজায় ত্রাণ ফেলতে বাধ্য হবে। আর ত্রাণ পেলে গাজাবাসীর মনোবল আরও বেড়ে যাবে।
আপাতত ইসরায়েলের সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক অস্ত্র হলো গাজাকে ঘিরে রাখা। সেখানে কোনো ত্রাণ ঢুকতে না দেওয়া। আইসিজের আদেশের কারণে ইসরায়েলের সেই শয়তানি অস্ত্র হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। যদি তারা এটি হারায়, তবে ইসরায়েলের একধরনের পরাজয় হবে।
● ডেভিড হার্স্ট মিডল ইস্ট আই-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ